অর্থশাস্ত্রে ‘লেট ক্যাপিটালিজম’ টার্মটির উদ্ভাবনের জন্য পশ্চিমা বিশ্বে আলোচিত হয়ে আছেন জার্মান অর্থনীতিবিদ ও সমাজতাত্ত্বিক ওয়ার্নার সোমবার্ট (১৮৬৩-১৯৪১)। সোমবার্ট তার ‘Der Moderne Kapitalismus’ বইয়ে পুঁজি অর্থনীতির সময়কালকে চারটি অধ্যায়ে বিভাজন করে গেছেন।
তার মতে, ১৫০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ছিল প্রোটো-ক্যাপিটালিস্ট সমাজ বা পুঁজি অর্থনীতিতে প্রবেশে সূচনার অধ্যায়। ১৫০০ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ ছিল পুঁজি অর্থনীতির শৈশব-কৈশোর। ১৮০০ সাল থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত সময়কালকে বলা হয়েছে ক্যাপিটালিজমের ‘Heydays’, অর্থাৎ পরিপূর্ণ যৌবনের কাল। সোমবার্টের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময় থেকে এখন পর্যন্ত চলছে ‘লেট ক্যাপিটালিজম’-এর অধ্যায়। অর্থাত্ পৃথিবী এখনো লেট ক্যাপিটালিজমের সময়কালেই আছে।
কিন্তু লেট ক্যাপিটালিজমের চলমান এই দীর্ঘ সময়কালে কথিত উন্নতি, সমৃদ্ধি ও ভোগের মোহে মানুষ ক্রমে পৃথিবীর কল্যাণ থেকে দূরে সরে গেছে এবং মানুষে মানুষে বৈষম্য বাড়িয়েছে তীব্রভাবে।
তবে ক্যাপিটালিজমের এ সময়ের চালিকাশক্তিগুলো অর্থাত্ প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি পুঁজির ধারকরা কৌশলগতভাবে সাধারণ মানুষকে বা পৃথিবীর বেশির ভাগ জনগোষ্ঠীকেই ব্যক্তিগত লাভ অর্জনের মোহের মধ্যে বা একটা ধোঁয়াশার মধ্যে রেখে দিতে সক্ষম হয়েছে। মানুষেরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম পার করে দিচ্ছে, তবু বুঝতে পারছে না এ পুঁজি অর্থনীতির বিকাশ তাদের কোনো কল্যাণে আসেনি, আসবে না। লাভের জন্য যে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান, সবটাই পুঁজির মালিকদেরই স্বার্থে—এ সহজ সমীকরণে না গিয়েই পৃথিবীর বৃহত্ জনগোষ্ঠীর শ্রম, মেধা, জীবন ফুরিয়ে যায়।
পুঁজি অর্থনীতির মৌল ধারণা ঠিক রেখে এর প্রায়োগিক কৌশল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে এবং হয়ে চলেছে। এ পরিবর্তনও পুঁজির মালিকদের ভোগ-বিলাসিতার ক্রমাগত লাগামহীন চাহিদাকে কেন্দ্র করেই। অর্থাত্ পুঁজির মালিকদের জীবনযাপনে আকাশচুম্বী লাক্সারির জোগানও এ অর্থ ব্যবস্থা থেকেই মেটাতে হচ্ছে। লাক্সারির পরিবর্তনশীল ঊর্ধ্বমুখী চাহিদা সম্পর্কেও ওয়ার্নার সোমবার্ট তার ‘Luxury on Capitalism’ গ্রন্থে বলে গেছেন এবং এই সর্বনাশা চাহিদাও যে ক্যাপিটালিজমকে টিকিয়ে রাখতে ভূমিকা রাখছে, সেটিও গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে গেছেন।
ক্ষয়িষ্ণু সামন্তবাদী বুর্জোয়া অর্থনীতিতে মানুষকে অন্তত বোঝানো গেছে পুঁজির বিনিয়োগকারীরা ধনিক শ্রেণী। রাজনৈতিক বিবেচনায় এরা শোষক শ্রেণী, শাসককুলও এদেরই শ্রেণীভুক্ত। শ্রমিক-কৃষক-সাধারণ খেটে খাওয়া অধিকাংশ মানুষ সেইসব ধনিক শ্রেণীর দ্বারা শোষিত হচ্ছে। সমাজতন্ত্রের প্রবক্তারা এ শ্রেণীবিভাজন সফলভাবে স্পষ্ট করতে পেরেছিলেন। এই বৃহত্ শ্রেণীর বঞ্চিত মানুষ নিজেদের শোষিত ‘প্রলেতারিয়েত’ হিসেবে চিহ্নিত করতে পেরেছিল। ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, কিউবাসহ বেশকিছু দেশে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল।
লেট ক্যাপিটালিজমের বর্তমান অধ্যায়ে ধনিক শ্রেণী আরো বেপরোয়া হয়েছে। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উত্কর্ষে তাদের জীবনমান আরো লাক্সারিতে ভরপুর হয়েছে। পৃথিবীর ৯০ শতাংশের অধিক সম্পদ তাদেরই কুক্ষিগত।
তবু এ সময়ে সমস্যার জায়গাটা তৈরি হয়েছে অনেকাংশেই ভিন্নতরভাবে। এখন আর অধিকাংশ মানুষ নিজেদের শোষিত মনে করে না। প্রতিটি মানুষ নিজের মতো করে ভাবে—তারও হয়তোবা ধনী হওয়ার সুযোগ এ ব্যবস্থার মধ্যেই রয়ে গেছে। লাক্সারি তাকেও হাতছানি দেয়। পুঁজি অর্থনীতির কুশীলবরা কৌশলে এটি করতে সক্ষম হয়েছে। সারা বিশ্বে করপোরেট বা কোম্পানিগুলোর বেতনভুক্ত সিইও-কর্মকর্তা-কর্মচারী বা সমাজের অন্য সব শ্রেণী-পেশার মানুষ, যেমন বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, চিকিত্সক, লেখক, গবেষক, শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ, সংবাদকর্মী, ব্যাংকার, সাধারণ শ্রমিক, কৃষক, প্রান্তিক মানুষসহ সবাই ক্যাপিটালিজমের এই সুচতুর প্রয়োগের শিকার হয়ে গেছে। ব্যক্তির স্বার্থ বা ব্যক্তির ভালো থাকার মোহ মানুষের উপলব্ধির জায়গাটাও সরিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। রাষ্ট্রগুলোয় বৃহত্ পুঁজির মালিকদের কাছে অন্য সব মানুষ আত্মসমর্পিত বা সহায়ক শক্তি হিসেবে লাগাতার শ্রম-মেধা ব্যয় করে যাচ্ছে। এ মানুষগুলোর জীবনযাপনের ‘ফলস স্ট্যান্ডার্ড’ দেখলে আপাত মনে হবে সব ঠিকই আছে। কিন্তু কিছু ব্যতিক্রম বাদে সারা পৃথিবীতেই তাদের মূলত জীবিকার স্থায়ী নিশ্চয়তা নেই; মানবিক মর্যাদা-মানবাধিকার সীমিত বা নেই; বাসস্থান, চিকিত্সা, শিক্ষার সুব্যবস্থা অনিশ্চিত; ভবিষ্যত্ অরক্ষিত এবং আরো অনেক বৈষম্য তাদের ক্ষেত্রে বিরাজমান। কিন্তু এ মানুষগুলো এটা বুঝে উঠতে পারে না সবকিছু পুঁজি অর্থনীতি টিকিয়ে রাখার স্বার্থে হয়ে চলেছে তাদেরই অবদানে। আধুনিক সমাজতাত্ত্বিকরা এ ‘ফলস স্ট্যান্ডার্ড’-এর বৃহত্ জনগোষ্ঠীকে ‘প্রেকারিয়েত’ হিসেবে নামকরণ করেছেন। মুনাফার জন্য যে বিনিয়োগ, সে বিনিয়োগের লাভের অংশীজন নয় এ প্রেকারিয়েত শ্রেণী। তবু তারা যেন সানন্দেই এর সঙ্গে ‘একাত্ম’ হয়ে গেছে।
ক্যাপিটালিজমের এই বিস্তৃত রূপ ভয়াবহ ও বিধ্বংসী হওয়া সত্ত্বেও বিশ্বজুডেই অধিকাংশ মানুষের বোধের অবনমনে বা বিভ্রমে সমাজে যে বিরাট প্রেকারিয়েত মনন তৈরি হয়েছে, সেটি বিপজ্জনক। দেশে দেশে মানুষে মানুষে বৈষম্য ও অসাম্য তীব্রতর হওয়া সত্ত্বেও ভুক্তভোগীরাই যেন অনেকটা নির্লিপ্ত! ক্যাপিটালিজমের দুর্বিনীত প্রায়োগিক বাস্তবতায় পৃথিবীর সামগ্রিক দুর্দশা নিরসনে কার্যকরী উদ্যোগ-প্রতিবাদ নেই। পুঁজি অর্থনীতিকেন্দ্রিক চর্চিত গণতন্ত্র ও উন্নয়ন নীতিকৌশল বিশ্বের বেশির ভাগ জনগোষ্ঠীর জীবিকা ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনমানের নিশ্চয়তা বিধান করতে পারেনি, পারছে না—এটা সবাই এক রকম দর্শকের মতো দেখছে!
এরূপ পরিস্থিতির অবসান হওয়া দরকার। তত্ত্বগতভাবে দেখলে কিংবা মানুষের সভ্যতার ইতিহাসগত ক্রমবিবর্তন পর্যবেক্ষণ করলে পরিবর্তন হবেই বলা চলে।
সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স কাউন্সিল’ কর্তৃক সে দেশের প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে ‘গ্লোবাল ট্রেন্ডস ২০৪০’ শিরোনামের ১৪৪ পৃষ্ঠার একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন দিয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমসের সূত্রে প্রাপ্ত প্রতিবেদনটির কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ মোটামুটি এ রকম:
‘সামনে আরো প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এক পৃথিবী, যার ভবিষ্যত্ ধূসর, করুণ ও কঠিন। পৃথিবীর সব সমাজ বিপর্যয়কর ধাক্কার হুমকিতে! রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি আরো সংঘাতময় হবে। সরকার ও করপোরেটগুলো জীবন বাঁচানোর চেয়ে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ও মুনাফা বৃদ্ধিকেই গুরুত্ব দিচ্ছে। বিশ্বে সরকারগুলো ব্যবসা ও পুঁজির পক্ষ নিচ্ছে। বিশ্বের বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান ও সরকার মানুষের প্রত্যাশা হয়তো মেটাতে চাইছে না, নয়তো পারছে না। ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে বড় রাষ্ট্রের চাপে ছোট রাষ্ট্রের সংকুচিত হয়ে যাওয়া। দরিদ্র আরো দরিদ্র হচ্ছে। মধ্যবিত্ত নিচে নেমে যাচ্ছে।’
গত শতকের প্রারম্ভে অনেক দেশের বিপ্লব ও পরিবর্তন এই নিচে নেমে যাওয়া মধ্যবিত্তদের দরিদ্রদের কাতারে শামিল হয়ে যাওয়ার প্রতিক্রিয়ারও অংশ বটে।
জার্মান অর্থনীতিবিদ ওয়ার্নার সোমবার্টের লেখালেখিগুলোয় দেখা যায়, সমাজ বিবর্তনে মতবাদ ও তত্ত্বগতভাবে তিনি কার্ল মার্ক্স, সিগমুন্ড ফ্রয়েড, চার্লস ডারউইন প্রমুখের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। আবার তার লেখালেখির প্রতিফলন ঘটেছে কার্ল পলানি ও জোসেফ সুম্পিটারের দর্শনের মধ্যে।
আপাতভাবে মানুষ পথ ও পরিত্রাণ দেখতে পাচ্ছে না হয়তো। এসব মহান মানুষের মতবাদ ও দেখানো পথেই মানুষের মুক্তি ঘটবে। ক্যাপিটালিজমের পতন অনিবার্য। ধনিক শ্রেণীর লাক্সারি ধসে পড়বেই। প্রেকারিয়েতরা অর্থাত্ অধিকাংশ বঞ্চিত মানুষের বোধোদয় হবে। এই অচলায়তন ভাঙবেই।