পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা ভেস্তে যাচ্ছে

নিজস্ব প্রতিবেদক

বড় পরিসরে ব্যবহারের সম্ভাবনা না থাকলেও বিপুল অর্থ ব্যয়ে পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছিল সরকার।  এজন্য প্রাথমিক বিনিয়োগ ছাড়াও অ্যাপ্রোচ চ্যানেলে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের প্রয়োজন পড়বে। পাশাপাশি চালিয়ে নিতে হবে নিয়মিত ড্রেজিংও। তবে অদূর ভবিষ্যতে বাণিজ্যিক সম্ভাবনা না থাকায় ড্রেজিংয়ে বিপুল অর্থ ব্যয়ের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা থেকে সরে আসছে সরকার।

বিষয়টি নিশ্চিত করে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, পায়রায় যে গভীর সমুদ্রবন্দর করার কথা ছিল সে সিদ্ধান্ত থেকে আমরা সরে এসেছি। এটা সমুদ্রবন্দর হিসেবেই থাকবে। গভীর সমুদ্রবন্দর হচ্ছে মাতারবাড়ীতে।

জানা গেছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গভীর সমুদ্রবন্দরগুলোয় কমপক্ষে ১৮ মিটার ড্রাফটের জাহাজ নোঙর করে। ২০২৫ সাল নাগাদ ২৫ মিটার ড্রাফটের জাহাজই প্রাধান্য পাবে অনেক বন্দরে। যদিও ধরনের জাহাজ চলাচলের জন্য যে গভীরতা প্রয়োজন তা নেই বাংলাদেশের কোনো সমুদ্রবন্দরেরই। পায়রা বন্দরের সর্বোচ্চ গভীরতা সক্ষমতা ১৪ মিটার। অঞ্চলের সবচেয়ে গভীর সমুদ্রবন্দর সিঙ্গাপুরের গভীরতা ২৪ দশমিক মিটার, যার ধারেকাছেই নেই পায়রা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পায়রা বন্দরের ১৪ মিটার গভীরতা চাইলে পুরো চ্যানেলটিতেই পরিমাণ গভীরতা লাগবে। কিন্তু পায়রা বন্দরে যেতে যে পথটি ব্যবহার করা হবে বা অ্যাপ্রোচ ওয়ে সেখানে প্রায় ৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত গভীরতা খুবই কম। সেখানে যে পরিমাণ খনন করতে হবে তা বছরব্যাপী বন্দরে জাহাজ প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করবে।

বন্দরটির মাস্টারপ্ল্যান তৈরির কাজ করছে নেদারল্যান্ডসের রয়েল হাসকনিং ডিএইচভি এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) গবেষণা, পরীক্ষা পরামর্শক ব্যুরো (বিআরটিসি) পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বিদ্যমান সমুদ্রবন্দর দুটির মধ্যে মোংলা বন্দরের সর্বোচ্চ গভীরতা সক্ষমতা মিটার, আর চট্টগ্রাম বন্দরের সর্বোচ্চ গভীরতা সক্ষমতা দশমিক মিটার। অন্যদিকে পায়রার গভীরতা সক্ষমতাও ১৪ মিটারের বেশি নয়, যা গভীর সমুদ্রবন্দর বিবেচনায় খুবই অপর্যাপ্ত। কারণ যে ড্রাফটের জাহাজ গভীর সমুদ্রবন্দরে চলাচল করে সেগুলো এসব বন্দরে ভিড়তেই পারবে না।

এদিকে, পায়রা বন্দরের বৈদেশিক বাণিজ্যের গতিশীলতা নিশ্চিতে চলতি বছরের জানুয়ারিতে রাবনাবাদ চ্যানেলের জরুরি মেইনটেন্যান্স ড্রেজিং কাজ শুরু হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ৪৩৭ কোটি টাকা অনুদানে ৭৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং ১০০-১২৫ মিটার প্রস্থবিশিষ্ট চ্যানেলের (ইনার আউটার চ্যানেল) প্রায় দশমিক ৭৫ মিলিয়ন ঘনমিটার পলি অপসারণ করা হবে।  রাবনাবাদ চ্যানেলে দশমিক মিটার গভীরতা বজায় রাখার লক্ষ্যে জরুরি রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং বেলজিয়ামভিত্তিক ড্রেজিং কোম্পানি ইয়ান ডে নুলের মধ্যে গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর এক চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হয়। দেড় বছরের মধ্যে ড্রেজিং প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত করার কথা রয়েছে।

জাপান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (জাইকা) মতে, এটি বাস্তবায়নে ব্যয় হবে বছরে আরো ৩০-৫০ কোটি ডলার। বিপুল অর্থ ব্যয়ের পরও খুবই সীমিত পরিসরে ব্যবহার হবে বন্দরটি। ২০৪১ সালে পায়রা বন্দর দিয়ে কনটেইনার পরিবহন হবে সাড়ে পাঁচ লাখ টিইইউএসেরও কম। অথচ চট্টগ্রাম বন্দরে বর্তমানেই বার্ষিক ২৮ লাখ টিইইউএস কনটেইনার পরিবহন হয়। আর ২০৪১ সালে তা বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ৬৯ লাখ টিইইউএস।

জাইকার প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, ২০২৬ সাল নাগাদ চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে কনটেইনার পরিবহন হবে ৩৪ লাখ হাজার টিইইউএস। ওই সময় পায়রা বন্দরের মাধ্যমে পরিবহন হবে মাত্র লাখ ৮০ হাজার ৫২৬ টিইইউএস। তিনটি আলাদা পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়েও সমীক্ষার তথ্যে সামগ্রিক চিত্রটি একই রকম দেখা যায়। এমনকি পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকবে ২০৪১ সাল নাগাদও। ২০৪১ সালে ৬৮ লাখ ৯৭ হাজার ১৭৯ টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিং করবে চট্টগ্রাম বন্দর। ওই সময় পায়রার মাধ্যমে মাত্র লাখ ৪৬ হাজার ২২৮ টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিং হবে।

উল্লেখ্য, দেশের ক্রমবর্ধমান ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের ফলে বন্দরের চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে ২০১৩ সালের ১৯ নভেম্বর পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলায় পায়রা সমুদ্রবন্দরের নির্মাণকাজ উদ্বোধন করা হয়। পায়রা বন্দরকে ঘিরে অর্থনৈতিক অঞ্চল, তৈরি পোশাক, ওষুধ শিল্প, সিমেন্ট, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মত্স্য প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল, সার কারখানা, তেল শোধনাগার জাহাজ নির্মাণ শিল্পসহ মোট ১৯টি কম্পোনেন্ট নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। পায়রা বন্দর উন্নয়নে মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনার আওতায় প্রথম টার্মিনাল নির্মাণ, রাবনাবাদ চ্যানেলের ক্যাপিটাল ড্রেজিং রক্ষণাবেক্ষণ, ড্রাইবাল্ক/ কোল টার্মিনাল নির্মাণ, ভারতীয় ঋণসহায়তায় মাল্টিপারপাস টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় ট্রান্সশিপমেন্ট কনটেইনার টার্মিনাল, ডিপ ওয়াটার কনটেইনার টার্মিনাল, অফসোর টার্মিনাল/ সাপ্লাইবেস, কোর পোর্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচার, নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন, হাউজিং এডুকেশন হেলথ ফ্যাসিলিটিজ, টাওয়েজ হারবার টাগস, ইন্টারনাল ফেরি টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে। অন্যান্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক বিমানবন্দর, পায়রা বন্দরের রেল সংযোগ, শিপইয়ার্ড শিপ মেরামত কার্যক্রম, লিকুইড বাল্ক টার্মিনাল, এলএনজি টার্মিনাল ইত্যাদি প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রয়েছে। পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নের জন্য প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই, পরিবেশ সামাজিক ক্ষেত্রে প্রভাব নিরূপণ, ক্রয় পরিকল্পনা ক্রয় প্রস্তাব প্রণয়নসহ গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্টগুলো বুয়েটের বিআরটিসির নেতৃত্বে রয়েল হাসকনিং ডিএইচবির সহায়তায় প্রণীত হবে। পোর্ট অপারেশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান এবং কৌশলগত ট্যারিফ প্ল্যান প্রণয়ন এবং গভীর সমুদ্রবন্দরে রূপান্তরের সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদন পাওয়া যাবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন