হাকালুকি হাওরে মাছ উৎপাদন বেড়েছে ৫ শতাংশের বেশি

বণিক বার্তা প্রতিনিধি, মৌলভীবাজার

মৌসুমের শেষ দিকে এসে হাকালুকি হাওরে ধরা পড়ছে প্রচুর পরিমাণের দেশী প্রজাতির মাছ। ছোট বড় মাছের পাশাপাশি বছর বিপন্ন প্রজাতির অনেক মাছের আধিক্য দেখা যাচ্ছে হাওরে। জেলা মৎস্য বিভাগ জানায়, করোনাকালে হাওরে মানুষের চাপ কম থাকায় মাছের স্বাভাবিক প্রজননের সুযোগ বেড়েছে। সরকারি বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণের কারণে বছর মাছের উৎপাদন বেড়েছে শতাংশের বেশি।

সরেজমিনে কুলাউড়া উপজেলার চকিয়া বিল নাগুয়াসহ কয়েকটি বিল ঘুরে দেখা যায়, বিলের পাড়ে অস্থায়ী নিলাম কেন্দ্র স্থাপন করেছেন বিল ইজারাদাররা। সেখানে ভোর থেকে ব্যবসায়ীরা মাছ কেনার জন্য ভিড় করছেন। ইজারাদারদের অধীনে জেলেরা সারাদিন বিলে জাল ফেলে মাছ ধরছেন। কিছুক্ষণ পর পর সে মাছ নৌকায় করে ঘাটের নিলাম কেন্দ্রে নিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে।

ব্যবসায়ী জেলেরা জানান, বছর বড় রুই, বোয়াল, আইড়, কমন কার্প, মৃগেল মাছের আধিক্য বেশি। সঙ্গে অন্য জাতের দেশী মাছও ধরা পড়ছে। এছাড়া চাপিলা, টেংরা, মলা, চিংড়িসহ বিভিন্ন জাতের ছোট মাছ প্রচুর পরিমাণে ধরা পড়ছে। ছোট বড় মাছ আলাদা করে বিক্রি করা হচ্ছে ঘাটে। বছর বিপন্ন প্রজাতির মাছ পাবদা, চিতল, ফলি, কালবাউস, গুলশাসহ কিছু মাছ আগের চেয়ে অনেক বেশি দেখা যাচ্ছে।

ব্যবসায়ী আকলুস মিয়া জানান, গত বছর বর্ষায় করোনার কারণে ভাসা পানিতে মাছ ধরতে কম গেছেন জেলেরা। মানুষ কম থাকায় প্রাকৃতিক খাবার পেয়েছে মাছ, তাই বড়ও হয়েছে দ্রুত। এজন্য বড় মাছ ধরা পড়ছে।

আলী হোসেন জানান, চকিয়ার বিলে ২০ কেজি ওজনের মাছও ধরা পড়ছে। হাকালুকির মিঠাপানির তাজা সুস্বাদু মাছের সুনাম রয়েছে দেশে। চাহিদা বেশি থাকায় দামও ভালো। তবে ঢাকা-সিলেটের বড় বড় ব্যবসায়ীরা এখান থেকে মাছ কিনে নেয়ায় কম পুঁজির স্থানীয় ব্যবসায়ীরা লাভবান হচ্ছেন না।

বিল ইজারাদার সাইফুল ইসলাম জানান, এখানে অনেক জাতের মাছ ধরা পড়ে, যা অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। তবে যে পরিমাণ মাছ ধরা পড়ার কথা সে পরিমাণ ধরা পড়ছে না।

সাধারণ মৎস্যজীবীদের অভিযোগ, নিয়ম অনুযায়ী হাওরের সরকারি বিলগুলো বিভিন্ন মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির নামে ইজারা দেয়া হয়। কিন্তু পুঁজি বিনিয়োগ করেন বড় বড় ব্যবসায়ীরা। সেক্ষেত্রে সমিতির নিবন্ধিত প্রান্তিক জেলেরা নামমাত্র খাতা কলমে থাকেন। আয়ের পুরো অংশ যায় পুঁজি মালিকের ঘরে। কিছু জেলে দিনমজুর হিসেবে মাছ ধরেন। অন্যরা একবারেই বঞ্চিত থাকেন।

জেলা মৎস্য কার্যালয় সূত্র জানায়, প্রায় ১৮ হাজার হেক্টর আয়তনের হাকালুকি হাওরের ৮০ ভাগ মৌলভীবাজারে ২০ ভাগ সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ গোলাপগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত। মৌলভীবাজারের বড়লেখা অংশে ৬০ ভাগ, কুলাউড়ায় ১২ জুড়ী উপজেলায় আট ভাগ রয়েছে। প্রায় ১১২ প্রজাতির মাছের বিচরণক্ষেত্র হাকালুকি হাওরে ছোট-বড় ২৩৮টি বিল রয়েছে। এর মধ্যে মৌলভীবাজার অংশে ২০০টি আর বাকি ৩৮টি সিলেটে। প্রতি বছর শুকনো মৌসুমে হাওরের পানি কমলে ধরা পড়ে দেশী প্রজাতির মাছ। প্রতিদিন কোটি টাকার মাছ যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।

মৎস্য অফিস বলছে, কয়েক বছর থেকে বিপন্ন প্রজাতির অনেক মাছ ফিরে এসেছে। এর মধ্যে পাবদা, ফলি, চিতল, আইড়, কালবাউস গুলশা এবার বেশি দেখা যাচ্ছে। এছাড়া রানী মাছ, কাকিলা, ছোট চিংড়ি, কাজলি, মলা, পুঁটি, টেংরা, পটকা, ভেদা, গনিয়া, কানি পাবদা, মধু পাবদা বেড়েছে। কঠোরভাবে মৎস্য আইন প্রয়োগের ফলে মাছের উৎপাদন বেড়েছে। প্রতি বছর প্রায় ১৫ হাজার টন মাছ উৎপাদন হয় হাকালুকিতে। সরকারি নানা উদ্যোগের ফলে উৎপাদন শতাংশের বেশি মাছ উৎপাদন বেড়েছে। বছর মার্চ পর্যন্ত হাকালুকির (মৌলভীবাজার অংশে) প্রায় ছয় হাজার টন মাছ উৎপাদন হয়েছে। গত বছর সময়ে উৎপাদন ছিল প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার টন।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. এমদাদুল হক জানান, ২০১৭ সালে বন্যায় অ্যামোনিয়া গ্যাসে হাকালুকি হাওরে প্রায় ২৫ টন মাছ মারা মায়। সে ক্ষতি পোষাতে কুলাউড়া, জুড়ী বড়লেখা উপজেলায় ৩০টি বিল নার্সারির মাধ্যমে রুই, কাতলা মৃগেল জাতীয় ২৬ লাখ ৪০ হাজার পোনা উৎপাদন করে হাওরে ছাড়া হয়েছিল। এছাড়া আরো ২৮ লাখ টাকার পোনা মাছ অবমুক্ত করা হয়। যার সুফল এখনো যাওয়া যাচ্ছে। হাকালুকি ছাড়াও জেলার কাউয়াদিঘী হাইল হাওরসহ ছয় হাওরে মৌসুমে ধরা পড়ে দেশী প্রজাতির মাছ। জেলায় বছরে মাছের চাহিদা ৪৭ হাজার ৩১৩ টন। হাওর, বিল, মৎস্য, খামার মিলে উৎপাদন হয়েছে ৫০ হাজার ৫১৮ টন মাছ। বর্তমানে হাকালুকিতে মাছের ১৫টি অভয়াশ্রম রয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন