জন্মদিন

একজন মনের মানুষ

আব্দুল বায়েস

লাতিন আমেরিকার বিখ্যাত উপন্যাসিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের অন্যতম প্রণিধানযোগ্য একটা উক্তি রকম—‘এটা সত্যি নয় যে মানুষ বুড়ো হয়ে যায় বলে স্বপ্নের পেছনে ছোটা বন্ধ করে; বরং সত্যি এটা যে স্বপ্নের পেছনে ছোটে না বলেই তারা বুড়ো হয়। পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ আছেন, যারা স্বপ্ন দেখেন এবং স্বপ্ন দেখাতে ভালোবাসেন। সময়ের সঙ্গে তাদের বয়স বাড়ে সত্যি, কিন্তু স্বপ্ন দেখা কিংবা দেখানো বন্ধ হয় নাএক অর্থে তারা স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। আর তাই দেহে না হলেও অন্তত মনেপ্রাণে মানুষগুলো চিরনবীন থেকে যান।

এমন এক স্বাপ্নিক বিরল ব্যক্তিত্ব হলেন সবার শ্রদ্ধেয়, মনের মানুষ মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনবিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য।

আজ তার ৭৮তম শুভ জন্মদিনের মুহূর্তে তাকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানাই।

দুই। ১৯৪২ সালের ১৮ এপ্রিল হবিগঞ্জের রতনপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম এবং শিশু কৈশোরকাল। মেঠো পথ, ছনের ঘর, কুপি কিংবা হ্যারিকেনের আলোয় পথ চলা, সর্বত্র সনাতনী কৃষি কর্মকাণ্ড, হাওরের হুতাশ, দারিদ্র্যের দহনে নিপতিত এক বিরাট জনগোষ্ঠী ইত্যাদি মিলিয়ে চারপাশে প্রতিকূল পরিবেশের মধ্য দিয়ে তার প্রতিভার বিকাশ। তারপর সিলেট এমসি কলেজ হয়ে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিষয়ে পড়তে আসা। দীর্ঘ পথ পরিভ্রমণের প্রতিটি পয়েন্টে তিনি তার মেধা প্রতিভার জোরে চিত্তাকর্ষক ফলাফল ঘরে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি শুধু যে মেধাবী ছিলেন তা নয়, কারণ মেধাবী বলেই কেউ মানুষ হয় না, মানবতাবোধ সর্বদা বিরাজ করত তার পরানের গহিনে। বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন শেষে বিদেশে থেকে যাওয়ার প্রচুর সুযোগ থাকার পরও কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে দেশে ফিরেছিলেন বোধ করি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে স্মরণ করে—‘ মা, অনেক তোমার খেয়েছি গো, অনেক নিয়েছি মা, তবু জানি নে-যে কী বা তোমায় দিয়েছি মা। অনুমান করি, জনম বৃথা কাজে ব্যয় করতে চাননি বলেই ঘরের ছেলের ঘরে ফেরা।

তিন। পরবর্তীকালে মানবতাবোধ, মেধা মননে সিদ্ধ মানুষটি প্রশাসক, শিক্ষক সংগঠক হিসেবে বহু গুরুত্বপূর্ণ পদ অলংকৃত করেছেন। করেছেন বলছি কেন, বয়সেও করে চলেছেন। কবি কামরুল হাসানের কথায়, দেশের অর্থনীতি নিয়ে যাদের কাজকারবার তাদের কাছে তিনি দেশের একজন শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদ, সহপাঠী শিক্ষকরা জানেন তিনি ব্যাচের সেরা ছাত্র, ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট; প্রশাসনের সর্বস্তরে তিনি পরিচিত একজন দক্ষ মেধাবী সচিব হিসেবে, রাজনীতির পরিমণ্ডলে তার পরিচিতি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ তার আদর্শের একজন যোদ্ধা হিসেবে, সমাজের কাছে তার পরিচয় একজন দেশদরদি সমাজসেবক হিসেবে, ছাত্রছাত্রীদের কাছে তিনি পরিচিত একজন জ্ঞানদীপ্ত, আকর্ষণীয় শিক্ষক ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির একজন প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে।

চার। তবে দু-একটা কীর্তির কথা না বললে যে মন ভরে না। তার ভাগ্য ভালো যে কর্মজীবনের প্রায় শুরুতেই তিনি এক স্বপ্নদ্রষ্টার খুব কাছে ঘেঁষার সুযোগ পেয়েছিলেন। সমুদ্রের বিশালতা বুঝতে গেলে যেমন সমুদ্রের কাছাকাছি যেতে হয়, তেমনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের খুব কাছে থেকে তিনি বুঝেছেন মহান ওই মানুষটির মনের বিশালতা। অতি কাছ থেকে জানতে পেরেছেন জাতির জনকের স্বপ্নের কথা। সম্ভবত বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সচিব হিসেবে কাজ করা ছিল . মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের জীবনের এক স্বর্ণসৌভাগ্য, জীবন পঞ্জিকায় এক সোনালি অধ্যায়। ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন আর তাকে দেখেছেন বলেই তিনি জাতির জনকের চিন্তা চেতনার প্রতি অতটা নৈষ্ঠিক নিবেদিত।

পাঁচ। সরকারি চাকরিতে শুরু থেকে অবসরে যাওয়া পর্যন্ত সততা, নিষ্ঠা আর দক্ষতা দিয়ে সব পর্যায়ে প্রশংসা কুড়িয়েছেন মানুষটি। একসময় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিযুক্ত হন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের পদটি লালন শাহের ওই গানের মতো, আমি শ্যাম রাখি না কুল রাখি হয়েছে মোর জ্বালা। একদিকে সরকারের নিয়ন্ত্রণ, অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন! অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে যে দু-একজন ভারসাম্যমূলক কাজটি করতে পেরেছেন, তিনি তাদের মধ্যে অন্যতম বলে ধারণা করা হয়। তার আমলে ব্যাংকিং খাতে স্ক্যাম হয়েছে বলে মনে পড়ছে না, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা নিয়ে জোরেশোরে সমালোচনার কথাও কানে আসেনি। মুদ্রাবাজার তথা ব্যাংকিং খাতে তেমন কোনো অস্থিরতা ছিল না বললেই চলে। মোট কথা, তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ ব্যাংক সব প্রতিকূল পরিস্থিতি সামাল দিতে সক্ষম হয়েছিল।

তাছাড়া চাকরি-পরবর্তী সময়ে জাতীয় নিরাপত্তা উন্নয়নের স্বার্থে সরকার কর্তৃক গঠিত বেশ কয়েকটি তদন্ত কমিশনের প্রধান হয়ে দক্ষতার সঙ্গে সময়মতো বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদন দাখিল করে জনতার সুনাম অর্জন করেছেন।

ছয়। এবার বলি তার সন্তর্পণ স্বপ্নের কথা।

দেশের উচ্চশিক্ষার সীমিত সুযোগ নিম্নমুখী মান নিয়ে তিনি চিন্তাভাবনা করতেন। নগরীর আফতাব নগরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সিরামিক ইটের বিশাল বিল্ডিং তথা ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির স্থায়ী ক্যাম্পাস। দেশে-বিদেশে প্রশংসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য আমাদের মনের মানুষ মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। বিশ্ববিদ্যালয়টি তার ব্রেনচাইল্ড বললেও বোধ করি খুব একটা ভুল হবে না। এমনকি তার সমালোচকরাও বলবেন, বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাঝে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির শীর্ষ অবস্থানে চলে আসার পেছনে তার দূরদর্শিতা, বিচক্ষণতা নেতৃত্বগুণ কাজ করেছে। মাত্র ছয়জন শিক্ষক কুড়িজন ছাত্র নিয়ে ১৯৯৬ সালে যার যাত্রা, ২০২০ সালে তার ছাত্র সংখ্যা আট হাজারের অধিক, শিক্ষক সংখ্যা ৪৫০। মহাখালীর অস্থায়ী আবাস ছেড়ে ২০১২ সালেই ইস্ট ওয়েস্ট চলে আসে আফতাব নগরের নিজস্ব ক্যাম্পাসে। মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন প্রথমে ছিলেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য, পরে দীর্ঘ সময় ধরে তিনি ছিলেন বোর্ড অব ট্রাস্টিজের প্রেসিডেন্ট, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান উপদেষ্টা। নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন ইস্ট ওয়েস্টের সঙ্গে, যেমন করে মা-বাবা জড়িয়ে থাকেন সন্তানের জীবনের সঙ্গে। আর তার পরিশ্রমের বিনিময়ে তার যে কোনো প্রাপ্তি নেই, সে কথাটাও জানান দেয়া দরকার। প্রসঙ্গত না বললেই নয়, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতাদের নিঃস্বার্থ সমাজসেবা নির্লোভ আচরণ লক্ষ করার মতো। তারা কোনো ব্যাংকঋণ ছাত্রদের ওপর অতিরিক্ত সারচার্জ ব্যতিরেকে ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগে গড়ে তুলেছেন নিজস্ব সুপরিসর শিক্ষাবান্ধব ক্যাম্পাস। এর ভেতরে বিরাট এক উঠোনে দাঁড়িয়ে উন্মুক্ত আকাশের নিচে ছেলেমেয়েরা বৃষ্টিতে ভিজে কিংবা চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় গান ধরে, আজ জ্যোস্নারাতে সবাই গেছে বনে, বসন্তের এই মাতাল সমীরণে।

ছয়। অবসর বলে কোনো শব্দ বোধ হয় তার অভিধানে নেই। আর তাই আশি ছুঁইছুঁই ফরাসউদ্দিন এখনো কাজে নিয়োজিতকখনো অর্থনীতির ক্লাসে, সরকারি তদন্ত কমিটিতে, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়কে সেবা প্রদানের নিমিত্তে। বিদেশে গেলে তো কথা নেই, দেশে থাকলে প্রায় প্রতিদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন, দিবসের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যয় করেন নিবিষ্ট মনে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য উন্নতির সিঁড়ি খোঁজার মানসে। এই নিরন্তর সেবা প্রদানের জন্য তিনি যে কোনো পারিশ্রমিক নেন না, কেবল প্রতীক হিসেবে টাকা নেন, সে গল্পটি অনেকটাই অধরা থেকে যায়। অবশ্য প্রচারবিমুখ, নির্লোভ নিরহংকারী মানুষ ফরাসউদ্দিনের এতে কিছু যায় আসে বলে মনে হয় না।

সাত। একবার টোকিও ছাড়ার আগে আমার হোস্ট ৮৫ বছর বয়সী প্রফেসর ইউজিরো হায়ামির সঙ্গে করমর্দন করতে গিয়ে বলেছিলাম, আপনার দীর্ঘ জীবন কামনা করি। আমার হাতটা ঝেড়ে ঝানু অর্থনীতিবিদ বললেন, দীর্ঘ জীবন কামনা না করে আমার জন্য দীর্ঘ উৎপাদনশীল জীবন কামনা করো।

আর তাই সাদা মন, সাদামাটা জীবন প্রত্যয়ে প্রদীপ্ত মনের মানুষ মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের স্নেহের পরশে সিক্ত আমি তার দীর্ঘ উৎপাদনশীল জীবন কামনা করি:

রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও যাও গো এবার যাবার আগে...

তোমার আপন রাগে, তোমার গোপন রাগে,

অশ্রুজলের করুণ রাগে,

রঙ যেন মোর মর্মে লাগে, আমার সকল কর্মে লাগে,

সন্ধ্যাদীপের আগায় লাগে, গভীর রাতের জাগায় লাগে।

 

আব্দুল বায়েস: অর্থনীতির অধ্যাপক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন