উন্নয়নশীল দেশে চীনাদের প্রকল্প বাস্তবায়ন ও বাঁশখালী

রুহিনা ফেরদৌস

২০০৫ সালে জাম্বিয়ার চীনা মালিকানাধীন একটি কারখানায় বিস্ফোরণের ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন ৪৬ জন শ্রমিক পরের বছর ওই কারখানায় কর্মরত শ্রমিকরা বিক্ষোভে অংশ নিলে তাদের ওপর গুলি চালিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের অভিযোগ ছিল কাজের পরিস্থিতি জনৈক চীনা ব্যবস্থাপকের বিরুদ্ধে ঘটনার সূত্র ধরে পরবর্তী সময়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচও বিষয়টি নিয়ে কাজ করে সাংহাই ইফেক্টস নামে একটি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয় আফ্রিকার দেশগুলোয় চীনা মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর বাণিজ্য শ্রমিক সুরক্ষার ওপর ওই গবেষণা প্রতিবেদনে খুব একটা ইতিবাচক ফল আসেনি; বরং তুলনামূলক কম শ্রমিক সুরক্ষার বিষয়গুলো উঠে আসে

সহস্রাব্দ শুরুর পর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক দৃশ্যপটে নাটকীয় পরিবর্তন সূচিত হয়েছে, যার সূত্র ধরে স্বল্প মধ্যম আয়ের দেশগুলোও নিজেদের বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির গতিপথে পরিচালিত করতে উৎসাহী হয়ে ওঠে এর ধারাবাহিকতায় উন্নয়ন অর্থের নতুন নতুন উৎস আবির্ভূত হয় নতুন বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তাদের সক্ষমতা নিয়ে উন্নয়ন সহযোগিতার অংশ হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে নিজ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে এর মধ্যে  চীনা কোম্পানিগুলোর  কথা না বললেই নয়  আফ্রিকা থেকে এশিয়ার অনেক দেশে তারা কখনো যৌথ বা কখনো এককভাবে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যায়ে সম্পৃক্ত থাকার জন্য ব্যাপকভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে তবে উল্লিখিত গবেষণায় দেখা যায়, চীনের কোম্পানিগুলো আফ্রিকায় যেসব প্রকল্প পরিচালনা করেছে, সেখানে তারা শ্রমিক ইউনিয়নের সম্পৃক্ততাকে উৎসাহিত করতে ছিল গররাজি

এমনকি গবেষণা প্রতিবেদনে আরো দেখা গেছে, আফ্রিকার যেসব অঞ্চলে শ্রমিক ইউনিয়নগুলো খুব একটা সক্রিয় বা প্রভাবশালী নয়, চীনা সংস্থাগুলো  সেসব জায়গাগুলোকে প্রকল্পের জন্য বেছে  নিয়েছে 

আফ্রিকায় পরিচালিত চীনা সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে প্রায়ই আন্তর্জাতিক শ্রম মান লঙ্ঘন এবং জাতীয় শ্রম আইন না মেনে চলার স্পষ্ট অভিযোগ বিদ্যমান 

তবুও এপ্রিল কেন বাঁশখালীর শ্রমিক সাধারণ মানুষের জন্য মৃত্যুর মাস হয়ে উঠেছে প্রশ্নের উত্তর খোঁজা আজ জরুরি

পাঁচ বছর আগে ঠিক এই এপ্রিলে স্থানীয় গ্রামবাসীর সঙ্গে পুলিশের সংঘাতে ছয়জন নিহত হন সম্প্রতি এই এপ্রিলেই পুলিশের সঙ্গে সংর্ঘষে নিহত হয়েছেন পাঁচজন শ্রমিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের সূত্রমতে, গুলিতে আহত প্রায় ৩০ জন শ্রমিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন

যেন জাম্বিয়ার কয়লা খনি কিংবা কোনো কারখানার শ্রমিকদের ওপর চালানো নির্মমতার কথা মনে করিয়ে দেয়

চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে সংঘাত মৃত্যুর ঘটনার সূত্রপাত নির্মাণাধীন কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র ঘিরে বিদ্যুৎ খাতে বেসরকারি পর্যায়ে দেশের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ হচ্ছে বাঁশখালীর গণ্ডামারা ইউনিয়নে বঙ্গোপসাগরের তীরে কয়লাভিত্তিক এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে সেখানে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পে বাংলাদেশের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করছে চীনের প্রতিষ্ঠান সেপকো ইলেকট্রিক পাওয়ার কনস্ট্রাকশন করপোরেশন এইচটিজি গ্রুপ

প্রকল্পের শুরু থেকেই বিতর্কিত বাঁশখালী কিছুদিন পরপর এখানে কখনো সাধারণ গ্রামবাসী কখনোবা শ্রমিকদের সঙ্গে সংঘর্ষ-সংহাত বাধছে কেন্দ্রটি নিয়ে পরিবেশবাদী সচেতন মহলেরও নানা অভিযোগ যেমন রয়েছে, তেমনি এলাকাবাসীরও অসন্তোষ বিদ্যমান একটি প্রকল্প করতে গেলে স্থানীয় পরিবেশের ওপর এর প্রভাব ক্ষতির মাত্রা নিরূপণ করে সে সম্পর্কিত ব্যবস্থা গ্রহণপূর্বক কাজ শুরু করার যে প্রবিধান রয়েছে, পরিবেশবাদীদের দাবি বাঁশখালীর প্রকল্পে সেসব পাশ কাটিয়ে  যাওয়া হয়েছে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোম্পানিগুলোর প্রতি এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট বা পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা ছাড়াই আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়া শুরুর অভিযোগ বিদ্যমান তাছাড়া পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক হওয়ায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য তিন ধরনের ছাড়পত্রের প্রয়োজন পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা (১৯৯৫) অনুসারে, ধরনের প্রকল্প লাল তালিকাভুক্ত

প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকার বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য হাজার ৩০০ একর আয়তনের গণ্ডামারা ইউনিয়নের ৬০০ একর জমি কেনা হয়, যা পুরো ইউনিয়নের ১২ ভাগের এক ভাগ ২০১৬ সালে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জমি তৈরির কাজ দেয়া হয়েছিল এনএসএন কনসোর্টিয়াম নামের এক প্রতিষ্ঠানকে স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ পুনর্বাসনের সুযোগ না দিয়েই জমি কেনা হয়েছে এতে অনেকেই বসতবাড়ি, ভিটেমাটি হারিয়েছেন জমি কেনার ক্ষেত্রে অনেকের সঙ্গে জোরজবরদস্তিও চালানো হয়েছে আর এভাবে জমি দখলের ফলে বাঁশখালীর বড়ঘোনা এলাকার কৃষক, মাছচাষীসহ অনেকের বেকার হয়ে পড়ার কথাও শোনা যায় এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে

এবার আসা যাক কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রসঙ্গে, যেখানে দেশীয় শ্রমিকদের পাশাপাশি চীনা শ্রমিকও কাজ করেন বলার অপেক্ষা রাখে না যে দুটি দেশের শ্রমিকদের ভাষা, সংস্কৃতি, খাবার ধর্মীয় রীতি-নীতির ভিন্নতা রয়েছে তাছাড়া চীনা যে শ্রমিকরা এখানে কাজ করেন, অনুমান করে নেয়া যায় তারা আমাদের শ্রমিকদের তুলনায় খানিকটা দক্ষ দক্ষতাভেদে কাজের পরিশ্রমেরও তারতম্য বিদ্যমান দেখা যায় চীনা শ্রমিকটি হয়তো টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করছে, বিপরীতে ভারী মাল টানার মতো শারীরিক শ্রমের কাজগুলো তাকে দিয়ে করানো হচ্ছে স্থানীয় শ্রমিকদের দিয়ে ভিন্নতা রয়েছে বেতন-ভাতা, পারিশ্রমিক অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রেও আর বিষয়গুলো নিয়ে অসন্তোষ ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হচ্ছে যারা প্রকল্প পরিচালনার দায়িত্বে আছেন, এখানে তাদের সক্রিয়তা জরুরি শ্রমিকদের মধ্যে কোনো ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে কিনা, তা নিয়ে যেমন তাদের সঙ্গে আলোচনা বা কাউন্সেলিং জরুরি, তেমনি স্থানীয় শ্রমিকরা নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন কিনা, তাও দেখতে হবে

পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রেও দুই দেশের শ্রমিকদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়ানোর ঘটনা রয়েছে আমাদের শ্রমিকরা কেন তাদের সঙ্গে বারবার এমন সংঘর্ষে জড়াচ্ছেন, সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি এখানে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের অংশগ্রহণ তদারকির প্রয়োজন রয়েছে বলেই অনুমেয়

বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে চীনা, জাপানিসহ বিভিন্ন দেশের কর্মকর্তা শ্রমিকরা কাজ করেন  সেক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে যৌথ প্রকল্পগুলোয় দ্বন্দ্ব অসন্তোষের ঘটনা কেন ঘটছে, সেসব অনুসন্ধান জরুরি 

আফ্রিকা এবং বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে চীনের কার্যক্রম সম্পর্কে সাইলেন্ট আর্মি নামে অনুসন্ধানী বই লিখেছেন স্পেনের সাংবাদিক লেখকদ্বয় হুয়ান পাবলো হেরিবার্তো আরাউজো সেখানে তারা উল্লেখ করেন, আফ্রিকার চীনা ব্যবসায়ীদের সাধারণ প্রবণতা হচ্ছে স্থানীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলোর প্রতি বিরুদ্ধ মনোভাব পোষণ করা তাছাড়া শ্রম অধিকার লঙ্ঘন, অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা, প্রতিকূল কর্মপরিবেশ, স্থানীয় শ্রমিকদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণসহ অন্যায্য শ্রমচর্চার বিষয়গুলো উঠে এসেছে তাদের লেখায়

হুয়ান হেরিবার্তো  অবশ্য  বাস্তবে আরো খারাপ অবস্থার কথা ইঙ্গিত দিয়েছেন ২০১০ সালে জাম্বিয়াতেই একটি কারখানায় স্বল্প বেতনের প্রতিবাদে শ্রমিকরা যখন আন্দোলন করেন তখন আন্দোলনকারী শ্রমিকদের ওপর চীনা নির্বাহীরা উন্মুক্ত গুলি চালিয়েছিলেন ঘটনাটি  ঘটে জাম্বিয়ার দক্ষিণ সিনাজংওয়ের একটি কয়লা খনিতে ঘটনায় আহত হন ১১ জন শ্রমিক

সম্প্রতি বাঁশখালীতে শ্রমিক বিক্ষোভের কারণ ছিল নির্ধারিত তারিখের মধ্যে বেতন পরিশোধ করাসহ চলমান রমজান মাস উপলক্ষে কর্মঘণ্টা ১০ থেকে কমিয়ে ৮ ঘণ্টা করা ও শুক্রবার জুমার নামাজ-পরবর্তী আবার কাজে যোগ না দেয়ার মতো বিষয়গুলো শ্রমিকদের দাবি নিয়ে আন্দোলনের বিপরীতে একপর্যায়ে পুলিশ তাদের হটাতে গুলি ছোড়ে

দেশে কেন শ্রমিক বিক্ষোভের পরিমাণ বাড়ছে? কেন নির্বিচারে শ্রমিকদের ওপর গুলি চালানোর ঘটনা ঘটছে? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি তাছাড়া প্রকল্পের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ থেকে শুরু করে শ্রমিকদের প্রতি আচরণ; কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের মতো মেগা প্রকল্পের ক্ষেত্রে কেন ধরনের অনিয়ম অসংগতি থাকবেপ্রশ্ন এটাও 

নিহত পাঁচ শ্রমিকের একজন রেজা, বয়স ১৮। মা তাকে শেষ বিদায় জানাচ্ছেন।
ছবি: তাকবির হুদা / ফেসবুক

লেখক: সাংবাদিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন