পঞ্চগড়-ঢাকা সবজি ট্রেন চালু, কেজিপ্রতি ব্যয় পড়বে দেড় টাকা

কৃষক ও ভোক্তার স্বার্থে দেশব্যাপী এ সেবার বিস্তৃতি ঘটুক

১৯৭০-এর দশকে বাংলাদেশে কৃষিপণ্য পরিবহনে অন্যতম বাহন ছিল রেলপথ। সে সময় কাঁচা পাট, তুলা, ডাল, মসলা, তেলবীজ, গম, অন্যান্য খাদ্যশস্য, লবণ, চিনি, আখ, চা, উদ্ভিজ্জ তেলসহ বিভিন্ন ধরনের কৃষিপণ্য পরিবহন করা হতো রেলে। কালের পরিক্রমায় বর্তমানে ট্রেনে কৃষিপণ্য পরিবহন শূন্যের কোটায়। বাংলাদেশ রেলওয়ে আবার পণ্য পরিবহনে ঘুরে দাঁড়াতে চায়। সেজন্য প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ আগ্রহে ২০১৯ সাল থেকে পণ্য পরিবহনে লাগেজ ভ্যান ক্রয় রেলে তা সংযোজন এবং লাগেজ রেল চালুসহ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন। এরই আওতায় সম্প্রতি কৃষিজাত পণ্য পার্সেল পরিবহনের সুবিধার্থে বাংলাদেশ রেলওয়ে পঞ্চগড়-ঢাকা রুটে সবজি ট্রেন সার্ভিস চালু করেছে। খবরে প্রকাশ, সারা দেশ থেকে কৃষিপণ্য পরিবহনের সুযোগ করে দিতেই প্রতিটি প্যাসেঞ্জার ট্রেনে অতিরিক্ত লাগেজ ভ্যান লাগানো হবে, যেন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কৃষিপণ্য ঢাকায় আসতে পারে। সারা দেশ থেকে আসা এসব কৃষিপণ্যের প্রধান গন্তব্য হবে তেজগাঁও রেলস্টেশন।

ব্যয়সাশ্রয়ী হওয়ায় বিশ্বে পণ্য পরিবহনে রেল জনপ্রিয় মাধ্যম হিসেবে গড়ে উঠেছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে কৃষিপণ্য পরিবহনে কৃষাণ রেল পরিসেবা রয়েছে। ব্যয় কমাতে তাদের কল-কারখানা থেকে শুরু করে সব শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে রেলস্টেশনগুলোকে কেন্দ্র করে। কৃষাণ রেল ট্রেন চালানোর প্রাথমিক লক্ষ্য হলো উৎপাদন কেন্দ্রগুলো বাজার ভোগ কেন্দ্রের সঙ্গে সংযুক্ত করে কৃষিক্ষেত্রের আয় বৃদ্ধি করা। এর মুখ্য উদ্দেশ্য হলো মাল্টি-কমোডিটি, মাল্টি-কনসাইনার বা কনসেইনি, মাল্টি-লোডিং আনলোডিং পরিবহন পণ্য, যা কৃষককে বিস্তৃত বাজার সরবরাহের সুবিধা প্রদান করে। কৃষাণ রেলের ট্রেনগুলো সময় মেনে চালিত করা হয় এবং কোনো পথে চলমান অবরুদ্ধকরণ এবং বিলম্ব এড়াতে তাদের নিয়মানুবর্তিতা কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়। কৃষাণ রেল ট্রেনগুলোর মাধ্যমে বুকড পণ্যদ্রব্যগুলোকে পার্সেল শুল্কের পি-স্কেলে চার্জ করা হয়। অপারেশন গ্রিনস-এর অধীনে খাদ্য প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রিজ মন্ত্রকের টোটাল স্কিমের শীর্ষে কৃষাণ রেলের মাধ্যমে ফল সবজি পরিবহনে ৫০ শতাংশ অনুদান দেয় ভারত সরকার। ভর্তুকি বুকিংয়ের সময়, কৃষকদের কাছে পুরোপুরি মঞ্জুরি দেয়া হয়, যাতে কোনো প্রকার ঝামেলা বা পদ্ধতিগত বিলম্ব ছাড়াই কৃষকরা সুবিধাটি পান। ভারতের অনুকরণে বাংলাদেশেও সবজি পরিবহনে কয়েকটি বিশেষ রেল চালু এখন সময়ের দাবি। এতে পরিবহন ব্যয় কমে আসবে। পাশাপাশি আধুনিক লাগেজ ভ্যান যুক্ত করার মাধ্যমে সবজির অপচয়ও রোধের চিন্তাভাবনা করা যেতে পারে। একই সঙ্গে যাত্রীবাহী রেলের সঙ্গে সবজি পণ্য পরিবহনের জন্য লাগেজ ভ্যান সংযোজনের উদ্যোগের দ্রুত বাস্তবায়নও প্রয়োজন।

ট্রেনে খরচ কম হলেও ট্রাকের বদলে ট্রেনে সবজির মতো পণ্য পরিবহনে ঝক্কি বেশি। স্টেশনে সবজি নেয়া, ট্রেনে ওঠানো-নামানো, স্টেশনে কুলি সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য সামলানো, সময়মতো পণ্য ভোক্তার গন্তব্যে পৌঁছানোর জটিলতা প্রভৃতি বেশি পীড়া দেয়। সবচেয়ে বড় কথা হলো, বারবার ওঠানো-নামানো হলে সবজির গুণগত মান বিনষ্ট হতে পারে। ট্রাকে সবজি না এনে ট্রেনে আনলে যে খরচ বাঁচবে, বারবার ওঠানো-নামানোর কারণে সবজি নষ্ট হলে সেই সাশ্রয় আর ফলদায়ক হবে না। এছাড়া কুলিদের দৌরাত্ম্য বড় সমস্যা। আধুনিক পদ্ধতি অনুসরণ করে ট্রেনে সবজি ওঠানো এবং ট্রেন থেকে তা নামানোর ব্যবস্থা করা গেলে কৃষক ব্যবসায়ীদের জন্য কাজে লাগবে। এছাড়া কুলিরা যাতে সিন্ডিকেট করে কোনো ঝামেলা করতে না পারেন, সেদিকে সরকারের নজরদারি বাড়ানো দরকার। যেহেতু সঠিক সময়ে বাজার ধরতে পারাটা কৃষকদের কাছে সবচেয়ে জরুরি বিষয়, সুতরাং সময়ের বিষয়টিকেই রেল কর্তৃপক্ষের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। দেশব্যাপী ব্যয়সাশ্রয়ী সেবার বিস্তৃতি ঘটাতে রেল কর্তৃপক্ষ যথাযথ উদ্যোগ নেবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।

নির্দিষ্ট স্টেশনে পণ্য পরিবহনের জন্য আলাদা লাগেজ ভ্যান সংযোজন সংরক্ষণ করা, স্টেশনে লাগেজ বা পার্সেল পরিবহনের জন্য ওজন যন্ত্র এবং লম্বা লরি ভ্যান সরবরাহ, দেশের বড় বড় কৃষি প্রক্রিয়াকরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান শিল্প গ্রুপের সঙ্গে পণ্য পরিবহনে রেলওয়ে চুক্তি সম্পাদন করা, সর্বোচ্চ পণ্য পরিবহনকারী ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা এবং স্টেশনকে পুরস্কার দেয়া, আগের মতো আন্তঃনগর ট্রেনেও পরীক্ষামূলকভাবে একটি করে লাগেজ ভ্যান সংযোজন করার মতো পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। খবর মিলছে, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের অর্থায়নে ৫০টি ব্রডগেজ ৭৫টি মিটারগেজ লাগেজ ভ্যান সংগ্রহের জন্য চুক্তি হয়েছে। চীন থেকে ক্রয়ের জন্য প্রক্রিয়াধীন এসব লাগেজ ভ্যান আগামী দুই বছরের মধ্যে রেলের বহরে পর্যায়ক্রমে যুক্ত হবে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত লাগেজ ভ্যান যুক্ত হলে সারা দেশের দ্রুত পচনশীল কৃষিপণ্য (দুধ, মাছ, দুগ্ধজাতীয় পণ্য) পরিবহন সহজতর হবে। এসব লাগেজ ভ্যানের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে বিভিন্ন সংস্থা ব্যবসায়ী সমিতির সঙ্গে আলোচনা করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষকের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতে অন্যতম প্রধান পরিবহন রেল। রেলের সাহায্যে ধান, গম, চাল, পাট, তামাক, আখ ইত্যাদি কৃষিজাত পণ্য এবং সার-কীটনাশক, কৃষি সরঞ্জাম এক স্থান থেকে অন্য স্থানে আনা-নেয়া করা গেলে ভোক্তা কৃষক উভয়ই লাভবান হতে পারেন। এতে পরিবহন খরচ কম থাকায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যও মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা সম্ভব। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হবে। তখন মানুষ এবং পণ্য পরিবহনে যে পরিমাণ ট্রাফিক ভলিউম বাড়বে, তা সামাল দেয়ার মতো ক্ষমতা বাংলাদেশের নেই। এক্ষেত্রে রেলকেন্দ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থাই একমাত্র সমাধান। দেশের বিভিন্ন স্থানে আইসিডি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা, ট্রান্স-এশিয়ান রেলরুটে পণ্য পরিবহনের ব্যবস্থা করা, স্টেশনগুলোয় পণ্যবাহী গাড়ি লোড আনলোড করার জন্য জায়গার ব্যবস্থা করা এবং সর্বোপরি পণ্য লোডিং-আনলোডিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে রেলের আয় বৃদ্ধিতে পদক্ষেপ নিতে হবে। সবজি পরিবহনে রেলে ফ্রিজিং সেবা চালু করা আবশ্যক। না হলে অধিক দূরত্বের পথ অতিক্রম করে পণ্য ঢাকায় আনতে গেলে পচে যাওয়ার শঙ্কা থাকবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন