সম্পদ নয়, বোঝা হয়ে উঠবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র

নিজস্ব প্রতিবেদক

সাশ্রয়ী ব্যয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য আগামী দুই দশকে মোট ২৯টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। শুরু থেকেই পরিবেশ সংলগ্ন এলাকার বাস্তুসংস্থানের বিষয়টি বিবেচনায় পরিবেশবাদীরা এর বিরোধিতা করে আসছিলেন। বৈশ্বিকভাবেও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে এরই মধ্যে সরে এসেছে অনেক দেশ। বাংলাদেশের ওপরও বিষয়ে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে। যদিও পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে বলে সরকারের দাবি। তবে উচ্চমূল্যে কয়লা আমদানি করে বিদ্যুৎ উৎপাদন সাশ্রয়ী হবে না, এমন বিবেচনায় পরিকল্পনাধীন নয়টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়ন থেকে সরে আসার কথা ভাবছে সরকার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাস্তবায়ন হলে এসব কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পদের চেয়ে বোঝায় পরিণত হতে পারে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি যৌথ বিনিয়োগে ১৬টি কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ চলছে। এর মধ্যে সরকারি চারটি, বেসরকারি সাতটি যৌথ বিনিয়োগে পাঁচটি কেন্দ্র রয়েছে, যেগুলোর মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা হবে ১৫ হাজার ৭৫২ মেগাওয়াট। তবে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের বেশির ভাগই অর্থায়ন, ভূমি অধিগ্রহণ পরিবেশগত ছাড়পত্র জটিলতায় যথাসময়ে কাজ শুরু করতে পারেনি। এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে শুধু পটুয়াখালীর পায়রায় নির্মিত হাজার ৩২০ মেগাওয়াট তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রেরই।

বিশ্বব্যাপী কয়লার দাম এখন বাড়তির দিকে। যেসব দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের ওপর নির্ভরতা বেশি, সেগুলোও এখন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকে দেখছে গলার কাঁটা হিসেবে। অবস্থায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লানির্ভরতা বাড়ালে তা বাংলাদেশের জন্যও কোনো সুফল বয়ে আনবে না বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের।

তারা বলছেন, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা এখন চাহিদার প্রায় দ্বিগুণ। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নির্মাণের আগে চাহিদার প্রক্ষেপণও করা হয়েছিল বাস্তবতার চেয়ে অনেক বেশি। ফলে অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্রকেই এখন বসিয়ে রাখতে হচ্ছে। ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত অর্থ। অন্যদিকে সঞ্চালন ব্যবস্থার ভঙ্গুরতার কারণে বর্তমান উৎপাদনকেও পুরোপুরি কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে না। শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধির বর্তমান ধারাও বলছে, আগামীতে বিদ্যুতের চাহিদা খুব বেশি বাড়ার সম্ভাবনা কম। অবস্থায় পরিকল্পিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতাও অব্যবহূতই থেকে যাবে। এর ধারাবাহিকতায় চাপ বাড়বে রাজস্বেও।

এছাড়া কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ব্যবসায়িকভাবেও খুব একটা লাভজনক হিসেবে দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, তিন বছর আগেও বিশ্বের ৪২ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র লোকসানে চলছিল বলে কার্বন ট্র্যাকারের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছিল। বর্তমানে কয়লার দাম ওই সময়ের তুলনায় আরো অনেক বেশি। কার্বন প্রাইসিংয়ের কারণে সামনের দিনগুলোয় ঊর্ধ্বমুখিতা অব্যাহত থাকবে। অবস্থায় ভবিষ্যৎ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো আরো অনেক বেশি লোকসানি হয়ে উঠবে বলে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

অন্যদিকে জ্বালানি পণ্যগুলোর মধ্যে পরিবেশে সবচেয়ে বেশি দূষণ ঘটায় কয়লা। কারণে বিশ্বব্যাপী এখন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে বেশ সোচ্চার আওয়াজ উঠেছে। প্রতিবেশী ভারতসহ অনেক দেশই এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লানির্ভরতা কমাচ্ছে। একই কথা প্রযোজ্য কয়লার বৃহত্তম ভোক্তাদেশ চীনের ক্ষেত্রেও।

বাংলাদেশেও এখন নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কয়লা থেকে সরে আসা নিয়ে আলোচনা চলছে। সম্প্রতি বিদ্যুৎ বিভাগের এক সমন্বয় সভায় হাজার ৪৬১ মেগাওয়াট ক্ষমতার নয়টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা থেকে সরে আসার বিষয়ে আলোচনা হয়। তবে নিয়ে এখনো সুনির্দিষ্ট কোনো ঘোষণা আসেনি।

বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বণিক বার্তাকে বলেন, যেসব কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র যথাসময়ে উৎপাদনে আসেনি সেগুলো নিয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আশা করছি বিষয়ে সুপরিকল্পিত একটি সিদ্ধান্ত আসবে।

গত বছরের ১৩ জানুয়ারি পায়রায় নির্মিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট চালু হয়। বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হয় মে মাসে। বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল) মালিকানাধীন কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট থেকে ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাণিজ্যিকভাবে দক্ষিণ অঞ্চলে সরবরাহ করা হয়। গত বছরের ২৫ আগস্ট উৎপাদনে আসে পায়রার দ্বিতীয় ইউনিট। তবে কেন্দ্রটি থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য প্রয়োজনীয় সঞ্চালন লাইন যথাসময়ে নির্মাণ করা যায়নি। কেন্দ্রে বর্তমানে প্রতিদিন ৩০ হাজার টন কয়লার প্রয়োজন হচ্ছে, যা ইন্দোনেশিয়া অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানি হচ্ছে। এদিকে দ্বিতীয় ইউনিটের নির্মাণ পরীক্ষামূলক উৎপাদন শেষের আট মাস পেরিয়ে গেলেও সেখান থেকে বিদ্যুৎ নিতে পারেনি পিডিবি। চাহিদা না থাকায় কেন্দ্রটির পূর্ণ সক্ষমতা ব্যবহার করাও সম্ভব হচ্ছে না।

২০১৪ সালে নানা আলোচনা-সমালোচনার পর শুরু হয় বাগেরহাটের রামপালে হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক আরেক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র। সুন্দরবনের কাছে হওয়ায় পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠনের আপত্তির মুখে প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়। বাংলাদেশ-ভারত ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফপিসিএল) অর্থায়নে নির্মিত প্রকল্পের প্রথম ইউনিট ২০২১ সালের শেষে উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে এবং দ্বিতীয় ইউনিট ২০২২ সালের প্রথম দিকে উৎপাদনে যাওয়ার কথা রয়েছে। যদিও এর আগে কয়েক দফা বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন তারিখ পিছিয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, রামপাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের বর্তমান অগ্রগতি ৭০ শতাংশ। দেরিতে হলেও প্রকল্প শেষের দিকে। তবে কভিড-১৯ মহামারীতে বিদ্যুৎকেন্দ্রে কর্মরত ভারতীয় শ্রমিকদের অনেকে করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় কেন্দ্র উৎপাদনে আসা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

সম্প্রতি ঢাকা সফরকালে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছেন। অন্যদিকে ইউনেস্কোও ২০১৮ সাল থেকে রামপাল প্রকল্প নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছে।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, পায়রা রামপালে একই উৎপাদন সক্ষমতার পাশাপাশি পায়রায় ওই কেন্দ্রের অনতিদূরে রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড বা আরপিসিএল-নরিনকোর যৌথ উদ্যোগে আর একটি হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করবে সরকার। সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী প্রকল্পের জন্য পুনর্বাসন, বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। ইপিসি ঠিকাদারের আওতায় গত বছরের শেষের দিকে কাজ হস্তান্তর করা হয়েছে। তবে এখনো কাজ শুরু করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কোম্পানি। কভিডের কারণে প্রকল্প থমকে আছে।

এছাড়া কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিপিজিসিএল) আওতায় কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে হাজার ২০০ মেগাওয়াট আরো একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এরই মধ্যে প্রকল্পটির ৫০ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে। পুনর্বাসন কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে প্রায় শতভাগ। তবে গত বছরে করোনা মহামারী শুরু হওয়ায় প্রকল্পে ধীরগতি নেমে আসে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ব বিভাগের অধ্যাপক বদরুল ইমাম বণিক বার্তাকে বলেন, দেশে এত বেশি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কোনো প্রয়োজন নেই। আমাদের এখনো বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বেশি, বিদ্যুৎ আমদানিও করছি। ফলে পরিবেশের ক্ষতি করে এমন প্রকল্প থেকে এখন বেরিয়ে আসতে হবে। উন্নত বিশ্ব কয়লা থেকে সরে আসছে। আমাদেরও বিকল্প উপায় থাকলে বেরিয়ে আসতে হবে।

রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রসঙ্গ তুলে ধরে বদরুল ইমাম বলেন, রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াট যে বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে, এখন ধরনের প্রকল্পের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। এটি বাদ দিলেও সরকারের কোনো ক্ষতি নেই। প্রকল্প যখন হাতে নেয়া হয়েছিল তখন বলা হয়েছিল উন্নয়নের জন্য আমাদের অনেক বেশি বিদ্যুৎ দরকার। কিন্তু প্রকল্প যথাসময়ে উৎপাদনে আসতে পারেনি। বরং কয়লায় বিনিয়োগ না করে সেই অর্থ দিয়ে কীভাবে তেল গ্যাস অনুসন্ধান করা যায় সেটিই ভালো।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন