এসএম মহসিনের হাসি মনে রাখবে সবাই

কুদরত উল্লাহ

মঞ্চ, টেলিভিশন, শিল্পকলা, নাট্যকলাএই চারে মিলে হলো এসএম মহসিন। মিডিয়ার বাইরে অনেকে হয়তো নামটি শোনেননি কিংবা ছবি দেখে হয়তো চিনেছেন আচ্ছা ইনিই মহসিন, এবার তাকে চিনেছি! প্রচারবিমুখ মানুষটি দীর্ঘ চার দশকের বেশি সময় ধরে কাজ করে গেছেন শুধু সংস্কৃতির টানে। প্রায়ই বলতেন, কলমের কালি যেদিন শেষ হয়ে যাবে সেদিন এসো একটু গল্প করা যাবে। পূবাইলের এক শুটিং স্পটে এভাবেই বলেছিলেন কথাগুলো। আমার পাশে বসে এক কাপ চা খাবে নাকি খোকা? আমি বললাম নিশ্চয়ই। গুরুজনের কথা ফেলতে নেই। এই দেখুন কলম আর কাগজ বুক পকেটে রেখে দিয়েছি। ঘটনা সেই ২০১৩ সালের। যতদূর মনে পড়ে স্যার বলেই আড্ডা দিচ্ছিলাম। তিনি আটকে দিয়ে বললেন একদিন ক্লাসে এসো, তারপর না হয় স্যার বলো। বাংলা নাটক, সিনেমা দেখবে। ভালোটা ভালো বলবে, মন্দটা মন্দ বলবে। আলোচনা করবে। দেখবে আমাদের সংস্কৃতি কিছুটা হলেও পরিবর্তন হবে। বিশ্ববাসী আমাদের জানবে নাটক কিংবা সিনেমা দেখে। ভুলে যেয়ো না নিজেদের সংস্কৃতি। একটানে কথা গুলো শেষ করে ফেললেন, সঙ্গে শেষ হলো আমাদের চা পান। আমি শুধু চুপ করে শুনে গেলাম। সেই যে দেখা হয়েছিল এরপর যে যার কাজে, মাঝে মাঝে ফোনে কথা হতো। বলতেন ক্লাসে আসো। আমিও চেয়েছিলাম ক্লাসে যেতে। কিন্তু সময় হয়ে ওঠেনি। তার কিছু বছর পর একদিন শহীদ মিনারে দেখা। বললেন ক্লাসে তো এলে না খোকা। আমি বললাম, স্যার আসব একদিন। তিনি হাসি দিয়ে চলে গেলেন। সেই যে গেলেন আর দেখা হয়নি।

দেখা হওয়ার সুযোগও আর নেই, ক্লাসও করা হলো না। শুধু সেই হাসি এখনো চোখে ভাসে আমার। ভাঙা-গড়ার মধ্যখানে, নানা আয়োজনে ২০১৭ সালে শিল্পকলা পদক, ২০১৮ সালে বাংলা একাডেমির সম্মানিত ফেলোশিপ পেলেন। এরপর ২০২০ সালে একুশে পদক লাভ করেন। তিনি চার দশকের বেশি সময় ধরে মঞ্চ, টেলিভিশন চলচ্চিত্রে নিয়মিত অভিনয় করেছেন। পাশাপাশি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক নাট্য বিভাগ অনুষদের সদস্য ছিলেন। দায়িত্ব পালন করেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক হিসেবেও। এছাড়া জাতীয় থিয়েটারের প্রথম প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

থিয়েটার-নাটকে তার উল্লেখযোগ্য কাজ দিপান্তর, কবর, সুবচন, নির্বাসন চুপ আদালত চলছে। টেলিভিশন নাটকের মধ্যে ছিল মহর আলী, সাকিন সারিসুরি, গরম ভাত অথবা নিছক ভূতের গল্প, নীলম্বরীসহ আরো অনেক নাটক। চলচ্চিত্রে খুব বেশি নিয়মিত না থাকলেও যে কয়টি চরিত্রে অভিনয় করেছেন তা প্রাণবন্ত। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আগে নাট্যজন এসএম মহসিন পাবনায় অন্তরাত্মা ছবির শুটিং করেছেন। গত মার্চ তার অংশের শুটিং শেষ হয়। পরদিন তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন। ঢাকায় আসার কিছু পরই তার করোনা সংক্রমণের খবর জানা যায়। বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হয়নি। শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। দ্রুত জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে নেয়া হয় তাকে এপ্রিল। এরপর তাকে চিকিৎসকরা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখেন। আইসিইউতে বেশ কিছুদিন থাকার পর কিছুটা উন্নতি হলেও হঠাৎ আবারো অবস্থার অবনতি হয়। এরপর আর কোনো উন্নতি ঘটেনি। শেষমেশ গতকাল সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে হাসপাতালেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে না ফেরার দেশে চলে যান। বণিক বার্তাকে তার ছেলে রাশেক মহসিন তন্ময় বলেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এপ্রিল হাসপাতালে ভর্তি করা হয় বাবাকে। ৭৩ বছর বয়স হয়েছিল তার। বাবার ফুসফুসের ৭০ শতাংশ সংক্রমিত ছিল। ফলে নিঃশ্বাস নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। বাবার জন্য সবাই দোয়া করবেন। ডিরেক্টর গিল্ডের সভাপতি সালাহউদ্দিন লাভলু বণিক বার্তাকে দুপুরেই নিশ্চিত করে জানান, বাদ আসর মরহুমের জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর আজিমপুর কবরস্থানে সমাহিত হবেন একুশে পদকজয়ী এসএম মহসিন। মুক্তিযোদ্ধা গুণীজনকে গতকাল বাদ আসর রাষ্ট্রীয় সম্মাননা দেখিয়ে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন