গুরুত্বারোপ

ব্যবসায়িক রীতি-নীতিতে প্রজন্মান্তরে পরিবর্তন

ড. আর এম দেবনাথ

প্রায়ই খবরের কাগজে স্টার্টআপ-এর বড় বড় খবর পড়ি। পড়ে পড়ে আনন্দিত হই, উৎসাহিত হই। কিন্তু পরক্ষণেই আনন্দ মলিন হয়ে যায় কর্মচ্যুত মানুষের হাহাকারের খবর পড়ে। আরো কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি কর্মচ্যুতির পাশাপাশি চাকরিচ্যুতির খবর শুনে। একটি কাগজে দেখলাম তিতুমীর কলেজের গ্র্যাজুয়েট একটি ছেলে চাকরি করত। কভিড-১৯-এর প্রথম ধাক্কায় সে চাকরিচ্যুত হয়। পরে তিনজনের একটা সংসার চালানোর তাগিদে সে রাইডশেয়ারিং- মোটরসাইকেল চালাত। আয় থেকে সে বাড়িতেও টাকা পাঠাত। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে এখন তা- বন্ধ। সচিত্র এই খবর দেখে কার না চিত্ত বিচলিত হবে। একদিকে স্টার্টআপ মানে নতুন উদ্যোগ/নতুন ব্যবসার আশাপ্রদ খবর, অন্যদিকে কর্মচ্যুতি চাকরিচ্যুতির বেদনাদায়ক খবর। বস্তুত যত না স্টার্টআপ-এর খবর পড়ি তার চেয়ে শতগুণে, হাজার গুণে শুনি কর্মচ্যুতি চাকরিচ্যুতির খবর। এসবের পাশাপাশি রয়েছে চিরন্তন সমস্যা বেকার সমস্যা। আর এখন তো ভালো খবর কোথাও নেই।

কভিড-১৯-এর মারাত্মক থাবা সবকিছু আবার লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছে। আমদানি-রফতানি ব্যবসা, সাধারণ ব্যবসা, পর্যটন ব্যবসা, পরিবহন ব্যবসা, আবাসন ব্যবসা সবকিছুতে আবার মন্দা নেমে এসেছে। প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছে। হাসপাতালে রোগীর ঠাঁই নেই। সিট নেই। অক্সিজেন নেই। চারদিকে হাহাকার। এই দুঃসময়েও মানুষ জীবিকার তাগিদে সরকারি স্বাস্থ্যবিধি মানতে চাইছে না। অনেকেই মাস্ক পরতে চায় না। দোকান-ব্যবসা বন্ধ রাখতে চায় না। রাইডশেয়ারিংয়ের মোটরসাইকেল রাস্তায় থাকতে চায়। এক অভাবনীয় পরিস্থিতি, জীবন জীবিকা বাঁচানোর সংগ্রাম। মানুষের চোখে-মুখে অন্ধকার। কবে পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে, কেউ আমরা জানি না। এমন দিনে যখন শোনা যায় বেসরকারি খাতের অনেক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, কোম্পানি, বড় বড় গ্রুপ চাকরিচ্যুতি ঘটাচ্ছে, চাকরিচ্যুতির পরিকল্পনা করছে তখন মনটা দুঃখে ভারাক্রান্ত না হয়ে পারে না। আবার যখন খবর পাই প্রতিবেশী দেশে এমন বড় বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়ী গ্রুপ আছে যারা কর্মচারী-কর্মকর্তাদের আশ্বস্ত করেছে যে কারো চাকরি যাবে না। অনেক ধনকুবের শত শত, হাজার হাজার কোটি টাকা করোনার বিরুদ্ধে সংগ্রামে দান করছে। টাটা গ্রুপ, আজিম প্রেমজির কথা মুখে মুখে।

আমাদের দেশে কি এমন একটা চিত্র আমরা দেখতে পারতাম না। এখন একজন-দুজন বড় ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, শিল্প গ্রুপ কি কর্মচারী-কর্মকর্তাদের আশ্বস্ত করতে পারত না যে কোনো ভয় নেই, কারো চাকরি যাবে না। হতে পারে তা পুরো বেতনে, হতে পারে তা একটু কম বেতনে। দুঃসময়ে তো মানুষ তা- করে। বস্তুত আমাদের দেশের ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের ইতিহাস কিন্তু রকমই ছিল। আমরা ছোটবেলায়, ছাত্রজীবনে দেখেছি বড় বড় ব্যবসায়ী, মোকামের মালিকরা কী আপনজনের মতো তাদের কর্মচারীদের ভরণপোষণ করত। যেন একটি পরিবার। কর্মচারীর সুখে-দুঃখে মহাজন-বড় ব্যবসায়ীরা থাকতেন। বিপদে-আপদে সাহায্য করতেন। কর্মচারীর অসুস্থ অবস্থায় চিকিৎসা করাতেন। ছেলেমেয়েদের স্কুল-কলেজের বেতনের ব্যবস্থা করে দিতেন। ডজন ডজন কর্মচারী তাদের দোকানে, মোকামে কাজ করত। সারা জীবনের চাকরি। লাইফ লং জব কর্মচারীরাও মালিকের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত থাকত। মালিকের ক্ষতি হোক এমন কোনো কাজে তারা জড়িত হতো না। বস্তুত এটাই ছিল আমাদের অঞ্চলের প্রাচীন ব্যবসায়ী নীতি, ব্যবস্থাপনা নীতি।

ব্যবসা একটি পরিবার। নীতি-আদর্শ স্বাধীনতার পরও আমরা দেখেছি। ১৯৮২-৮৩ সালের দিকে যখন আমাদের দেশে বেসরকারি খাতের নবযাত্রা হয় তখনো বড় বড় ব্যবসায়ী-উদীয়মান শিল্পপতিদের মধ্যে প্রাচ্যের ব্যবস্থাপনা নীতির উপস্থিতি লক্ষ করেছি। ওই সময়ে বেসরকারি খাতে ব্যাংক, বীমা, লিজিং কোম্পানির অনুমতি দেয়া হয়। তখন দেশে এসব প্রতিষ্ঠান সব সরকারি খাতে। নব উদ্যোগে যেসব ব্যবসায়ী শিল্পপতি ব্যবসা-শিল্প ব্যাংক-বীমা ইত্যাদি শুরু করেন তারা সরকারি খাত থেকে একদল তরুণকে আকর্ষিত করেন। ভালো ভালো বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তারা এদের বেসরকারি খাতে সম্পৃক্ত করেন। ওই একই নীতিব্যবসাপ্রতিষ্ঠান একটি পরিবার যেমন ছিল জাপানে। জাপানের ব্যবসায় কারো চাকরি যেত না। লাইফ লং এমপ্লয়মেন্ট। পশ্চিমা ব্যবস্থাপনা রীতি-নীতি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। বিষয় খুব দরদ দিয়ে আমাদের পড়াতেন . আবদুল্লাহ ফারুক। যিনি ছিলেন ১৯৬৫-৬৮ সালের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য বিভাগের প্রধান। তিনি পড়াতেন চারটা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ইতিহাস: যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সোভিয়েত ইউনিয়ন জাপান। জাপানের ব্যবস্থাপনা, নিয়ন্ত্রণ, পরিকল্পনা, রীতি-নীতি-বিধি যে সম্পূর্ণ আলাদা ছিল তা আমরা পরিষ্কার বুঝতাম। বস্তুত এটাই এশীয় অঞ্চলের ঐতিহ্য নীতি ছিল, প্রাচীন মধ্যযুগীয় এবং ব্রিটিশ আমলের ঐতিহ্য। সম্পূর্ণ ভিন্ন আলাদা নীতি-আদর্শ অনুসরণ করে জাপান দুনিয়ার দ্বিতীয় উন্নত দেশে পরিণত হয়।

ঘটনাক্রমে আমাদের বেসরকারি খাতও ছিল ওই নীতির অনুসারী। ১৯৮২-৮৩ সালের দিকে বড় বড় ব্যবসায়ী কর্মচারী-কর্মীদের আপনজন মনে করতেন। কারো পেটে লাথি মারার নীতি তাদের ছিল না। এমন অনেক প্রতিষ্ঠানের কথা জানি, যেখানে অসহায় মেয়ে, বিধবা মহিলাদের চাকরি দেয়া হতো এবং দেখা যেত তারা মনপ্রাণ দিয়ে কাজ করছেন। বস্তুত আজকের যে বেসরকারি খাত তা ব্যাংকারদের অবদান বললে ভুল হবে না। বড় বড় গ্রুপ ব্যাংকের ফাইন্যান্সেই গড়ে উঠেছে। উদ্যোগে বেসরকারি খাতের কর্মী-কর্মচারীরা মালিকদের জন্য মনপ্রাণ দিয়ে অবদান রেখেছেন। মালিকরাও কর্মচারীদের সুযোগ-সুবিধা দিতে কার্পণ্য করতেন না। কর্মচারী হাসপাতালে গেলে মালিকরা হাসপাতালে যেতেন। কারো অবসর গ্রহণের সময় তার সঙ্গে হাত মেলাতে আসতেন। কেউ কোনো বিপদে পড়লে তারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন। কোনো কর্মচারী-কর্মকর্তা ভুলেও ভাবতে পারতেন না যে তার চাকরিচ্যুতি ঘটতে পারে। এমন বেসরকারি ব্যাংক, বীমা, লিজিং কোম্পানি বড় বড় প্রাইভেট কোম্পানি ছিল যেখানে অবসরপ্রাপ্ত কর্মী-কর্মচারীদের ছেলেমেয়েদের চাকরির ব্যবস্থা হতো। জীবনে-মরণে মালিকরা থাকতেন কর্মচারী-কর্মীর পাশে। বস্তুত এভাবেই গড়ে তুলেছেন প্রথম প্রজন্মের ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে। তারা আজ ধীরে ধীরে অবসর নিচ্ছেন। অনেকেই এরই মধ্যে প্রয়াত হয়েছেন। কেউ কেউ অসুস্থ। দ্বিতীয় প্রজন্ম, তৃতীয় প্রজন্ম এখন ধীরে ধীরে ব্যবস্থাপনার হাল ধরছে। তাদের অনেকের মধ্যেই প্রাচ্য রীতি-নীতি, ঐতিহ্যের কোনো ধারাবাহিকতা নেই।

জাপান ম্রিয়মাণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনো নম্বর অর্থনীতিপৃথিবীর সবচেয়ে সফল দেশ। সফলকে সবাই অনুসরণ করে। সফল ক্রিকেটার কীভাবে চুল কাটে তা অনুসরণ করে যুবকরা। দেখা যায় হয়তো কারণেই আমাদের দেশে ব্যবস্থাপনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপীয় দেশগুলোকে অনুসরণ করার একটা প্রতিযোগিতা লেগেছে। কোম্পানির লাভপ্রদতা বাড়ানোর অন্যতম পন্থা তাদের কাছে কর্মী ছাঁটাই। শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত করা। দরকার হলে যেখানে শ্রমিকের মজুরি সর্বনিম্ন সেখানে চলে যাওয়া। আর একটি গুণ বা দোষ হচ্ছে রাষ্ট্রকে যত কম কর দেয়া যায় তা খুঁজে বের করা। কর না দেয়ার জন্য তারা ট্যাক্স হ্যাভেন নামে খ্যাত দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোতে চলে যায়। তাদের কাছে স্থায়ী চাকরি বলতে কিছু নেই। হায়ার অ্যান্ড ফায়ার হচ্ছে তাদের নীতি। তবে বিদায়ের সময় তারা ক্ষতিপূরণ দেয়ার চেষ্টা করে। এছাড়া রয়েছে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য। বেকার চাকরিচ্যুতদের জন্য রয়েছে ভাতা। আমাদের দেশে ইউরোপ আমেরিকান ব্যবস্থাপনা নীতি অনুসরণের একটা বড় ঝোঁক দেখা দিয়েছে। হায়ার অ্যান্ড ফায়ার নীতি অনেক ক্ষেত্রে অনুসরিত হচ্ছে এবং তা করছে দ্বিতীয়, তৃতীয় প্রজন্মের মালিকরা। তারা বিশাল সম্পত্তি সম্পদ শিল্প ব্যবসা বিনা পরিশ্রমে বিনা মেধায় পেয়েছেন। কেউ কেউ প্রশিক্ষিত, অনেকেই প্রশিক্ষিত নয়। অনেক ক্ষেত্রে উত্তরসূরি ছেলেমেয়েদের মধ্যে রয়েছে ভাগ-বাটোয়ারার সমস্যা।

এদিকে চাকরিচ্যুতি ঘটলে কিন্তু সরকারের ভাতার কোনো ব্যবস্থা নেই। বেকার ভাতাও নেই। মালিকরাও পশ্চিমাদের মতো যথাযথ পরিমাণের ক্ষতিপূরণ দেয় না। অথচ এক শ্রেণীর নতুন প্রজন্মের মালিকের মধ্যে চাকরিচ্যুতি ঘটানোর দিকে ঝোঁক লক্ষ করা যাচ্ছে। তারা লাইফ লংয়ে বিশ্বাস করে না। কোম্পানির লাভ বাড়ানোর পন্থা হিসেবে ছাঁটাইকেই একমাত্র পথ মনে করে। আর তারা নির্ভর করতে চায় সরকারি আনুকূল্যের ওপর। ঋণের ওপর সুদ নেই, সুদ ভর্তুকি ইত্যাদি তাদের দাবি। তাদের অনেকেই কোনো কর দিতে আগ্রহী নন। প্রাইভেট কোম্পানিকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি করতে তারা অনাগ্রহী। তারা তাদের সম্পদ কোনোভাবেই ভাগ করতে চান না। শ্রমিকদের কম বেতন দেয়া, চাকরিচ্যুতি ঘটানো ইত্যাদিকেই তারা শ্রেয় মনে করেন। সবার ক্ষেত্রে তা সমানভাবে প্রযোজ্য কথা বলা যাবে না। কিন্তু সাধারণ প্রবণতা তাই বলে মনে করাই যায়। অর্থাৎ আমাদের ব্যবসায়িক রীতি-নীতি, ব্যবস্থাপনা রীতি-নীতিতে একটা আমূল পরিবর্তনের মধ্যে নিপতিত। এর নির্মম শিকার মধ্যবিত্ত শিক্ষিত যুবক-যুবতীরা। অনেকেই মধ্য বয়সে রাস্তায়। ছেলেমেয়ের লেখাপড়া বন্ধ। চোখেমুখে অন্ধকার। অথচ মালিকরা লোকসানে নেই। করোনার মধ্যেই পৃথিবীর তাবৎ ধনীর মতো তাদেরও বেশির ভাগের সম্পদ-সম্পত্তির পরিমাণ বেড়েছে বলে কাগজে দেখেছি।

পরিস্থিতিতে সরকারি চাকরি লোভনীয় আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। একবার চাকরিতে ঢুকতে পারলে তা আর যাওয়ার কোনো উপায় নেই। পদোন্নতি প্রায় নিয়মিত, বেতন বৃদ্ধি নিশ্চিত। আগে বেসরকারি খাতের বেতন-ভাতা সুযোগ-সুবিধার তুলনায় সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা সুযোগ-সুবিধা অনেক কম ছিল। এখন আর তা এতটা সত্য নয়। চাকরি থাকার নিশ্চয়তা শতভাগ। অবসরের পর অবসর ভাতা। নিজে জীবিত থাকা অবস্থায় তো পাওয়া যাবেই মৃত্যুর পর স্ত্রী ছেলেমেয়েরাও তা পাবে। ১৯৮২-৮৩ সালের দিকে পরিস্থিতিটা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। তখন বেসরকারি খাতের চাকরি ছিল আকর্ষণীয় লোভনীয়। আজ সরকারি চাকরিই সবার একমাত্র লক্ষ্য। চাকরি করলে সরকারি চাকরিই করতে হবে যেকোনোভাবে। চাকরিতে ভবিষ্য তহবিলে সুদ বেশি, তাদের সঞ্চয়পত্রের সুদ বেশি। এসব কোনো ঈর্ষার বিষয় নয়, বাস্তবতা। তুলনামূলক অবস্থা। কিন্তু বেসরকারি খাতের প্রতি মধ্যবিত্ত শিক্ষিত যুবক-যুবতীর দৃষ্টিভঙ্গি এবং সরকারি চাকরির প্রতি আকর্ষণ শেষ পর্যন্ত কী ফল বয়ে আনবে তা- দেখার বিষয়।

 

. আর এম  দেবনাথ: অর্থনৈতিক বিশ্লেষক

সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন