বিদায় কবরী...
কবরী, নামটা মনে পড়লেই ভেসে আসে এক চিরচেনা মিষ্টি মেয়ের মুখ। তিনি সারাহ বেগম কবরী, দেশের চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি এক নাম। তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য খুব বেশি শব্দের প্রয়োজন নেই। শুধু নাম জঁপলেই হলো ব্যস, ওমনি এক এক করে তার সিনেমার নামগুলো ঠোঁটের আগায় চলে আসে। বৃদ্ধ থেকে তরুণ সবারই যেন ঠোঁটস্থ। তার প্রয়াণে বাংলা চলচ্চিত্রের দুনিয়ায় নেমে এসেছে আঁধার।
হুট করেই যেন চলে গেলেন কবরী। করোনাকালে অবশ্য সবাই যেন চোখের পলকেই হারিয়ে যাচ্ছেন। ৫ এপ্রিল হঠাৎ খুশখুশে কাশি ও জ্বরে আক্রান্ত হয়ে করোনার নমুনা পরীক্ষায় দেন কবরী। ওইদিন দুপুরে পরীক্ষার ফল হাতে পেলে জানতে পারেন, তিনি করোনা পজিটিভ। রাতেই তাকে ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ৭ এপ্রিল দিবাগত রাতে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। ৮ এপ্রিল দুপুরে শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে কবরীর জন্য আইসিইউ পাওয়া যায়। সেখানেই চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। কবরীর উন্নত চিকিৎসার জন্য গত শনিবার সকাল সাড়ে ১০টায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নিয়ে একটি বোর্ড বসেছিল বলে বণিক বার্তাকে জানান অধ্যাপক ফারুক আহমেদ। ডাক্তারদের সেই আলোচনায় কিছুটা সুস্থতার খবর এলেও শেষ রক্ষে আর হলো না। ১৬ এপ্রিল দুপুরে আবারো কবরীর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। শেষমেশ ১৭ এপ্রিল প্রথম প্রহরে রাত ১২টা ২০ মিনিটে তিনি এ হাসপাতালেই শেষ নিঃশাস ত্যাগ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৭১ বছর।
গতকাল বাদ জোহর বনানীর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করা হয় মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক সংসদ সদস্য ও অভিনেত্রী সারাহ বেগম কবরীকে। তার আগে বনানী কবরস্থানের সামনেই মুক্তিযোদ্ধা এ অভিনয়শিল্পীকে রাষ্ট্রীয়ভাবে গার্ড অব অনার দেয়া হয়। কবরীর ছেলে শাকের চিশতী বণিক বার্তাকে জানান, ‘মরদেহ সোয়া ১২টায় আধাঘণ্টার জন্য নেয়া হয় গুলশানের বাসায়। সেখান থেকে মরদেহ জানাজার জন্য নেয়া হয় বনানী কবরস্থানে।’
তিনিও আরো জানান, কডিড পরিস্থিতির কারণে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য কবরীর মরদেহ শহীদ মিনার কিংবা বিএফডিসিতে নেয়া সম্ভব হয়নি।
শেষ হয়েও হলো না শেষ
আয়না চলচ্চিত্র দিয়ে পরিচালক হিসেবে নাম লিখিয়েছিলেন কবরী। এরপর দ্বিতীয় চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেছিলেন সারাহ বেগম কবরী। সরকারি অনুদানে নির্মিত তার নতুন চলচ্চিত্রের নাম ‘এই তুমি সেই তুমি’। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে সারা দেশ লকডাউন হয়ে পড়ায় থেমে যায় ছবিটির দৃশ্যধারণ। ছয় মাসের বিরতি কাটিয়ে কবরী আবারো ‘এই তুমি সেই তুমি’ চলচ্চিত্রের ক্যামেরা চালু করেন গত বছর সেপ্টেম্বরে। দৃশ্যধারণ চলে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। সাতদিন রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ছবিটির দৃশ্য ধারণ করেন তিনি।
‘এই তুমি সেই তুমি’ ছবির মাধ্যমে পরিচালনায় ১৪ বছরের বিরতি ভেঙে ক্যামেরার পেছনে দাঁড়িয়েছেন কবরী। পরিচালনার পাশাপাশি তিনিই এ সিনেমার কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপ রচয়িতা। এ সিনেমার মধ্য দিয়ে চার দশক পর আবার পর্দায় জুটিবদ্ধ হয়েছেন সোহেল রানা ও কবরী। এ সিনেমার গল্পে দুটি সময়কে তুলে ধরা হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের সঙ্গে বর্তমান সময়কে প্রেমের গল্পের প্রেক্ষাপটে তুলে ধরা হচ্ছে। এ ছবির মাধ্যমে ঢাকাই চলচ্চিত্রে নতুন দুই মুখ উপহার দিতে যাচ্ছিলেন কবরী। তারা হচ্ছেন রিয়াদ রায়হান ও নিশাত নাওয়ার সালওয়া। ছোট পর্দার উঠতি নায়ক রিয়াদ রায়হান। অন্যদিকে মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ ২০১৮-এর চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় প্রথম রানারআপ হয়েছিলেন নিশাত নাওয়ার সালওয়া। এ বছর মার্চের দিকে চলচ্চিত্রটির ডাবিং চলছিল। ছবির গানে কণ্ঠ দিয়েছেন আরেক কিংবদন্তি সাবিনা ইয়াসমিন।
যা বললেন নির্মিতব্য শেষ সিনেমার কলাকুশলীরা
বণিক বার্তা থেকে কবরীর শেষ সিনেমা ‘এই তুমি সেই তুমি’র অভিনয়শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলা হয়। নির্মাণের পাশাপাশি কবরী এ চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করছিলেন। তার বিপরীতে অভিনয় করছিলেন চিত্রনায়ক সোহেল রানা। বণিক বার্তাকে সোহেল রানা বলেন, ‘বলার মতো কোনো ভাষা এখন আমার জানা নেই। আমি এখনো স্তব্ধ হয়ে আছি। কবরী আমাদের মাঝে আছেন এবং থাকবেন।’
চলচ্চিত্রটিতে নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করছিলেন নিশাত নাওয়ার সালওয়া। তিনি বণিক বার্তাকে কান্নাভেজা কণ্ঠে জানান, ‘এই তো গত মাসেই আমাদের ডাবিংয়ে কত আড্ডা হলো। আমরা অনেক হাসলাম। কিন্তু এমন প্রাণবন্ত মানুষটি হুট করে এভাবে কাঁদিয়ে চলে যাবেন ভাবতেই পারছি না। আর কিছু বলতেও পারছি না...।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠেই তিনি ফোন রেখে দেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শোক
সামাজিক মাধ্যমে কবরীর মৃত্যুতে শোক জানাচ্ছেন দেশের বিভিন্ন মাধ্যমের অভিনেতা-অভিনেত্রী, চলচ্চিত্র ও সাংস্কৃতিক দুনিয়ার মানুষ। সাধারণ দর্শক, ভক্তরাও লিখছেন তাদের বেদনার অনুভূতি। অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফা লিখেছেন, ‘আপনার হাসি, আপনার অভিনয়, আপনার মিষ্টিমুখ—সব বয়সের শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করেছে। রুপালি পর্দার সেরা অভিনেত্রী। আমি কীভাবে আপনাকে বিদায় জানাব! দমবন্ধ লাগছে! শান্তিতে থাকুন কবরী ফুপু।’
চিত্রনায়ক শাকিব খান লিখেছেন, ‘কিংবদন্তি এ মানুষটির সঙ্গে আমার অসংখ্য স্মৃতি। যখনই দেখা হতো আমাকে স্নেহ করতেন। তার সময়কার বিভিন্ন স্মৃতি শেয়ার করতেন। কবরী আপার মৃত্যুতে প্রিয় অভিনেত্রী হারানোর পাশাপাশি একজন অভিভাবক হারানোর শোক অনুভব করছি। যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন কবরী আপা।’
ফাহমিদা নবী লিখেছেন, ‘আজ আর কোনো ছবি নয়, মনের ভেতর থাকুক সেই ছবি, যে ছবি চির অমলিন। কিন্তু ছবিটা না দিয়ে পারলাম না। কেমন যেন মায়া আর কষ্টমাখা আত্মবিশ্বাসী ছবিটা! ছবিটাতে একজন সংগ্রামী, কষ্টকে জয় করা এবং আবার স্বপ্ন দেখার প্রত্যয়ে নিজেকে তৈরি করার একজন নতুন সাহসী নারীকে দেখলাম, মনে হলো তাকে নিয়ে লিখে কিছুটা হারানোর বেদনা ভুলি! মিষ্টি মেয়ে খ্যাত চিত্রনায়িকা কবরী চিরনিদ্রায় চলেই গেলেন!’
নৃত্য দিয়ে মঞ্চে, তারপর অভিনয়
১৯৫০ সালের ১৯ জুলাই চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে জন্মগ্রহণ করেন কবরী। তার আসল নাম মিনা পাল। বাবা কৃষ্ণদাস পাল এবং মা লাবণ্য প্রভা পাল। ১৯৬৩ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে নৃত্যশিল্পী হিসেবে মঞ্চে উঠেছিলেন তিনি। তারপর টেলিভিশন ও পরে সিনেমায়। ১৯৬৪ সালে সুভাষ দত্তের ‘সুতরাং’ ছবির মাধ্যমে সারাহ বেগম কবরীর অভিনয়জীবন শুরু। চট্টগ্রামের মেয়ে মিনা পাল চলচ্চিত্রের লাল-নীল জগতে পা দিয়েই নতুন নাম পান ‘কবরী’। পরিচালক সুভাষ দত্তই তাকে এ নাম দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। দক্ষ অভিনয়শৈলী দিয়ে ‘মিষ্টি মেয়ে’ হিসেবে খ্যাত ওঠেন এ অভিনেত্রী। এরপর অভিনয় করেছেন হীরামন, ময়নামতি, চোরাবালি, পারুলের সংসার, বিনিময়সহ অসংখ্য সিনেমায়। কাজ করেছেন ঋত্বিক ঘটক ও জহিরা রায়হানের সঙ্গে। আগন্তুকসহ জহির রায়হান নির্মিত উর্দু ছবি ‘বাহানা’ এবং ঋত্বিক ঘটকের ছবি ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এ অভিনয় করেন কবরী। এছাড়া সারেং বউ, সুজন সখীতে অভিনয় করে তারকা খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে যান তিনি।
মুক্তিযুদ্ধ, রাজনীতি ও আত্মজীবনী
মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশকে স্বাধীন করতে কবরী ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছেন। সে সময়য়ে স্মৃতিচারণ করে গণমাধ্যমকে দেয়া এক সাক্ষাত্কারে কবরী বলেছিলেন, ‘তখন তো আমি কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলাম না। একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে, সাধারণ মানুষ, একজন অভিনেত্রী ও শিল্পী হিসেবে মানবতা লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম। বাবা-মা, ভাইবোন, সম্পদ, লোভ-লালসা সবকিছুর মায়া ত্যাগ করে আমি ভাষণ দিয়েছিলাম এবং জনসম্মুখে কাঁদছিলাম এজন্য যে পাকিস্তানি বাহিনী যেভাবে হত্যা-নির্যাতন চালাচ্ছিল আমাদের দেশের মানুষের ওপর তার হাত থেকে যেন আমার দেশের মানুষ অতিদ্রুত রক্ষা পায়। সেজন্য আমি মানুষের কাছে, বিশ্ববাসীর কাছে যে আহ্বান জানিয়েছিলাম তার পরিণতি যে কী হতে পারে তা একবারও আমার মনে আসেনি এবং ভাবার কোনো অবকাশও ছিল না।’ ২০০৮ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। যুক্ত ছিলেন অনেক নারী অধিকার ও সমাজসেবামূলক সংগঠনের সঙ্গে। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় ২০১৭-তে প্রকাশিত হয় তার আত্মজীবনীমূলক বই ‘স্মৃতিটুকু থাক’।