মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা প্রশমনের প্রত্যাশা

বাগদাদে গোপন আলোচনায় সৌদি আরব-ইরান

বণিক বার্তা ডেস্ক

কয়েক বছর ধরেই মারাত্মক অস্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক পরিবেশ। এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো ইরান সৌদি আরবের মধ্যকার বৈরী সম্পর্ক। দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের উন্নয়ন নিয়ে এতদিন খুব একটা আশাবাদী ছিলেন না পর্যবেক্ষকরা। তবে সাম্প্রতিক কিছু খবরে তারা নড়েচড়ে বসেছেন। আন্তর্জাতিক কয়েকটি গণমাধ্যম বলছে, দুই দেশই এখন নিজেদের মধ্যকার বৈরিতা প্রশমনে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। নিয়ে আলোচনাও হচ্ছে। আর এতে মধ্যস্থতা করছে মধ্যপ্রাচ্যেরই আরেক দেশ ইরাক। তবে ইরান বা সৌদি আরবের পক্ষ থেকে এখনো তথ্য পুরোপুরি স্বীকার করে নেয়া হয়নি।

প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, মূলত ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মুস্তাফা আল-কাজিমির উদ্যোগে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। ইরান সৌদি আরবের মধ্যকার আলোচনার খবরে আশাবাদী হয়ে উঠেছেন ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, আলোচনা সফল হলে দুই দেশের মধ্যকার বৈরিতা পুরোপুরি দূর হবে না হয়তো। তবে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা কিছুটা হলেও প্রশমন হবে। সেক্ষেত্রে মুস্তাফা আল-কাজিমির উদ্যোগটিকে বলা চলে অঞ্চলটিতে শান্তি ফিরিয়ে আনার পথে অনেক বড় এক পদক্ষেপ।

ইরান-সৌদি সম্পর্কে শীতলতা ছিল অনেক বছর ধরেই। তবে শীতলতা উত্তেজনামুখর বৈরিতায় রূপ নেয় পাঁচ বছর আগে। ওই সময় শিয়া ধর্মগুরু শেখ নিমর আল-নিমরের প্রাণদণ্ড কার্যকর করে রিয়াদ। বিষয়টিতে শুরু থেকেই ঘোর আপত্তি জানিয়েছে ইরান। তবে তাতে কর্ণপাত করেনি সৌদি আরব। নিমর আল-নিমরের শিরশ্ছেদের খবর ইরানে বেশ উত্তেজনা সৃষ্টি করে। উত্তেজিত জনগণ তেহরানে সৌদি দূতাবাসে হামলাও করে বসে। এর পর থেকেই দুই দেশ একে অন্যের সঙ্গে সব ধরনের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা দেয়।

সৌদি-ইরান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ইতিহাসে কূটনৈতিক টানাপড়েন নতুন কিছু নয়। ১৯২৬ সালে হেজাজ দখল করে নেয়ার মাধ্যমে আরব উপদ্বীপের বৃহদংশে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন আবদুলআজিজ ইবন সৌদ। এর তিন বছরের মাথায় কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে সৌদ বংশের শাসনকে স্বীকৃতি দেয় ইরান। তবে দুই দেশের মধ্যে প্রথম কূটনৈতিক সংকট দেখা দেয় ১৯৪৩ সালে। মিসরীয় হাজিদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে পবিত্র কাবাঘরের সম্মান নষ্ট করার অভিযোগে এক ইরানি হজযাত্রীকে মৃত্যুদণ্ড দেয় সৌদি আরব। বিষয়টি সে সময় ইরান, সৌদি আরব মিসরের মধ্যে কূটনৈতিক টানাপড়েন সৃষ্টি করে। এর তিন বছরের মাথায় ইরানের শাহকে এক চিঠি পাঠানোর মাধ্যমে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের প্রয়াস চালান ইবন সৌদ।

তবে ষাটের দশকের আগে সম্পর্ক ঠিক করা যায়নি। সে সময় সুন্নি শিয়া মতের বিরোধ দুই দেশের সম্পর্কে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অন্যদিকে ইরান ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়ার কারণে সম্পর্ক আরো খারাপের দিকে যায়। ১৯৬৬ সালে সৌদি বাদশা ফয়সালের আনুষ্ঠানিক ইরান সফরের মধ্য দিয়ে সম্পর্কের শীতলতা কাটতে শুরু করে। এর কিছুদিন পরে ইরানের শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভিও সৌদি আরব সফরে যান। এর মধ্য দিয়ে শুরু হয় দুই দেশের সম্পর্কের উষ্ণতম পর্যায়।

ওই সময় বাদশা ফয়সালের ইসলামিক ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস, মুসলিম ওয়ার্ল্ড লিগ, অর্গানাইজেশন অব দি ইসলামিক কনফারেন্স (ওআইসি) ইত্যাদি জোট গঠনের উদ্যোগ সরাসরি সমর্থন করেন ইরানের শাহ। ষাটের দশকের শেষ নাগাদ যুক্তরাজ্য পারস্য উপসাগর থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়। এরপর অনেকটা সমঝোতার ভিত্তিতেই মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা শান্তির রক্ষকের দায়িত্ব নেয় ইরান সৌদি আরব। সময় মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে নিজের মতো করে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন ইরানের শাহ। সৌদি আরব এর বিরোধিতা করলেও দুই দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় থাকে।

তবে ১৯৭৯ সালে ইরানে আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে সংগঠিত অভ্যুত্থানের পর সবকিছু বদলে যায়। ওই সময় ইরান প্রকাশ্যে সৌদ বংশের শাসনের আইনসিদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। ১৯৮৭ সালের হজ মৌসুমে ইরানি হাজিদের সঙ্গে সৌদি নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষ বেধে যায়। ওই ঘটনায় ইরানি অন্য দেশ থেকে আগত হজযাত্রী এবং সৌদি পুলিশ মিলিয়ে মোট ৪০২ জনের মৃত্যু হয়। এরপর খোমেনি ওয়াহাবিদের ধর্মদ্রোহী বলে ঘোষণা দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়, যা বজায় থাকে ১৯৯১ পর্যন্ত।

উপসাগরীয় যুদ্ধের পর দুই দেশের সম্পর্কে কিছুটা উন্নয়নের সম্ভাবনা দেখা দেয়। তবে তাও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। অন্যদিকে ২০০০ সালে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা সৌদি আরবে হামলা চালায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ইরান সমর্থিত বিদ্রোহী দলটির বিরুদ্ধে বড় মাত্রায় অভিযান শুরু করে সৌদি আরব। অন্যদিকে ইয়েমেনের সরকারি বাহিনী হুতিদের মধ্যকার সংঘর্ষ রূপ নেয় সৌদি আরব ইরানের ছায়াযুদ্ধে। ২০১৫ সালে সৌদি আরবের নেতৃত্বে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের জোট ইয়েমেনে হুতি অবস্থানগুলো লক্ষ্য করে হামলা শুরু করে। হামলা এখনো অব্যাহত রয়েছে। হামলায় পর্যন্ত অগণিত প্রাণক্ষয়ের পাশাপাশি তৈরি হয়েছে বড় ধরনের মানবিক সংকট।

অজ্ঞাতনামা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম জানাচ্ছে, চলতি মাসে দুই দেশের মধ্যে অনুষ্ঠিত প্রথম দফার গোপন বৈঠকে ইস্যুও উঠে এসেছে। এপ্রিল বাগদাদে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ইরান সৌদি আরবের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বৈঠকে মূলত দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়ন নিয়েই কথা হয়। পাশাপাশি ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের ওপর সৌদি হামলার বিষয় নিয়েও আলোচনা হয়েছে, যার ফলাফল ইতিবাচক।

এছাড়া আলোচনায় লেবাননের বিষয়টিও উঠে আসে। দেশটি কয়েক বছর ধরেই রাজনৈতিক অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দেশটিতে ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহ বিদ্রোহীরা দিন দিন শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। নিয়ে সৌদি আরব রিয়াদের মিত্র দেশগুলোর মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগও রয়েছে।

তবে দুই দেশের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিদের কেউই এখনো বিষয়টি স্বীকার করে নেয়নি। ইরানি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সাইদ খাতিবজাদেহর কাছে গতকালও আলোচনার বিষয়ে জানতে চেয়েছিলেন স্থানীয় সাংবাদিকরা। সময় খাতিবজাদেহ খবরের সত্যতা স্বীকার বা অস্বীকার কোনোটিই করতে চাননি। তবে তিনি বলেছেন, সৌদি আরবের সঙ্গে আলোচনার বিষয়টিকে সব সময়ই স্বাগত জানিয়েছে ইরান। বিষয়ে তেহরানের মনোভাব হলোএর মধ্য দিয়ে দুই দেশই লাভবান হবে।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এতদিন পর্যন্ত কোনো আগ্রহ না থাকলেও সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দুই দেশ আলোচনায় বসেছে। ইরানের পরমাণু শক্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা এবং ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের হামলা জোরদারের পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনায় বসতে সম্মতি জানায় তেহরান রিয়াদ।

আলোচনায় অংশগ্রহণকারী অজ্ঞাতনামা কয়েক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম জানাচ্ছে, ইরাকি প্রধানমন্ত্রী মুস্তাফা আল-কাজিমির ব্যক্তিগত সংশ্লিষ্টতার কারণেই আলোচনা সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে চিরবৈরী দুই দেশের মধ্যে সেতুবন্ধের কাজটিও তিনিই করছেন।

মুস্তাফা আল-কাজিমি গত মাসে সৌদি আরব সফরে যান। সময় সৌদি সিংহাসনের উত্তরাধিকারী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে কথা হয় তার। মোহাম্মদ বিন সালমান ইরানের কট্টর বিরোধী হিসেবে পরিচিত। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলেও ইরানের ওপর সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগের পক্ষে জোর সমর্থন দিয়েছেন তিনি। বর্তমানে তাকে ট্রাম্পের উত্তরসূরি জো বাইডেনের তুলনামূলক শিথিল পররাষ্ট্রনীতিতেও সমর্থন দিতে দেখা যাচ্ছে।

অন্যদিকে ইরানের সঙ্গে সংঘাত চালাতে গিয়ে সৌদি আরবকেও বেশকিছু নাজুক পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। ২০১৯ সালে এক মিসাইল ড্রোন হামলায় দেশটির অপরিশোধিত জ্বালানি তেল উৎপাদন নেমে আসে অর্ধেকে। ওই সময় হুতি বিদ্রোহীরা এর দায় স্বীকার করেছিল। যদিও সৌদি কর্মকর্তারা এর জন্য ইরানকেই দায়ী করেছিলেন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন