পাঠকের কলাম

প্রত্নস্থল সংরক্ষণে স্থানীয়দের অন্তর্ভুক্ত করা কি জরুরি নয়?

ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অন মনুমেন্টস অ্যান্ড সাইটস (ICOMOS) ১৯৮২ সাল থেকে বিভিন্ন দেশের ঐতিহ্য রক্ষা করার উদ্দেশ্যে প্রতি বছরের ১৮ এপ্রিলবিশ্ব ঐতিহ্য দিবসপালন করে আসছে। ২০২১ সালের বিশ্ব ঐতিহ্য দিবসের প্রতিপাদ্য হলো Complex pasts, Diverse futures থিমটিকে বাংলায় বলা যেতে পারেদুরূহ অতীত, বৈচিত্র্যময় ভবিষ্যৎ

বৈচিত্র্যময়শব্দটি শুনলেই সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের কথা মনে পড়ে যায়। সাংস্কৃতিক প্রাকৃতিক ঐতিহ্যে ভরপুর দেশ, যা বহুকাল ধরে অসংখ্য ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। পরম্পরাগতভাবে বা উত্তরাধিকার সূত্রে নিজস্ব সংস্কৃতিকে লালন করার মাধ্যমে টিকিয়ে রাখাই হলো সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগত পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ বৈচিত্র্যময় এবং সমৃদ্ধিশালী হলেও প্রকৃত অর্থে দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, বিশেষত প্রত্নস্থানগুলো মারাত্মকভাবে হুমকির সম্মুখীন। সরকারি পর্যায়ে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর দেশের ৫২৪টি প্রত্নস্থলকে সংরক্ষণ করেছে (তথ্যসূত্র: বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর) এর পরেও কেন আমাদের দেশের প্রত্নস্থলগুলো এখন পর্যন্ত নিরাপদ নয়

ছোট্ট -দ্বীপে প্রায় ১৭ কোটি মানুষের বাস, যার মধ্যে অনেকেই প্রত্নস্থলগুলোর আশেপাশেই বাস করে। প্রত্নস্থলগুলোর সঙ্গে স্থানীয়দের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, একটি প্রত্নস্থল সংরক্ষণের ক্ষেত্রে স্থানীয়দের অন্তর্ভুক্ত করা হবে নাকি তাদের উচ্ছেদ করা হবে? আর একটি বিষয় বোঝা জরুরি যে প্রত্নস্থলগুলো কি প্রকৃত অর্থেই সংরক্ষিত, নাকি নামেমাত্র কাগজে-কলমে সংরক্ষিত? যদি প্রকৃত অর্থেই সংরক্ষিত হয়ে থাকে, তাহলে ক্রমান্বয়ে স্থাপনাগুলো কেন হুমকির সম্মুখীন? আমাদের দেশে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই রাষ্ট্র নির্ধারিত কিছু আইন রয়েছে। আইনগুলো করার কারণ দেশের যাবতীয় ক্ষেত্রগুলো যেন সুনির্দিষ্টভাবে রক্ষিত থাকে। যেমন প্রত্নস্থল প্রত্নবস্তু সংরক্ষণের জন্যবাংলাদেশ প্রত্নসম্পদ আইন ১৯৬৮রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রত্নসম্পদ সংরক্ষণের ঘোষণার ক্ষেত্রে ব্রিটিশ শাসনামলের Ancient Monuments Preservation Act, 1904 (VII of 1904) অনুসরণ করা হয়। দেশ স্বাধীনের ৫০ বছর পার হলেও আইনগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন আসেনি। যাই হোক, সেই আইন অনুসারে কতটা কাজ করা হয়, তা বর্তমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগুলো পরিদর্শন করলেই চোখে পড়ে।

একটা বিষয় মনে রাখা জরুরি যে, কোনো স্থানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য লালন-পালন ধারণ করে সে স্থানের স্থানীয় মানুষ। তাই যেকোনো প্রত্নস্থলের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে স্থানীয়দের অন্তর্ভুক্তিকরণের ওপর অধিকতর গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। কারণ তারাই সে অঞ্চলের ঐতিহ্য প্রতিনিয়ত লালন করে। প্রত্নস্থলগুলোকে টেকসই পরিকল্পনার মাধ্যমে সংরক্ষণ করতে হলে অবশ্যই স্থানীয়দের প্রত্নস্থল সংরক্ষণের ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থান মহাস্থানগড়। এটি কোনো একক প্রত্নস্থল নয়, বরং বিশাল এলাকাজুড়ে এর বিস্তৃতি রয়েছে, যেগুলোর আশেপাশে এবং অভ্যন্তরে অসংখ্য মানুষের বসবাস। অন্যদিকে বরেন্দ্রভূমির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থান রয়েছে সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার ধামাইনগর ইউনিয়নের ক্ষিরতলা গ্রামে। যদিও ক্ষীরতলার প্রত্নস্থলগুলোর পরিপ্রেক্ষিত এখনো সুপ্তই রয়েছে, যেহেতু সেখানে শুধু একটি ঢিবিকে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক সংরক্ষণ করা হয়েছে। কিন্তু কোনো ধরনের প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়নি। রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বাংলাদেশ অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা গত তিন বছর ধরে বিভাগের শিক্ষক মো. রিফাত-উর-রহমানের নেতৃত্বে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি অনুসরণ করে ক্ষিরতলায় প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ অনুসন্ধান পরিচালনা করে আসছে। অনুসন্ধানে লক্ষ করা গেছে যে ক্ষিরতলা গ্রামের প্রত্নস্থলগুলোর আশেপাশে স্থানীয়রা বাস করে। প্রচুর পরিমাণে প্রাচীন ইট পাওয়া যায় গ্রামে, যেসব দিয়ে স্থানীয়রা তাদের বাড়ি নির্মাণ করে। অন্যদিকে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে মহাস্থানগড়ের পরশুরামের ভিটা পরিদর্শন করে লক্ষ করা গেছে যে স্থানীয় একটি পরিবার সেখানে প্রাপ্ত প্রাচীন ইট দিয়ে তাদের ঘর বানিয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ করা হয়, ‘স্থানীয়রা প্রতিনিয়ত প্রত্নস্থলের ধ্বংসাবশেষের ইট মাটি তাদের ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করে প্রত্নস্থলগুলো ধ্বংস করছে।

প্রশ্ন হলো, প্রত্নস্থল সংরক্ষণের নামে যুগ যুগ ধরে বসবাসরত স্থানীয়দের স্থান ত্যাগে বাধ্য করে কি দেশের ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা হবে নাকি তাদেরকে সংরক্ষণ কর্মযজ্ঞে অন্তর্ভুক্ত করে প্রত্নস্থল সংরক্ষণ করা হবে? অনেকেই প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারেন, দেশের আইন, ইউনেস্কো নীতিমালা, ভেনিস সনদ, নারা সনদ ইত্যাদির কার্যকর বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রত্নস্থলগুলো সংরক্ষণ করা উচিত। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের শিক্ষার্থী হিসেবে আমি মনে করি, প্রতিটি দেশের প্রতিটি সংস্কৃতির নিজস্ব মৌলিকত্ব রয়েছে। অতীত সংস্কৃতি সংরক্ষণের নামেলিভিং হেরিটেজ’-কে ধ্বংস করা ঠিক নয়। সংরক্ষণ করতে হলে অবশ্যই আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে নির্মিত বাস্তবসম্মত কার্যকর আইনের প্রয়োগ ঘটাতে হবে।   

সামান্য কিছু অর্থ হাতে গুঁজে দিয়ে স্থানীয়দের ভূমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে একটি সাইনবোর্ড টানিয়ে প্রত্নস্থল শুধু কাগজি দলিলে সংরক্ষিত থাকে। বাস্তবে এর চিত্র ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। যেমন ক্ষিরতলা গ্রামে স্থানীয়রা জানেই না যে প্রত্নসম্পদগুলোর অন্যতম প্রধান স্টেকহোল্ডার তারাও। বোধ তাদের মধ্যে সঞ্চারিত না করলে তারা কীভাবে প্রত্নস্থল সংরক্ষণে উদ্বুদ্ধ হবে? তাদের পথে বসিয়ে দিয়ে যদি প্রত্নস্থান সংরক্ষণ করা বলে তাহলে দরকার নেই সংরক্ষণের। যেমন মহাস্থানগড়ে বেহুলার বাসরঘর নামে পরিচিত গোকুল মেড়। বেহুলার বাসরঘর নিয়ে নানান লোকসংস্কৃতি গড়ে ওঠেছে যুগ যুগ ধরে। যে সংস্কৃতি সম্পর্কে শুধু স্থানীয়রাই পূর্ণাঙ্গভাবে অবগত। অন্যদিকে ক্ষিরতলার প্রত্নস্থলগুলো জুড়ে অসংখ্য নৃগোষ্ঠীর বসবাস, তাদের দৃষ্টিতেবিরাট রাজার ঢিবিনামে পরিচিত প্রত্নস্থানের গুরুত্ব অপরিসীম।

প্রথাগত ঔপনিবেশিক আদলে নির্মিত সংরক্ষণ নীতিমালার মাধ্যমে একদিকে প্রত্নস্থলগুলোর বিলুপ্তি ঘটছে এবং অন্যদিকে স্থানীয়দের সংস্কৃতিকেও ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলা হচ্ছে। একই সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে প্রত্নস্থানভিত্তিক স্থানীয় জনশ্রুতি মৌখিক ইতিহাস। অতীত এবং বর্তমান সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিত দুটোর সংযোগ স্থাপন না করে শুধু পুরনো আইন দিয়ে আমাদের প্রত্নস্থলগুলো সংরক্ষণ করা মোটেও সম্ভব নয়। আমরা কি পারি না স্থানীয়দের প্রত্নস্থানগুলো সংরক্ষণের কাজে নিযুক্ত করতে? মায়ের ভাষা যেমন কেবল মা- বলতে পারে, ঠিক তেমনি নিজেদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গুরুত্বের বিষয়টি কেবল নিজের মানুষরাই বুঝিয়ে বলতে পারে। কারণ সেই বোঝানোর মধ্যে থাকে ত্যাগ, ভালোবাসা, ভালো লাগা, আবেগ অনুভূতির কথা।

 

সাদিয়া আরেফিন: শিক্ষার্থী, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বাংলাদেশ অধ্যয়ন বিভাগ, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন