চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনাকাটায় অনিয়ম

অর্থ পরিশোধে ৩৪৩ কোটি টাকা পেল সিএমএসডি

মেসবাহুল হক

স্বাস্থ্য খাতের কেনাকাটায় অনিয়ম-দুর্নীতি থেমে ছিল না কভিড-১৯ পরিস্থিতিতেও। দেশে নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরু থেকে গত বছরের জুন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) পিপিই-মাস্কসহ বিভিন্ন সুরক্ষাসামগ্রী চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনাকাটায় অন্তত ৭২১ কোটি টাকার অনিয়ম হয়েছে। আর অর্থ পরিশোধে আপাতত ৩৪৩ কোটি ২৯ লাখ ৯৭ হাজার টাকা ছাড় করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।

সূত্রটি বলছে, কেবল যে আর্থিক খাতে অনিয়ম হয়েছে তা- নয়, অনিয়ম হয়েছে সংশ্লিষ্ট প্রায় সব ক্ষেত্রে। গত জুন পর্যন্ত এসব কেনাকাটায় কোনো নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড জারি করা হয়নি। কার্য সম্পাদন জামানত বা সরবরাহ চুক্তি সম্পাদন করা হয়নি। এমনকি ক্রয় প্রস্তাব অনুমোদন চুক্তি স্বাক্ষর ছাড়াই সরবরাহ আদেশ দেয়া হয়, যা বিধিসম্মত নয়। সরবরাহ আদেশে সরবরাহের নির্দিষ্ট সময়সীমা উল্লেখ করা হয়নি। সংশ্লিষ্ট সামগ্রীর পরিমাণ উল্লেখ করা হলেও নির্ধারিত কোনো একক মোট মূল্য উল্লেখ করা হয়নি। এসব কেনাকাটায় কোনো শর্ত যুক্ত করা হয়নি। এসব কার্যাদেশের বিপরীতে অনেক ক্ষেত্রে জরিপ ছাড়াই বিভিন্ন পণ্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ক্রয় কার্যক্রম সম্পাদনের জন্য তখন কোনো বাজেট বরাদ্দও নিশ্চিত করা হয়নি।

২০১৯-২০ অর্থবছরে পিপিই-মাস্কসহ বিভিন্ন সুরক্ষাসামগ্রী চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনাকাটায় অন্তত ৭২১ কোটি টাকার অনিয়মের কথা সিএমএসডি স্বীকার করেছে। নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে দেয়া এসব ক্রয়াদেশের বিপরীতে পণ্যসামগ্রী সরবরাহ করা প্রতিষ্ঠানগুলো এখন অর্থ পেতে সিএমএসডিকে চাপ দিচ্ছে। তাই এর সমাধান চেয়ে সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে চিঠি দেয় সিএমএসডি কর্তৃপক্ষ। পরিপ্রেক্ষিতে ১২ এপ্রিল পণ্যসামগ্রী সরবরাহ করা প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থ পরিশোধ করতে ৩৪৩ কোটি ২৯ লাখ ৯৭ হাজার টাকা ছাড় করা হয়েছে।

সিএমএসডির ওই চিঠিতে বলা হয়, কভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারী হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পর পরই স্বাস্থ্য পরিস্থিতি মোকাবেলায় সিএমএসডি বিভিন্ন সুরক্ষাসামগ্রী চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনে। গত বছরের জুন সিএমএসডির বর্তমান পরিচালক দায়িত্ব নেন। এর আগ পর্যন্ত সে সময়ের পরিচালক হাজার ২৮৫ কোটি ২২ লাখ ৪১ হাজার টাকা প্রাক্কলিত মূল্যে ১৯৬টি প্যাকেজের আওতায় বিভিন্ন কভিড-১৯ সামগ্রী কেনার পরিকল্পনা নেন। এর মধ্যে ৩৪৪ কোটি ১১ লাখ ৫৭ হাজার টাকা চুক্তিমূল্যে ৫৭টি প্যাকেজের দরপত্র মূল্যায়ন প্রতিবেদন অনুমোদনের জন্য স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে পাঠানো হয়। আর কোটি ৪৯ লাখ ২০ হাজার টাকা চুক্তিমূল্যে দুটি প্যাকেজের দরপত্র মূল্যায়নের জন্য পাঠানো হয়নি।

অন্যদিকে ৩৭১ কোটি ১৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা প্রাক্কলিত মূল্যের ৫৮টি প্যাকেজের দর প্রস্তাব পাওয়া গেলেও সেগুলোর দরপত্র মূল্যায়ন করা হয়নি। এর পরও এসব প্যাকেজের আওতায় কোনো কোনো সামগ্রী আংশিক বা সম্পূর্ণ সরবরাহ করা হয়েছে। চিঠির তথ্য অনুযায়ী সর্বমোট ৭২০ কোটি ৭৫ লাখ ৫৭ হাজার টাকা মূল্যের সুরক্ষাসামগ্রী চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনার সময় কোনো ধরনের নিয়ম-নীতি বিবেচনায় নেয়া হয়নি। এমনকি এসব পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে বরাদ্দের জন্য সম্মতিও চাওয়া হয়নি।

প্রসঙ্গে এপ্রিল স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগে একটি চিঠি পাঠানো হয়। সেখানে বলা হয়, কভিড-১৯ মোকাবেলায় সাপ্লাই চেইন অব্যাহত রাখার স্বার্থে ২০১৯-২০ অর্থবছরে দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনতে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতি বেছে নেয়া হয়। মোট হাজার ২৮৫ কোটি ২২ লাখ ৪১ হাজার টাকায় ১৯৬টি প্যাকেজের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে সিএমএসডি মালাপত্র সংগ্রহ করে। এর মধ্যে ৫৭টি প্যাকেজ বাবদ ৩৪৩ কোটি ২৯ লাখ ৯৭ হাজার টাকার দরপত্র মূল্যায়ন প্রতিবেদন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে পাঠানো হয়েছে। ৫৭টি প্যাকেজের বিল বাবদ ৩৪৩ কোটি ২৯ লাখ ৯৭ হাজার টাকার অর্থ বিভাগের ভূতাপেক্ষ সম্মতি প্রয়োজন।

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের চিঠিতে আরো বলা হয়, ২০১৯-২০ অর্থবছরের ৫৭টি প্যাকেজের বিলের জন্য ৩৪৩ কোটি ২৯ লাখ ৯৭ হাজার টাকা ২০২০-২১ অর্থবছরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবেলায় সিএমএসডি কর্তৃক সংগৃহীত মালাপত্রের বিল পরিশোধ বাবদ পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দিতে অনুরোধ করা হলো। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে চলতি অর্থবছরে করোনা মোকাবেলায় চিকিৎসা শল্য চিকিৎসা সরঞ্জামাদি ক্রয় খাতে সিএমএসডির অনুকূলে বরাদ্দ দেয়া হলো। এতে আরো বলা হয়, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় অর্থ বিভাগের বাজেট থেকে অর্থ দেয়া হলো। তবে অর্থ ব্যয়ে বেশকিছু শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে।

শর্তগুলো হচ্ছে অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে দ্য পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অ্যাক্ট-২০০৬ দ্য পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস-২০০৮ অনুসরণসহ যাবতীয় আর্থিক বিধি-বিধান যথাযথভাবে মেনে চলতে হবে। এছাড়া ক্রয় প্রক্রিয়ায় ঠিকাদারের সুবিধাভোগী সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ তা নিরীক্ষার জন্য যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। অর্থ প্রস্তাবিত খাত ছাড়া অন্য কোনো খাতে ব্যয় করা যাবে না এবং বরাদ্দ চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে সমন্বয় করতে হবে।

বিষয়ে জানতে চাইলে সিএমএসডির পরিচালক আবু হেনা মোরশেদ জামান বণিক বার্তাকে বলেন, চলতি বাজেটে অর্থ ছাড় করা হয়েছে। তবে কেনাকাটার অনিয়ম বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে তিনি রাজি হননি। অর্থ বিভাগে পাঠানো চিঠিতে কেনাকাটায় অনিয়মের কথা উল্লেখ করা হলেও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করেনি সিএমএসডি। বণিক বার্তার পক্ষ থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের নাম জানতে চাওয়া হলে তা বলতে রাজি হননি সিএমএসডি পরিচালক।

সিএমএসডির চিঠিতে বলা হয়, সে সময় পিপিআর-২০০৮ অনুসারে সরকারি ক্রয় পদ্ধতির (ডিপিএম) প্রাথমিক প্রক্রিয়া যেমন ক্রয় প্রস্তাবে ক্রয়কারী কার্যালয় প্রধানের অনুমোদন, আনুষ্ঠানিক দর কষাকষি, দরপত্র বা প্রস্তাব মূল্যায়ন কমিটির সভা করা; এসব অনুসরণ করা হয়নি। বিপুল অংকের আর্থিক সংশ্লিষ্টতা থাকলেও পিপিআরের বিধান অনুসরণ করে আর্থিক ক্ষমতা অর্পণ আদেশ অনুযায়ী প্রযোজ্য যথাযথ ক্রয় অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষের অনুমোদনও নেয়া হয়নি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন