চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায় নির্মাণাধীন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে পাঁচ শ্রমিক নিহত হয়েছেন। গতকাল দুপুরে গণ্ডামারা ইউনিয়নের পশ্চিম বড়ঘোনায় এসএস পাওয়ার প্লান্টে এ ঘটনা ঘটে। এ সময় আরো অন্তত ২৫ জন আহত হয়েছেন।
বাংলাদেশের এস আলম গ্রুপ, চীনা কোম্পানি সেপকোল ইলেকট্রিক কনস্ট্রাকশন করপোরেশন ও এইচটিজি ডেভেলপমেন্ট গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেডের যৌথ মালিকানায় নির্মাণ করা হচ্ছে কয়লাভিত্তিক এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি।
কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশ কিছুদিন ধরে বেতন-ভাতা পরিশোধ, শ্রমঘণ্টা কমিয়ে আনা, কর্মপরিবেশ উন্নত করাসহ বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন করছিলেন তারা। কিছুদিন আগেও বাংলাদেশী শ্রমিকরা তাদের কিছু দাবি চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে জমা দেয়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কয়েকটি দাবি মেনে নিলেও শ্রমিকরা তাতে সন্তুষ্ট হননি। গতকাল দুপুরে দাবি আদায়ে আবারো বিক্ষোভ শুরু করেন শ্রমিকরা। একপর্যায়ে কেন্দ্রের নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ বেধে যায়। শ্রমিকদের ইট-পাটকেলের বিপরীতে পুলিশ গুলি চালায়। এতে ঘটনাস্থলে চার শ্রমিক নিহত হন। গুরুতর আহত অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে সেখানে এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়।
পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, শুক্রবার থেকেই বেতন-ভাতা ও বিভিন্ন ইস্যুতে ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রের শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ শুরু হয়। সেদিন এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সভাও করেন শ্রমিক নেতারা। কিন্তু কোনো সুরাহা না হওয়ায় শ্রমিকরা গতকাল সকাল থেকে বিক্ষোভ শুরু করেন। এক পর্যায়ে বিদেশী শ্রমিক, পুলিশ ও প্লান্টের ওপর হামলা শুরু করেন তারা। বেশকিছু স্থাপনা, যানবাহন ও অবকাঠামো ভাংচুর করে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। আত্মরক্ষায় ও শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করতে তখন গুলি ছোড়েন বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা। এতে এ হতাহতের ঘটনা ঘটে।
তবে এ বিষয়ে পুরোপুরি অবগত নয় বিদ্যুৎকেন্দ্রটির বাংলাদেশী অংশীদার এস আলম গ্রুপ। ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক সুব্রত কুমার ভৌমিক বণিক বার্তাকে বলেন, বাঁশখালী বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে এস আলম গ্রুপের মালিকানা থাকলেও প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এ প্রকল্পে কয়েক হাজার শ্রমিক নিয়োজিত। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শ্রমিকদের দেনা-পাওনা নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। তবে এ বিষয়ে এস আলম গ্রুপ পুরোপুরি অবগত নয় বলে জানান তিনি।
বিকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মমিনুর রহমান ও চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন। জেলা প্রশাসক জানান, নিহত শ্রমিকদের প্রতি পরিবারকে তিন লাখ টাকা করে দেয়া হবে। আহতরা পাবেন ৫০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ।
সম্পূর্ণ আমদানিনির্ভর কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে এ কেন্দ্রটি নির্মাণে সরকারের সঙ্গে ২০১৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি চুক্তি হয়। একই বছরের এপ্রিলে ভূমি অধিগ্রহণসহ বিভিন্ন দ্বন্দ্বে গ্রামবাসীর সঙ্গে সংঘর্ষে চারজনের মৃত্যু হয়। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির সিংহভাগ অর্থাৎ ৭০ শতাংশের মালিকানা এস আলম গ্রুপের ছয়টি কোম্পানির। বাকি ৩০ শতাংশের মালিক চীনা দুই প্রতিষ্ঠান। এ কেন্দ্রের সর্বোচ্চ উৎপাদন ক্ষমতা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট (দুটি প্লান্ট)। তবে নেট সক্ষমতা ধরা হয়েছে ১ হাজার ২২৪ মেগাওয়াট। বাংলাদেশে চীনা প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ এ বিনিয়োগে সর্বমোট ব্যয় হচ্ছে ২ হাজার ৪৮৭ দশমিক ৮৭ মিলিয়ন ডলার। এ প্রকল্পে চায়না ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, ব্যাংক অব চায়না ও চায়না কনস্ট্রাকশন ব্যাংকের মোট বিনিয়োগ ১ হাজার ৭৫৯ দশমিক শূন্য ৭ মিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখনো অর্ধেক কাজই শেষ করতে পারেনি চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এ কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সরাসরি কেনার কথা রয়েছে।
গতকালের ঘটনায় নিহতরা হলেন আহমদ রেজা (১৮), রনি হোসেন (২২), শুভ (২৪), মো. রাহাত (২৪) ও মো. রায়হান (২৫)।
সংঘর্ষে অন্তত ২৫ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে ১১ জনকে চমেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তারা হলেন হাবিব উল্লাহ (২১), মো. রাহাত (৩০), মো. মিজান (২২), মো. মুরাদ (২৫), মো. শাকিল (২৩), মো. কামরুল (২৬), মাসুম আহমদ (২৪), আমিনুল হক (২৫), মো. দিদার (২৩), ওমর (২০) ও অভি (২২)। এছাড়া গণ্ডামারা পুলিশ ফাঁড়ির তিন সদস্যও আহত হয়েছেন। তারা হলেন ইয়াসির (২৪), আব্দুল কবির (২৬) ও আসাদুজ্জামান (২৩)।
বিদ্যুৎকেন্দ্রে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে আহত ও নিহত হওয়ার ঘটনায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ও পুলিশের পক্ষ থেকে আলাদা দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের গঠিত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সুমনী আক্তার। চার সদস্যের এ কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কবির আহম্মেদ, কল-কারখানা অধিদপ্তর চট্টগ্রামের লেবার পরিদর্শক মাসুদ রানা, বিদ্যুৎ বিভাগ চট্টগ্রামের সহকারী প্রধান প্রকৌশলী অভিজিৎ কুরি। কমিটিকে আগামী তিন কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত ডিআইজি জাকির হোসেনকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা পুলিশ। কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন পুলিশ সুপার নেছার আহমেদ ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কবির হোসেন। এ কমিটি আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেবে।