আলোকপাত

জাতীয় বাজেট ঘিরে কিছু প্রস্তাব

ড. আবুল বারকাত

বাজেট প্রণয়নে ভিত্তি-নীতির ভিত্তিকথা

বিশ্ব এখন একই সঙ্গে দুই মহা বিপর্যয়ের সম্মুখীন। প্রথম মহাবিপর্যয় হলো বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মহামন্দা। আর দ্বিতীয় মহাবিপর্যয় হলো, কভিড-১৯ উদ্ভূত মহামারী। ধরনের অবস্থায় সাধারণ জ্ঞানের প্রশ্ন হলো, একই সঙ্গে সংঘটিত অর্থনীতির কাঠামোগত বিপর্যয়মহামন্দা এবং কভিড-১৯-এর মহাবিপর্যয় থেকে মুক্ত হয়ে আলোকিত মানুষসমৃদ্ধ বৈষম্যহীন শোভন সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র বিনির্মাণে একটি ধারণাত্মক তত্ত্ব কাঠামো (কনসেপচুয়াল থিউরিটিক্যাল কনস্ট্রাক্ট) কেমন হবে এবং তার ভিত্তিতে তা বিনির্মাণে জাতীয় বাজেট কেমন হবে বা হওয়া উচিত?

উত্থাপিত প্রশ্নের উত্তরে যুক্তি ক্রমানুসারে অপেক্ষাকৃত বড় মাপের যেসব সংশ্লিষ্ট বিষয় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতেই হবে তা হলো: () পুঁজিবাদী শোষণভিত্তিক কাঠামোয় অনিবার্য বৈশ্বিক মহামন্দাসহ কভিড-১৯ মহামারী উদ্ভূত পরিবর্তন বিশ্লেষণসহ উত্তরণের পথনির্দেশে প্রচলিত অর্থনীতিশাস্ত্রের পারগতা বা অপারগতা এবং নতুন একীভূত অর্থনীতিশাস্ত্রের যৌক্তিকতা; () ভাইরাস মহামারী প্রকৃতি-উদ্ভূত হলেও কি তা হতে পারে না প্রকৃতিকে অতিশোষণমূলক ব্যবস্থা পুঁজিবাদী সিস্টেম উদ্ভূত; () হতে কি পারে না যে ভাইরাস-মহামারী আসলে প্রকৃতিকে নির্বিচার অত্যাচার উদ্ভূত, পুঁজিবাদী অন্যায্য-অন্যায় বিশ্বায়ন উদ্ভূত? এসব নিয়ে আমাদের মূলকথা চারমাত্রিক (তবে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত)

প্রথম কথা/প্রথম মাত্রা: সব দোষ কভিড-১৯ ভাইরাসেরএটাই বলা হচ্ছে।  আসলে এটা সত্য নয়। আসল কথাও নয়। মূলকথা হলো রকম: রেন্টসিকার-পরজীবী-লুটেরা-জোম্বি করপোরেশন-স্বজনতুষ্টিবাদী মুক্তবাজার পুঁজিবাদ এমনই এক সিস্টেম, যেখানে দীর্ঘমেয়াদি বাণিজ্য চক্রের (লং টার্ম বিজনেস সাইকেল) বিধান অনুযায়ী প্রতি ৩০-৪০ বছর পর পুঁজিবাদী অর্থনীতি সিস্টেমে মহামন্দা (গ্রেট ডিপ্রেশন, গ্রেট স্নোডাউন, ক্রাইসিস) অবশ্যম্ভাবী।

আর সূত্রানুয়ায়ী সেটা ঘটার কথা ২০১৯-২০ সালের দিকে এবং তাই- ঘটেছেবিশ্বব্যাপী। কিন্তু যে ঘটনা ইতিহাসে কখনো একই সঙ্গে ঘটেনি, তা ঘটেছে এবার। তা হলো একদিকে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মহামন্দা আর অন্যদিকে একই সময়ে বিশ্বব্যাপী কভিড-১৯ সংক্রমণজনিত মহামারী (যার শেষ অভিঘাত কারো জানা নেই) অর্থাৎ বিশ্বের প্রায় সব দেশই এখন অর্থনৈতিক-সামাজিক-শিক্ষাগত-স্বাস্থ্যগত-রাজনৈতিক’—এই বহুমুখী মহাবিপর্যয়কর অবস্থায়—‘মহামন্দা রোগে (ডিজিজ অব গ্রেট ডিপ্রেশন বা হরর ডিজিজ) আক্রান্তযা পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম।

রোগী এখন আইসিইউতে। রোগীকে বাঁচাতে হলে প্রথমে তাকে সুস্থ করতে হবে। অর্থাৎ দেশের কথা বললে বলতে হয়, দেশের অর্থনীতি-সমাজ-সংস্কৃতি-রাষ্ট্র-সরকার সবকিছুকেই সর্বপ্রথম প্রাক-অসুস্থ অবস্থায় অর্থাৎ অসুস্থ হওয়ার আগের অবস্থায় নিতে হবে। এক্ষেত্রে বাজেট প্রণেতাদের প্রথমেই স্বীকার করে নিতে হবে যে ২০২১ সালের এই এপ্রিলে আমরা ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চের অবস্থায় নেই। যথেষ্ট মাত্রায় পরিবর্তন হয়েছেঅর্থনীতিতে, সমাজে, মানুষের সাহস-হতাশায়, রাষ্ট্রে, সরকারেসর্বত্র। অবশ্য স্বীকৃতিতেও যে খুব বেশি কিছু যায় আসে তা নয়। তবে এটা হবে নির্মোহ সত্য স্বীকার করা—‘ডিনায়েল সিনড্রোম থেকে মুক্তি। স্বীকৃতিতেও খুব একটা যায় আসে না, কারণ কভিড-১৯-এর পূর্বাবস্থাও সুখকর ছিল নাতা ছিল রেন্টসিকার-দুর্বৃত্ত-লুটেরা-পরজীবী নিয়ন্ত্রিত মুক্তবাজার পুঁজিবাদের অর্থনীতি, যা মুক্তও নয় দরিদ্রবান্ধবও নয়; যেখানে আয়বৈষম্য-ধন সম্পদবৈষম্য-শিক্ষাবৈষম্য স্বাস্থ্যবৈষম্য ছিল ক্রমবর্ধমান।

দ্বিতীয় কথা/দ্বিতীয় মাত্রা: আমাদের দ্বিতীয় কথা দেশে ধনী-দরিদ্রের প্রবণতা নিয়ে; বিত্তের গতি-প্রকৃতির পরিবর্তন নিয়ে। আর একই সঙ্গে প্রবণতায় মহামারীকালীন অভিঘাত এবং সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ নিয়ে। সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি রকম:

. দেশের অধিকাংশ মানুষই বহুমাত্রিক দরিদ্র। আর ধনী (অথবা সুপার ধনী) হলো জনসংখ্যার সর্বোচ্চ শতাংশ। একথা অনস্বীকার্য এবং গবেষণায় প্রমাণিত যে লকডাউনের প্রভাবে নিরঙ্কুশ দরিদ্র (অ্যাবসলিউট পুওর) মানুষ হতদরিদ্র-চরম দরিদ্র (আলট্রা পুওর) হয়েছে; আর নিম্নবিত্ত মানুষের ব্যাপকাংশ দরিদ্র হয়েছে এবং মধ্য-মধ্যবিত্তদের একাংশ বিত্তের মানদণ্ডে নিম্নগামী হয়েছে। ফলে এখন একদিকে দরিদ্র মানুষের মোট সংখ্যা মহামারী সময়ের আগের তুলনায় কমপক্ষে দ্বিগুণ বেড়েছে, আর অন্যদিকে সৃষ্টি হয়েছে নতুন এক দরিদ্রগোষ্ঠী, যারা আগে দরিদ্র ছিল না; যাদের বলা যায় নব দরিদ্র (নিউ পুওর)

ব্যাপক জনগোষ্ঠীর বিত্তের এই অধোগতি আগে কখনো হয়নি। এক নতুন প্রবণতা। দারিদ্র্যের আরো একটা বিষয় এর আগে কখনো ঘটেনি, তা হলো দরিদ্র, নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের ব্যাপক হারে শহর থেকে গ্রামমুখী হওয়া। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, এসব মানুষের অনেকেই গ্রামে স্থায়ীভাবে থেকে যেতে বাধ্য হবে।

. আর অন্যদিকে লকডাউনের কারণেই অফলাইনের ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা, সেবা খাতে অধোগতি হয়েছেহয়েছে তা নিম্নগামী। আর ফুলে-ফেঁপে উঠেছে অনলাইন ব্যবসা-বাণিজ্য (এটা বিশ্বব্যাপী ঘটনা, তা না হলে অ্যামাজনের জেফ বেজোস কী করে মাত্র একদিনে তার সম্পদে ১২ বিলিয়ন ডলার যোগ করতে পারলেন?) অনলাইনের রেন্ট সিকার-দুর্বৃত্ত-লুটেরা-পরজীবীরা মুক্ত বাজারে মুক্ত বিহঙ্গ হয়ে তাদের আয়-সম্পদ-সম্পত্তি বিপুল বাড়িয়েছে। এসবের ফলে আয়, সম্পদ, স্বাস্থ্য, শিক্ষাবৈষম্যসহ সব ধরনই বেড়েছে।

আমাদের হিসাবে আমাদের দেশে আয়বৈষম্যের মাপকাঠি জিনি সহগের মান লকডাউনের আগে ছিল শূন্য দশমিক ৪৮২, যা লকডাউনের পর মাত্র ৬৬ দিনের মধ্যেই (৩১ মে ২০২০ নাগাদ) বেড়ে দাঁড়িয়েছে শূন্য দশমিক ৬৩৫-এ। আর পালমা অনুপাত (যা দেখায় একটি দেশের সর্বোচ্চ আয়ের মালিক ১০ শতাংশ মানুষের মোট আয় সর্বনিম্ন আয়ের মালিক ৪০ শতাংশ মানুষের মোট আয়ের কত গুণ বেশি) একই সময়ে দশমিক ৯২ থেকে বেড়ে হয়েছে দশমিক ৫৩ (যা বিপত্সীমার দ্বিগুণেরও বেশি) সুতরাং কভিড-১৯ বাংলাদেশকে উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশ এবং বিপজ্জনক আয়বৈষম্যের দেশে রূপান্তর করেছে। অবস্থায় বাজেট প্রণেতাদের উদ্দেশ্যে সুস্পষ্ট প্রস্তাব হলো, আয়- সম্পদ-স্বাস্থ্য-শিক্ষাবৈষম্য হ্রাসের যত পথ-পদ্ধতি আছে, তার সবই যত দ্রুত সম্ভব সমাধানের চেষ্টা করা।

তৃতীয় কথা/তৃতীয় মাত্রা: মানুষের ক্ষুধার দারিদ্র্যসহ বহুমাত্রিক দারিদ্র্য বেড়েছে। আরো বাড়ছে-বাড়বে। সবচেয়ে শোচনীয় অবস্থা মানুষের কর্মসংস্থানের। দেশে মোট শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা কোটি ৮২ লাখ হাজার, যাদের ৮৫ শতাংশ অর্থাৎ কোটি শ্রমজীবী মানুষ। অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত, যার মধ্যে আছে বিভিন্ন ধরনের অণু ক্ষুদ্র ব্যবসা শিল্প-কুটির শিল্প; কৃষি খাত, শস্য শাকসবজি-প্রাণিসম্পদ-মত্স্য সম্পদ-জলজ সম্পদ কভিড উদ্ভূত লকডাউনে এসব মানুষের অধিকাংশই হয় কর্মহীন অথবা স্বল্প মজুরিতে স্বল্প সময়ের জন্য সাময়িককালীন কর্মজীবী। কারণ কর্মবাজার সংকুচিত হয়েছে, সামনে আরো হবে। পরিবার-পরিজনসহ এসব মানুষের পক্ষে জীবন পরিচালন অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এদের হাতে টাকা-পয়সা নেই। অনেকেই যা কিছু ছিল, তাও বেচতে বাধ্য হয়েছেন (দুর্দশাগ্রস্ততার কারণে বিক্রি বা ডিস্ট্রেস সেল) এরা এখন নিঃস্ব, সর্বস্বহারা, হতাশাগ্রস্ত, ভাগ্যনির্ভর। জীবন এদের অনিশ্চিত। এসব মানুষকে সরকারি উদ্যোগে ১৯২৯-৩৩-এর মহামন্দার সময়ে নিউ-ডিল কর্মসূচির মতো ব্যাপক এবং শোভন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই।

চতুর্থ কথা/চতুর্থ মাত্রা: অর্থনীতিবিদদের প্রায় সবাই বলে থাকেন পণ্যের দাম বাড়া বা মূল্যস্ফীতি (ইনফ্লেশন) হলো গরিবের শত্রু। একথা মিথ্যা নয়। তবে যে কথা তারা বলেন না, তা হলো মূল্যহ্রাস বা মূল্য সংকোচন (ডিফ্লেশন) হলো গরিবের মহাশত্রু। উল্লেখ্য, ১৯২৯-৩৩-এর মহামন্দাকালে মূল্যস্ফীতি ঘটেনি, ঘটেছিল মূল্যহ্রাস বা মূল্যসংকোচন; আর ওই মহামন্দার পর পরই মূল্যহ্রাস বা মূল্যসংকোচনের সুযোগে নির্বাচনের মাধ্যমেই ফ্যাসিস্ট হিটলার জার্মানিতে ক্ষমতায় আসেন। এসব গূঢ় বিষয় নিয়ে দূরদর্শী বাজেট প্রণেতারা ভাববেন প্রত্যাশা অমূলক হবে না।

আসন্ন বাজেটের ভিত্তি নীতির ভিত্তি কথা নিয়ে যে চারটি বাস্তব বিষয়-প্রবণতা উল্লেখ করলাম, তা থেকে আমরা মনে করি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আলোকিত মানুষের বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণে এবং দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে বাঁচানোর লক্ষ্যে বাজেট প্রণেতারা এবারের বাজেটে নিদেনপক্ষে দুটো বড় মাপের বিষয় নিয়ে ভাবা জরুরি:

প্রথম যা ভাবা প্রয়োজন: আয়-ধন-সম্পদের বণ্টন হতে হবে ন্যায্য, তা ধনীদের কাছ থেকে প্রবাহিত হতে হবে দরিদ্র, বিত্তহীন, নিম্নবিত্ত মানুষের হাতে। লক্ষ্যে বাজেট যা পারে তা হলো: . ধনী-বিত্তশালীদের ওপর সম্পদ কর আরোপ করা, . সুপার-ডুপার ধনীদের ওপর করহার বাড়ানো, . শেয়ারবাজার বন্ড বাজারে বড় বিনিয়োগের ওপর সম্পদ কর আরোপ করা (আসলে খুব কমসংখ্যক মানুষই ৮০ শতাংশ শেয়ার-বন্ডের মালিক), . অতিরিক্ত মুনাফার ওপর কর আরোপ করা (ট্যাক্স অন এক্সসেস প্রফিট), . কালো টাকা উদ্ধার করা, . পাচারকৃত অর্থ (মানি লন্ডারিং) উদ্ধার করা।

দ্বিতীয় যা ভাবা প্রয়োজন: সরকারিভাবেই শোভন মজুরির ব্যাপক কর্মসংস্থান-সুযোগ সৃষ্টি করা। সেক্ষেত্রে প্রয়োজনে অতিরিক্ত টাকা ছাপালেও কোনো অসুবিধা হবে না (তবে ভারসাম্য বিষয়টি নজরে রাখতে হবে, যেন অপ্রয়োজনে টাকা ছাপানো না হয়) অবশ্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আর বিশ্বব্যাংকের নব্য-উদারবাদী অর্থনৈতিক উন্নয়ন নীতি মতাদর্শে বিশ্বাস করলে এসব করা সম্ভব হবে না। কিন্তু ১৯২৯-৩৩-এর মহামন্দা থেকে উত্তরণে সরকারি উদ্যোগে নিউ ডিল নীতির আওতায় ব্যাপক কর্মসংস্থানের যেমন কোনো বিকল্প ছিল না, এখনো তেমনিই দ্বিতীয় কোনো বিকল্প নেই (এখন হতে পারে গ্রিন নিউ ডিল; প্রকৃতির প্রতি সম্মান আনুগত্যভিত্তিক নিউ ডিল)

বিকল্প বাজেট ২০২০-২১: ভাবনা-ভিত্তি

করোনাভাইরাস বিপর্যয়ের সামগ্রিক বহুমাত্রিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণভিত্তিক বাজেটের প্রধান লক্ষ্য হতে হবে আলোকিত মানুষসমৃদ্ধ বৈষম্যহীন শোভন বাংলাদেশ বিনির্মাণ; যা ছিল ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা। বিশ্বাসও অমূলক হবে না যে করোনাভাইরাস বিপর্যয় মানুষের (আমাদের) অন্তর্নিহিত শক্তিকে দুর্বল করবে না, উল্টো বিপর্যয় কাঙ্ক্ষিত মানবিক উন্নয়ন-প্রগতির গতি বাড়ানোর সুযোগ সৃষ্টি করবে। আমাদের লক্ষ্য হতে হবে সে সুযোগ উদ্ঘাটন-অনুসন্ধান করা এবং তা দেশের মানুষের জন্য কাজে লাগানো। আমরা জানি এসব এক বাজেটের কাজ নয়।

বাজেটসহ আর্থসামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে বিদেশ থেকে ধার করা নয় অথবা (আমাদের ওপর) বহিঃশক্তির চাপিয়ে দেয়া নয় প্রকৃতির প্রতি পূর্ণ সম্মান আস্থাভিত্তিক বৈষম্য হ্রাস-উদ্দিষ্ট উন্নয়ন দর্শন সঠিক পথ বলে আমরা বিবেচনা করি। কারণ তাই- ছিল ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-ভিত্তি।

এতক্ষণ নীতি-দর্শনগত যে মৌল কথন হলো, সেসবের ভিত্তিতে আসন্ন বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে পদ্ধতিগতভাবে যেসব বিষয় বা অনুসিদ্ধান্তের ওপর জোর দেয়ার অগ্রাধিকার প্রদানের কথা ভাবা প্রয়োজন, তা হলো নিম্নরূপ:

. সাংবিধানিক ভিত্তি: বাজেট প্রণয়নে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইনসংবিধানের বিধানগুলোকে ভিত্তি হিসেবে ধরে নিতে হবে। সংবিধানের সঙ্গে সাযুজ্যহীন অথবা অসংগতিপূর্ণ অথবা বিরোধাত্মক ধরনের সবকিছু বাজেট প্রণয়নে বর্জন করতেই হবে। সচেতনবর্জিত বিষয়াদি হতে হবে সংবিধানের () () অনুচ্ছেদে সংবিধানের প্রাধান্য সঙ্গে সম্পূর্ণ সংগতিপূর্ণ।

. রাষ্ট্রের অধিকতর সক্রিয় ফলপ্রদ ভূমিকা: অর্থনৈতিক উন্নয়নে নয়া-উদারবাদী দর্শনের বিপরীতে রাষ্ট্রের অধিকতর সক্রিয় ফলপ্রদ ভূমিকার প্রয়োজনীয়তা সম্পূর্ণ স্বীকার করে (যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সংবিধানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ) রাষ্ট্রের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে ব্যয় বরাদ্দ নির্ণয় করা প্রয়োজন। আমরা মনে করি যে কভিড-১৯-এর মহাবিপর্যয়কর আঘাতসহ অর্থনৈতিক-সামাজিক সংকট মোকাবেলা এবং একই সঙ্গে প্রাকৃতিক যুক্তির বৈষম্যহীন সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র বিনির্মাণে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে বাজেট হতে হবে সম্প্রসারণমূলক। আমরা সম্পূর্ণ অবগত যে নব্য উদারবাদীরা রাষ্ট্র-সরকারের নিয়ন্ত্রণ উঠিয়ে নেয়ার কথা এখন আরো জোর দিয়ে বলবেন। তাদের অনেকেই এখন বলছেন যে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ বেশি হওয়ার ফলেই বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ মহামন্দামুখী; বলছেন বাজারকে তার কাজ করতে বাধা দেয়া হয়েছে বলেই মহাবিপর্যয় হচ্ছে এবং হবে; বলছেন যে সরকারের এখন উচিত হবে যেখানে যত অর্থকড়ি আছে, তার সবই ব্যক্তিমালিকদের দিয়ে দেয়াসব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

. দারিদ্র্য-বৈষম্য-অসমতা দূরীকরণে প্রত্যক্ষ ভূমিকা প্রদানকারী খাত: বাজেট বরাদ্দে সেসব খাত-ক্ষেত্রকে অগ্রাধিকার দেয়া জরুরি, যেসব খাত দ্রুতগতিতে দারিদ্র্য-বৈষম্য-অসমতা দূরীকরণে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখে, যেসব খাতের বরাদ্দে দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক অভিঘাত হয় ধনাত্মক, যেসব খাতের বরাদ্দ কৃষির বিকাশ, দেশজ শিল্পায়ন, অভ্যন্তরীণ বাজার, শিক্ষা স্বাস্থ্যসহ মানবসম্পদের বিকাশকে ত্বরান্বিত করে, যেসব খাতের বরাদ্দ প্রকৃতি-পরিবেশ-প্রতিবেশ সহায়ক, যেসব খাতের বরাদ্দ মানবসত্তার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা-সহায়ক।

. কভিড-১৯-এর অভিঘাত মোকাবেলায় উন্নয়ন-ভবিষ্যৎ নিয়ে সুনির্দিষ্ট ভাবনা: কভিড-১৯-এর সম্ভাব্য অভিঘাত নিয়ে গবেষণা উদ্ভূত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসহ সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব বাজেটে থাকতে হবে।

. আয় ব্যয়ের কাঠামোগত রূপান্তর: সংগত কারণেই বাজেটের আয় ব্যয় খাতে কাঠামোগত রূপান্তরের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করা জরুরি। বিবেচনার ভিত্তি হবে সংবিধানের ভিত্তিতে শোভন সমাজ-শোভন অর্থনীতি বিনির্মাণ

. বৈদেশিক ঋণ নির্ভরতাবিহীন: কোনো ধরনের বৈদেশিক ঋণের প্রয়োজনীয়তা ছাড়াই বাজেট প্রণয়ন করা সম্ভব। অনুসিদ্ধান্তের মূল কারণ দ্বিবিধআমরা অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সামাজিক সার্বভৌমত্ব গুরুত্বপূর্ণ মনে করি এবং বৈদেশিক ঋণ নব্য উদারবাদী মুক্ত বাজার মতবাদতাড়িত, যা স্বাধীন বিকাশের প্রতিবন্ধক। তবে বিদ্যমান রেন্টসিকার-লুটেরা-দুর্বৃত্ত পুঁজি করপোরেশনবেষ্টিত (যাকে বলে জম্বি করপোরেশন) রাজনীতি-অর্থনীতি ব্যবস্থায় রাষ্ট্র-সরকার তুলনামূলক কম বিষাক্ত (লেস টক্সিক) বৈদেশিক ঋণ নিলেও নিতে পারেন (বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এটা হতে পারে প্রয়োজনীয় আপসমূলক অবস্থান)

. রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্রে বিত্তবান-ধনীদের ওপর যুক্তিসংগত চাপ প্রয়োগ: করোনাভাইরাস উদ্ভূত বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে বাজেটের জন্য সম্পদ আহরণ বৈষম্য হ্রাসের অন্যতম পদ্ধতি হিসেবে সরকারের রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্রে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর ওপরদরিদ্র, নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, মধ্য-মধ্যবিত্ত আমরা কোনো ধরনের চাপ প্রয়োগ সমীচীন মনে করি না। আমরা মনে করি চাপ প্রয়োগ দরকার ধনিক শ্রেণী-সম্পদশালীদের ওপর। ধনী বিত্ত-সম্পদশালী ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান, যারা সঠিক কর প্রদান করেন না, তারা যেন সঠিক পরিমাণ কর প্রদান করেন, তা বিবেচনা জরুরি। একই সঙ্গে প্রয়োজনানুযায়ী বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন করহার নির্ধারণ জরুরি।

. পরোক্ষ করের তুলনায় প্রত্যক্ষ করের অনুপাত: পরোক্ষ করের বোঝা মূলত দরিদ্র-প্রান্তিক-নিম্নবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত মধ্য-মধ্যবিত্তদের ওপর তাদের আয়ের তুলনায় অধিক হারে চাপ প্রয়োগ করে। ফলে তা দারিদ্র্য-বৈষম্য হ্রাস করে না। উল্টো তা বৈষম্য বাড়ায়। সে কারণে আমরা মনে করি পরোক্ষ করের তুলনায় প্রত্যক্ষ করের অনুপাত বেশি নির্ধারণ করা প্রয়োজন।

. কোনো আয়ই আসে না অথচ সম্ভাবনা অনেক: কর-রাজস্ব করবহির্ভূত রাজস্ব আয়ের সেসব খাত অনুসন্ধান করা প্রয়োজন, যেসব খাত থেকে আয়করের কথা কখনো ভাবা হয় না (যেমন সম্পদ কর, অতিরিক্ত মুনাফার ওপর কর, কালো টাকা উদ্ধার, পাচারকৃত অর্থ উদ্ধার ইত্যাদি) এবং যেসব খাত থেকে কোনো আয়ই আসে না অথচ সম্ভাবনা অনেক। একই সঙ্গে সেসব খাত চিহ্নিত করা প্রয়োজন, যেসব খাত থেকে স্বল্প আয় আসে অথচ প্রাপ্তির সম্ভাবনা অনেক যদি একটু সাহসী উদ্যমী হওয়া যায় এবং কর-রাজস্ব ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করা যায়। 

১০. উন্নয়ন দর্শন কভিড-১৯-এর অভিঘাত মোকাবেলার কারণে বাজেট বরাদ্দে অগ্রাধিকার: শোভন জীবন ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণে যে উন্নয়ন দর্শন সঠিক বলে আমরা মনে করি, সে কারণেই বাজেট বরাদ্দে আমাদের অগ্রাধিকারক্রম হওয়া উচিত হবে নিম্নরূপ: শিক্ষা প্রযুক্তি (শিক্ষা-কে আমরা প্রযুক্তি থেকে ভিন্ন করে শিক্ষা খাতে শিক্ষা গবেষণা নাম দিয়ে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দিয়েছি), সামাজিক নিরাপত্তা কল্যাণ, পরিবহন যোগাযোগ, বিদ্যুৎ জ্বালানি, জনপ্রশাসন, কৃষি, স্বাস্থ্য (কৃষির সমান), স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন, জনশৃঙ্খলা নিরাপত্তা, গৃহায়ণ (জনশৃঙ্খলা নিরাপত্তার সমান), সুদ, প্রতিরক্ষা, বিনোদন, সংস্কৃতি ধর্ম (সংস্কৃতি ধর্মকে আমরা একবন্ধনী খাত থেকে দুটি ভিন্ন খাত হিসেবে প্রস্তাব করেছি), শিল্প অর্থনৈতিক সার্ভিস, বিবিধ ব্যয় (খাদ্য হিসাবসহ)

১১. দুটি নতুন বিভাগ সংযোজন: জাতীয় স্বার্থে বাজেটের সম্পদ ব্যবহারে আমরা দুটি নতুন বিভাগ প্রস্তাব করেছি। প্রথমটি, স্বাস্থ্য খাতের অধীনে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা (সিস্টেম) বিভাগ (কভিড-১৯-এর শিক্ষা থেকে); আর দ্বিতীয়টি, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রবীণ হিতৈষী বিভাগ (জনসংখ্যায় প্রবীণ মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং দুর্দশা বৃদ্ধির কারণে)

১২. মানব উন্নয়ন মানবসম্পদ উন্নয়ন: মানব উন্নয়ন মানবসম্পদ উন্নয়নসহ উৎপাদনশীল বিনিয়োগে দারিদ্র্য-বৈষম্য-অসমতা দূরসহ সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী (কৃষকের শস্য বীমা ভূমি সংস্কারসংশ্লিষ্ট কার্যক্রম), কৃষি, স্বাস্থ্য, খাদ্য মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ত্রাণ মন্ত্রণালয়, পল্লী উন্নয়ন সমবায় বিভাগ, তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ, গৃহায়ন, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়, জ্বালানি খনিজ সম্পদ বিভাগের বরাদ্দে আমরা যুক্তিসংগত অগ্রাধিকার দেয়ার প্রস্তাব করছি।

১৩. আমদানি শুল্কহার নির্ধারণে দেশজ শিল্পায়ন দেশজ কৃষি: আমদানি শুল্কহার নির্ধারণে দেশজ শিল্পায়ন দেশজ কৃষির স্বার্থ বিবেচনায় কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ খাত-উপখাতগুলোর ক্ষেত্রে আমরা মুক্ত বাজার দর্শনের বিপরীতে সংরক্ষণবাদ নীতি-দর্শন প্রয়োজনের সুপারিশ করছি।

১৪. প্রকৃত মানবিক উন্নয়নের অন্যতম পথনির্দেশক দলিল: আসন্ন বাজেটে আয়-ব্যয় বিন্যাসসহ বিভিন্ন নীতি-কৌশলসংশ্লিষ্ট নিদের্শনা মেনে নিম্নবর্ণিত বিষয়াদির সম্ভাব্য অর্জন মাত্রা নিরূপণ করা প্রয়োজন: () প্রকৃতির প্রতি পূর্ণ আস্থা সম্মান বজায় রেখে প্রস্তাবিত আয় ব্যয় যেন বৈষম্য হ্রাসকারী মানবিক উন্নয়ন নিশ্চিত করে, () সমাজের সব দরিদ্র-প্রান্তিক পিছিয়ে পড়া মানুষের সম্ভাব্য দ্রুতগতিতে জীবনমান বৃদ্ধির নিশ্চয়তা, () বণ্টন ন্যায্যতা নিশ্চিতসহ উচ্চতর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, () অধিকতর বৈচিত্র্যপূর্ণ উৎপাদনশীল কৃষি, () অধিক হারে কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ ন্যায্য মজুরির নিশ্চয়তা, () শিল্পায়ন: অণু, ক্ষুদ্র, মাঝারি, বৃহৎ (আত্মকর্মসংস্থানসহ) এবং শিল্পে শ্রমিকের মালিকানাভিত্তিক অংশীদারিত্ব, () অনানুষ্ঠানিক খাতে শ্রমজীবী মানুষের উন্নত জীবনমান এবং শোভন কাজ, () কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কার, () নারীর অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষমতায়ন, () বাণিজ্য পণ্য বাজারজাতে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য হ্রাস এবং কৃষকের পণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি, () বিজ্ঞান প্রযুক্তির সর্বোত্তম জনকল্যাণকর ব্যবহার, () সরকারি খাতে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা, দক্ষতা বৃদ্ধি, প্রশিক্ষণ, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ইত্যাদির মাধ্যমে জনসংখ্যাকে মানবসম্পদে রূপান্তর, () প্রাথমিক উচ্চতর স্বাস্থ্যসেবা (জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা সেবাসহ) নিশ্চিতকরণে শক্তিশালী সরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাত এবং () সামাজিক সুরক্ষার বিস্তৃতিসহ সুসংগঠিত সামাজিক বীমা পদ্ধতি।

২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটের মোট আকার (পরিচালন উন্নয়ন মিলে) হওয়া উচিত কমপক্ষে ১৫ লাখ কোটি টাকা। আমাদের প্রস্তাব বৃহদাকার-সম্প্রসারণশীল বাজেট। অর্থনৈতিক মহামন্দা কভিড-১৯-এর বিপর্যয়কর অভিঘাত মোকাবেলা করে আমরা আলোকিত মানুষসমৃদ্ধ বৈষম্যহীন শোভন সমাজ ব্যবস্থা বিনির্মাণের পক্ষে।

 

. আবুল বারকাত: অধ্যাপক, জাপাানিজ স্টাডিজ বিভাগ

সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন