সামনের দিনে বিদেশী বিনিয়োগের নতুন ক্ষেত্র ও সম্ভাবনা তৈরি হবে। সেই বাজারে প্রবেশের জন্য বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (বিডা) আরো শক্তিশালী ও সক্ষম করে তুলতে হবে। কার্যক্রম পরিচালনায় প্রতিষ্ঠানটির অন্যের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরতা দৈন্যের বহিঃপ্রকাশ। এজন্য বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা ও বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে নীতি কাঠামোয় সংস্কার প্রয়োজন। এছাড়া দেশের ব্যবসা পরিচালনায় কর কাঠামোর সংস্কার ছাড়াও কালো টাকা বা অপ্রদর্শিত আয় বন্ধ করা প্রয়োজন।
গতকাল ‘এফডিআই ফর এক্সপোর্ট ডাইভারসিফিকেশন অ্যান্ড স্মুথ এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন’
শীর্ষক ওই ওয়েবিনারে এসব কথা বলেন। যৌথভাবে এ ওয়েবিনার আয়োজন করে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ), দ্য
এশিয়া ফাউন্ডেশন ও রিসার্চ পলিসি ইনটিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড)। ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। ইআরএফ সাধারণ সম্পাদক এসএম রাশিদুল ইসলামের সঞ্চালনায় ওয়েবিনারে এ সময় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশনের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ কাজী ফয়সাল বিন সিরাজ, র্যাপিডের নির্বাহী পরিচালক ড. এম আবু ইউসুফ প্রমুখ।
ওয়েবিনারে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম বলেন, বিনিয়োগ বোর্ডের যে ধরনের ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন, সেটি এখনো দেয়া হয়নি। বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য টিকার ব্যবস্থার কথাসংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের চিঠি দিয়ে জানানোর পর আজও পাইনি। এভাবে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষাহীনতায় থাকলে দেশে বিনিয়োগ আনার সুযোগ সংকুচিত হবে। তারা এই টিকা পেলে তো ইতিবাচক বার্তা যেত। ব্যবসাসংক্রান্ত মামলা পরিচালনার জন্য নীতিগতভাবে দুটি আলাদা আদালত স্থাপন করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামে কার্যক্রম শুরু হবে শিগগিরই।
র্যাপিডের চেয়ারম্যান ড. এমএ রাজ্জাক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে বলেন, প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগ অনেক কম। বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগ এসেছে ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অথচ একই সময়ে কম্ব্বোডিয়ায় এ বিনিয়োগের পরিমাণ ৩৪ বিলিয়ন ডলার, ভিয়েতনামে ১৬১ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশে বার্ষিক বিদেশী বিনিয়োগের প্রবাহ জিডিপি মাত্র ১ শতাংশের মতো। আর ভিয়েতনামে তা প্রায় ৬ শতাংশ। প্রত্যাশিত বিদেশী বিনিয়োগ না আসার পেছনে ব্যবসা সহজ সূচকে পিছিয়ে থাকাই অন্যতম কারণ।
তিনি আরো বলেন, এলডিসি থেকে উত্তরণ তথা উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতির পথে বাংলাদেশ আগামী পাঁচ বছর রফতানিতে বিদ্যমান সুযোগ পেতে যাচ্ছে। এ সময়ের মধ্যেই ইউরোপ, কানাডাসহ বড় বাজারগুলোতে রফতানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা ধরে রাখতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। অন্যদিকে বিনিয়োগ আকর্ষণে চলমান সীমাবদ্ধতা দ্রুত সমাধান করে বিশেষত ব্যবসা সহজ করার সূচকে উন্নতি করার পরামর্শ দেন তিনি। বিদেশীরা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের এ সূচকটিকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেন। এছাড়া চীন থেকে সরে আসা বিনিয়োগ ধরতে উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ দেন।
প্যানেল আলোচক হিসেবে এমসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, বিনিয়োগ আকর্ষণে বিদ্যমান কর ব্যবস্থা অন্যতম বাধা। বর্তমান কর প্রদান পদ্ধতি ব্যবসাবান্ধব নয়। এটি ঠিক না হলে বিদ্যমান ব্যবসাই থাকবে না, নতুন ব্যবসা তো দূরের কথা। এনবিআরকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, তার চেয়ে বলুন, আপনারা বিনিয়োগ চান না। বিনিয়োগ আকর্ষণে এলোমেলো চিন্তা না করে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘ব্রাশফায়ার শুট নয়, স্নাইপার শুট’
লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে হবে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে জনস্বাস্থ্য, কৃষি, হালকা প্রকৌশল খাত, নন কটন তৈরি পোশাক পণ্যে গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেন, অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে করহার অনেক বেশি। এ সময় সরকারের কালো টাকা বিনিয়োগের প্রসঙ্গও তোলেন তিনি। বলেন, কর না দিলে সাড়ে ২২ শতাংশ লাভ। কেননা কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ থাকায় কর দিতে হয় মাত্র ১০ শতাংশ। তাহলে বোকার মতো কেন ট্যাক্স দেব?
এছাড়া কালো টাকা পুঁজিবাজার ও আবাসন খাতে বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, কালো টাকা পুঁজিবাজারে ঢোকার পর ২০১০ সালে কী হলো? আমরা কী আবারো সেই পথে যাচ্ছি? পুঁজিবাজার ও আবাসনে না দিয়ে এ সুযোগ স্বাস্থ্য খাত, অবকাঠামোসহ এ ধরনের খাতে দেয়া এবং বিনিয়োগ আকর্ষণে তৈরি পোশাক খাতের বাইরে অন্যান্য খাতকেও সমান সুবিধা দেয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
ব্যবসাসংক্রান্ত মামলার বিষয়ে দীর্ঘসূত্রতা তুলে ধরে এমসিসিআইয়ের সভাপতি ব্যারিস্টার নিহাদ কবীর বলেন, আমার পরিবারের একটি মামলা ১৯৬২ সালে শুরু হয়, যা ১৯৯৬ সালে শেষ হয়েছে। একটি মামলা শেষ হতে যদি এত দিন সময় লাগে, তাহলে কীভাবে সমাধান আসবে। সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর সমন্বয়হীনতা ও অদূরদর্শিতার একাধিক উদাহরণ তুলে ধরে টার্গেটেড পলিসি নিতে হবে বলে মত দেন তিনি।