সাম্প্রতিক

বাংলাদেশের প্রমাণ করার কিছুই নেই

ড. মইনুল ইসলাম

ভারতের কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কলকাতা থেকে প্রকাশিত আনন্দবাজার পত্রিকাকে দেয়া এক সাক্ষাত্কারে আবারো বাংলাদেশকে অহেতুক অপমান করে মন্তব্য করেছেন, ‘বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকার মানুষ খেতে না পেয়ে ভারতে অনুপ্রবেশ করছে। তারা শুধু পশ্চিমবঙ্গে থাকছে না, জম্মু-কাশ্মীর পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে।পশ্চিমবঙ্গের চলমান বিধানসভা নির্বাচনে মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল কংগ্রেসকে ক্ষমতাচ্যুত করতে বিজেপি তাদের কথিত বাংলাদেশী অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের প্রধান নির্বাচনী প্রোপাগান্ডা-ইস্যু বানিয়েছে। তারই অপকৌশল হিসেবে অমিত শাহের এমন আক্রমণাত্মক মন্তব্য! এর প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ সম্পর্কেঅমিত শাহের জ্ঞান সীমিতমন্তব্য করে বলেছেন, ‘ভারতের ৫০ শতাংশ মানুষ এখনো ভালো টয়লেট ব্যবহার করতে পারে না, অথচ বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ মানুষ তা করছে। বাংলাদেশের মানুষ এখন আর অনাহারে থাকে না। এখানে এখন মঙ্গাও নেই।প্রতিক্রিয়া হিসেবে টয়লেট ব্যবহারকে ইস্যু বানানো হয়তো সুবিবেচনাপ্রসূত বলা যাবে না, তবুও বলব অভ্যন্তরীণ রাজনীতির নির্বাচনী অপকৌশল হিসেবে বারবার বাংলাদেশকে অহেতুক টার্গেট করে অপমানসুলভ মন্তব্য বাংলাদেশ-ভারতের সুপ্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ককে বিনষ্ট করছে, বার্তা দেয়ার প্রয়োজন ছিল। আমাকে আজ কলম ধরতে হলো বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কর্তৃক অমিত শাহকে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানানো-সংক্রান্ত মন্তব্যটির জন্য। অমিত শাহদের মতো কট্টর হিন্দুত্ববাদী ব্যক্তিদের রাজনৈতিক অপকৌশল মোকাবেলা করার জন্য তাদের বাংলাদেশে আসার আমন্ত্রণ জানানো মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ তাদের কাছে বাংলাদেশের প্রমাণ করার কিছুই নেই।

বাংলাদেশের জনগণের একটি অংশ সাম্প্রদায়িকতার অন্ধকারে নিমজ্জিত বিধায় তারা কট্টর ভারতবিরোধী। বিজেপি ভারতে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে তার মুসলিমবিরোধী রাজনীতি বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ভারত বিরোধিতাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। আমার আশঙ্কা, এখন বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষ ভারতবিদ্বেষী সাম্প্রদায়িকতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। জনগণের মধ্যে একটা ধারণা জন্মেছে যে বাংলাদেশ ভারতকে অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা দেয়া সত্ত্বেও ভারত বাংলাদেশের ন্যায্য পাওনা প্রদানে মোটেও আগ্রহী নয়। তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি শুধু মমতা ব্যানার্জির কারণে আটকে আছে বলে প্রচার-প্রচারণা সত্ত্বেও দেশের জনগণ ব্যাপারে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকাকেও গ্রহণযোগ্য মনে করছে না। বিশেষত প্রস্তাবিত তিস্তার পানি ব্যবস্থাপনা প্রকল্পটির বাস্তবায়ন ভারতের চাপের কারণে ঝুলে রয়েছে বলে ধারণাটি জনমনে গেড়ে বসছে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ভারত তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর করবে কি করবে নাএটাকে গুরুত্ব না দিয়ে তিস্তা প্রকল্প অবিলম্বে বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি আর বাংলাদেশের কৃষকদের জীবন-মরণ সমস্যা থাকবে না। অন্যদিকে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফের অব্যাহত হত্যাকাণ্ডকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শংকর যতই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করুন না কেন, ওই ব্যাখ্যা বাংলাদেশের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ অপরাধ সংঘটিত হলেই বিনা বিচারে গুলি করে হত্যা কখনই সভ্য দেশের একটি সরকারি বাহিনীর আইনসম্মত আচরণ হতে পারে না।

২০১৫ সালে অমিত শাহের পূর্বসূরি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বর্তমান প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ পরিদর্শনে এসে অহেতুক মন্তব্য করেছিলেন, ‘ বেড়া দিয়ে বাংলাদেশীদের গরুর মাংস খাওয়া ভুলিয়ে দেব।তার মানে, ভারত থেকে চোরাচালানে গরু পাচার হতে না দিলে বাংলাদেশে গরুর মাংসের দাম এত বেড়ে যাবে যে বেশির ভাগ বাংলাদেশীর তা কিনে খাওয়ার সামর্থ্য থাকবে না। একথা বলে রাজনাথ সিং বাংলাদেশের একটা উপকারই করেছেন, কারণ তার কথার চার বছরের মধ্যেই বাংলাদেশ ২০১৯ সালে গরু উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। অবশ্য সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দিয়েও ভারত গরু চোরাচালান পুরোপুরি বন্ধ করতে পারেনি। এখন নদীর উজান থেকে চোরাচালানের গরু স্রোতে ভাসিয়ে দিয়ে বাংলাদেশের চোরাচালানিদের কাছে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। কয়েক দিন আগে রকম ভেসে আসা গরুর বেশ কয়েকটি বিএসএফের গুলিতে মরে যাওয়ায় নদীর পানিতে গরুর মরদেহ ভাসার ছবি দেখে ব্যথিত হলাম। আনন্দবাজার পত্রিকাকে দেয়া অমিত শাহের সাক্ষাত্কারেও চোরাচালান সমস্যাটি এখনো রয়েছে বলে তিনি স্বীকার করেছেন। তিনি দম্ভোক্তি করেছেন, বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে জিতলে সীমান্ত দিয়ে মশা-মাছিও আসতে দেবেন না।

একটা বাস্তবতা এখনো ভারত সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বের মনোজগতে হয়তো দৃঢ়মূল হয়নি যে আজকের বাংলাদেশ অর্থনৈতিক রাজনৈতিক কোনো ক্ষেত্রেই ভারতের করুণার ওপর নির্ভরশীল নয়। আমাদের অর্থনীতি এখন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সামর্থ্য অর্জন করেছে। আমাদের লেনদেন ভারসাম্যের চলতি হিসাবে এখন আর উল্লেখযোগ্য ঘাটতি হচ্ছে না। যেটুকু বাণিজ্য ভারসাম্যের ঘাটতি রয়েছে, সেটুকু আমরা প্রবাসী বাংলাদেশীদের প্রেরিত রেমিট্যান্স এবংসাপ্লায়ারস ক্রেডিটথেকে অনায়াসে মেটাতে পারছি। ভারত বাংলাদেশকে যে বৈদেশিক ঋণ দেয়ার অঙ্গীকার করেছে, ওগুলো সবই এমন সব প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে, যে প্রকল্পগুলো প্রকৃত প্রস্তাবে বাংলাদেশের চেয়েও ভারতের প্রয়োজনই বেশি মেটাবে।ক্রস-বর্ডার কানেক্টিভিটিবৃদ্ধির আবশ্যকতা বাংলাদেশের জন্য যতখানি প্রয়োজন, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রয়োজন ভারতেরসেভেন সিস্টার্সরাজ্যের জন্য। ভারত কর্তৃক বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহারের উপকার যতখানি বাংলাদেশ পাবে, তার চেয়ে বহুগুণ বেশি পাবে ভারতের সেভেন সিস্টার্স। ভারত বাংলাদেশের আমদানি পণ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম সূত্র হলেও ওই সূত্র বিঘ্নিত বা বন্ধ হলে বিকল্প সূত্র পেতে বাংলাদেশের খুব বেশি অসুবিধা হবে না। একটা কথা ভারতকে মনে করিয়ে দেয়া দরকার যে পারস্পরিক বাণিজ্য সম্পর্ক দুই দেশের জন্যেউইন উইন প্রপোজিশননা হলে বাণিজ্য বৃদ্ধি পায় না। যেহেতু বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যপ্রবাহ ভারতকেই অনেক বেশি সুবিধা এনে দিচ্ছে, এটাকে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের দয়াদাক্ষিণ্য মনে করা কাম্য নয়। ভারতের সঙ্গে সৎ প্রতিবেশীসুলভ বন্ধুত্ব নিশ্চয়ই চাই আমরা। কিন্তু বন্ধুত্ব হয় দুই সমমর্যাদাসম্পন্ন প্রতিবেশীর মধ্যে, পরস্পরের প্রতি সম্মান ভালোবাসার ভিত্তিতে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ মুসলিমদের প্রতি ঘৃণা, তাচ্ছিল্য বিদ্বেষ যদি বিজেপির নেতাদের মনের মধ্যে গেঁথে থাকে, তাহলে বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে ভারতের জনগণের বন্ধুত্ব বিজেপির আমলে কখনই দৃঢ় হবে না।

প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে যেভাবে গতিশীল করে তুলেছেন, তার ফলে আমরা পাকিস্তানকে প্রতিটি ক্ষেত্রে পেছনে ফেলে এসেছি। এখন সময় এসেছে ভারতকে টপকে যাওয়ার। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কোনোভাবেই ভারতের ওপর নির্ভরশীল নয়। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক কোনো দৃষ্টিকোণ থেকেই বাংলাদেশ ভারতের কাছে অসহায় অবস্থানে নেই যে ভারতের কট্টর হিন্দুত্ববাদী শাসক দলের নেতাদের অপমানজনক বাক্যবাণ তাচ্ছিল্য এবং বিজেপির নানা মুসলিমবিদ্বেষী কর্মকাণ্ডকে বিনা প্রতিবাদে মেনে নিতে হবে! ভারতের সঙ্গে সৎ প্রতিবেশীসুলভ সুসম্পর্ক অব্যাহত রেখেও সমমর্যাদার ভিত্তিতে বাংলাদেশ-ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে পুনর্মূল্যায়নের সময় এসেছে। ভারতের শাসক দল বিজেপিআঞ্চলিক আধিপত্যদেখাতে অভ্যস্ত, তারা নেপাল, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ ভুটানকে হারিয়েছে এমন দাদাগিরি দেখানোর কারণেই।  আধিপত্যবাদী জবরদস্তিকে বাংলাদেশের প্রত্যাখ্যান করতে হবে।

 

. মইনুল ইসলাম: একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ

অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন