কবরী, স্মৃতিটুকু থাক

রুহিনা ফেরদৌস

তখনও আমাদের ছেলেবেলার মধ্যে বড়বেলা ভর করেনি, যা দেখি তাতেই মুগ্ধ হই। দেখি, প্রতি শুক্রবার বড়রা জলদি জলদি কাজ সারতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। দুপুর ১২টা কি ১টার মধ্যে ছোটদের ধুয়ে-মুছে স্নান করিয়ে সিঁথিপাটি চুল আঁচড়ে দিয়ে রান্নার আয়োজন শেষ করতে থাকে। শুক্রবারের রান্না একটু বিশেষই হবে, টেবিলে মাছ-মাংস-ভর্তা-ভাজির কয়েক পদ কিংবা বাড়িজুড়ে সুগন্ধি খিচুড়ি-পোলাওয়ের মৌ মৌ সুবাস না ছড়ালে মনেই হতো না আজ বিশেষ দিন।

তবে যত আয়োজন, হুল্লোড়, তাড়াহুড়া সব গিয়ে পিনপতন নীরবতায় ডুবে যেত বেলা ৩টার পর। বিটিভি খুলে অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে থাকা সোনামাখা মুখগুলোর কথা এখনো খুব মনে আছে। চেয়ারে, টুলে, বিছানায়, বেতের মোড়ায় কিংবা পাটি পেতে বসে থাকা অপেক্ষাগুলো। কেউ এসেছে মোটামুটি দূর থেকে। হাঁটাপথে হিসাব করলে মিনিট তিরিশের রাস্তা। কেউ হয়তো থাকে খুব কাছাকাছি। তবে তারা সবাই এসেছে ‘নীল আকাশের নীচে’ নামে একটি ছবি দেখতে। প্রায় শুক্রবার বাড়িতে এমন দৃশ্য দেখে আমরা ছোটরা খুব অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কিন্তু সেদিন বেলা ৩টা বাজার খানিকটা আগে আগেই এসেছে সবাই। কবরী-রাজ্জাক নিয়ে সে কি তুমুল আলোচনা, উত্সাহ। সেসব কথা, হইচই আজও স্মৃতির সাঁকো পেরিয়ে খুব একটা অতীত হয়নি আমার কাছে।

মনে আছে কখনো দাদী কখনো মায়ের কোল বদলে বদলে নীল আকাশের নীচে দেখেছিলাম। অতিথি দর্শকের ভিড়ে অতটুকু বাড়িতে আমার আর আলাদা করে বসার জায়গা হয়নি সেদিন। কিছু বুঝে না বুঝে তৃষ্ণা চরিত্রের মানুষটিকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম।

‘গান হয়ে এলে...’—গানটি আর মানুষটি নিয়ে সে মুগ্ধতা কমেনি কখনও।

সিনেমা নিয়ে বোঝাপড়া তৈরি হলে প্রথমেই দেখেছিলাম ‘সুতরাং’ ছবিটি। জরিনা চরিত্রের চঞ্চল মিষ্টি কবরী। এরপর কত ছবি দেখেছি, তার—চাওয়াপাওয়া, আবির্ভাব, চোরাবালি, ক খ গ ঘ ঙ, দীপ নেভে নাই, তিতাস একটি নদীর নাম, সুজনসখী, দেবদাস কিংবা সারেং বৌ। তবে খুব আগ্রহ নিয়ে দেখেছি তিতাস একটি নদীর নাম। হয়তো ঋত্বিক ঘটকের নির্দেশনা আর কবরী বলেই আগ্রহটা বেশি ছিল।

সত্তর ও আশির দশকের বাংলার গ্রাম থেকে শহর, উচ্চবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তের অন্দরে অবসরে আড্ডায় চর্চিত ছিলেন কবরী। পর্দায় তার সহজ ও প্রাণবন্ত উপস্থিতির কারণে সবাই তাকে নিজেদের মানুষ হিসেবেই ভাবতে পেরেছিল। কবরীর অভিনয়ে ভঙ্গিতে চরিত্রের সে সহজ উপস্থাপন, তা দেখে বুঝি তার সমসাময়িকরাও মুগ্ধ হতেন। হিংসেও করতেন বুঝি।

আজ তার অনুপস্থিতির দিনে কত কিছুই নিয়েই তো কথা হতে পারে। কথা হতে পারে তার অভিনয়, তার নায়কদের নিয়ে কিংবা উঠে আসতে পারে মিনা পাল থেকে বাংলা চলচ্চিত্রের মিষ্টি মেয়ে হয়ে ওঠার গল্পটিও। তবে সেসব কিছু বুঝি ছাপিয়ে যাবে অভিনয়শিল্পী কবরীর কাছে।

চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গি বাজার থেকে উঠে এসে মিনা পাল নায়ক শাসিত এক চলচ্চিত্র ইন্ডাস্টির দখল নিলেন। দাপটে অভিনয় করলেন। নায়করাজ রাজ্জাক থেকে শুরু করে জুটি বাঁধলেন প্রবীর মিত্র, ফারুক, উজ্জ্বল, আলমগীর, জাফর ইকবালের সঙ্গে। কবরীর বিপরীতে অভিষেক মানে ক্যারিয়ারের শুভসূচনা। কবরী মানে শুধু জুটি সফল নয়, বক্স অফিসে লক্ষ্মীর আগমনও।

     তিতাস একটি নদীর নাম ছবিতে কবরী

তখনও দেশ স্বাধীন হয়নি। চারদিকে উর্দু ছবির জয়জয়কার। ঠিক সে সময় মাত্র ১৩ বছর বয়সে সুতরাং ছবিতে আবির্ভাবের মাধ্যমে কবরী হয়ে ওঠেন এ অঞ্চলের আস্থাভাজন নায়িকা। স্বাধীনতার আগেই কবরী বাংলা চলচ্চিত্রে জনপ্রিয় অভিনেত্রী।

ষাটের দশকে তিনি যখন চলচ্চিত্রে পা রাখেন তখন মেয়েদের জন্য তা খুব সহজ ছিল না। তবে ভজন গায়ক বাবা কৃষ্ণ দাস পাল আর সংস্কৃতমনা মা লাবণ্য প্রভা পাল মেয়েকে প্রতিবন্ধকতাগুলো সহজে কাটিয়ে উঠতে সাহায্য  করেছিলেন। তার ভাইবোনদের মধ্যেও কেউ গাইত তো কেউ তবলা বাজানো শিখত। কবরীর বাবার বন্ধু ড. কামাল। তার সঙ্গে পরিচয় ছিল খ্যাতনামা সংগীত পরিচালক সত্য সাহার। তখন সুভাস দত্ত তার সুতরাং ছবির জন্য একজন নতুন মুখ খুঁজছিলেন। বিষয়টি জানতেন সত্য সাহা। যোগসূত্রটা এভাবেই মিলে যায়।

সিনেমায় পদাপর্ণের সূত্র ধরে কবরী বলেছিলেন, এখানে কাজ করার বিষয়টি নিয়ে কখনো পরিবার বা সমাজের কাছ থেকে প্রতিবন্ধকতা আসেনি আমার। আমার পরিবার ও স্থানীয় পরিচিতরা বরং ছবিতে আমরা অভিনয়ের বিষয়টি নিয়ে খুব আগ্রহী ছিলেন। উত্সাহ জুগিয়েছিলেন।

      কবরী ও অভিনেতা রাজ্জাক

শুধু বাংলা ভাষার ছবি নয়, জহির রায়হান পরিচালিত উর্দু ছবিতেও কাজ করেছেন তিনি। আর ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীই। তখনই করবীকে নিয়ে ছবি তৈরির কথা ভেবেছিলেন কিংবদন্তি এ পরিচালক, যা পূর্ণতা পায় ১৯৭৩ সালে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর।

মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের পরিস্থিতি, মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কথা, সংগ্রামী মুক্তিযোদ্ধাদের কথা তিনি জানিয়েছিলেন বহির্বিশ্বের কাছে। লতা মুঙ্গেশকর, ওয়াহিদা রহমান ও নার্গিসের সঙ্গে গানও গেয়েছেন। সবাইকে দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানিয়েছেন। দেশের পক্ষে সমর্থন আদায় করেছেন।

কবরী একটি আত্মীবনীমূলক বই লিখেছেন ‘স্মৃতিটুকু থাক’ শিরোনামে। এ বইয়ের পাতা ওল্টালে কিশোরী কবরী থেকে পরিণত কবরীর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় যেন। দেখা হয়ে যায় কারো অপেক্ষায় থাকা নিঃসঙ্গ এক কবরীর সঙ্গেও।

যেমন বইয়ের একটি জায়গায় তিনি লিখেছেন, ‘আমার কপালে প্রেমের সুখ কোনো দিন হয়নি। যাক আপদ চুকেছে।’ কিন্তু সারা জীবন হয়তো অনিচ্ছুক আপদের জন্যই মন পুড়েছে তার। পাওয়া না-পাওয়ার হিসাব মেলাতে বসে তিনি লিখেছেন, ‘সবার জীবন কি এক রকম হয়? এই পৃথিবী একটা যুদ্ধক্ষেত্র। যুদ্ধে কেউ জেতে কেউ হারে—মেনে নিতেই হয়। এভাবেই বুঝি জীবন কেটে যায়।’

সুতরাং ছবির সেট। জীবনে প্রথম শর্ট, তাও আবার অতটুকু বয়সে। এটা যে ঠিকঠাক হবে না তা নিশ্চিত হওয়াই যায়। তবে প্রথম ওই শর্ট দিয়ে নাকি চড় খেতে হয়েছিল তাকে। চড় খেয়ে কেঁদে ভাসানোর কথাও বইয়ে লিখে গেছেন তিনি। লিখেছেন তার প্রেম আর অব্যক্ত অনুভূতির কথাও।

কবরী-রাজ্জাক। জনপ্রিয় এ জুটির রসায়ন বাস্তবে কতটা জমেছিল তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে শত। স্মৃতিকথার একটি জায়গায় কিংবদন্তি এ অভিনেত্রী সে প্রশ্নেরই হয়তো উত্তর দিয়েছেন, ‘একসঙ্গে কাজ করেছি অনেক ছবিতে—বন্ধুত্ব হবারই কথা, হয়েওছে। কিন্তু রাজ্জাক সাহেব বরাবরই আমাকে হিংসে করেন। আমি করতাম কিনা জানি না। আমি তাকে বন্ধুর পরও আরো এক ধাপ এগিয়েই রেখেছিলাম।’

      সুতরাং ছবিতে সুভাস দত্তের সঙ্গে কবরী

মিনা পাল চেয়েছিলেন বড় হয়ে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে স্কুলের মাস্টারনি হবেন।  কিন্তু তিনি হয়ে গেলেন বাংলা চলচ্চিত্রের বাঁক বদলের অগ্রগামী সারথী।

গ্রামের গরির ঘরের মেয়ে চরিত্রে তিনি যেমন মানিয়ে গিয়েছেন, তেমনি অভিজাত শহুরে সংস্কারেও তাকে ভীষণ আদুরে লাগে। কবরী তার মৌনমুগ্ধতা ছড়িয়ে যাবেন আরো কয়েক যুগ, দশক, যুগান্তরে।

তার অভিনীত সুতরাং বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র সম্মাননা লাভ করে, ১৯৬৫ সালে ফ্রাংকফুর্ট চলচ্চিত্র উত্সবে দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে পুরস্কার লাভের মাধ্যমে। অর্জনে ঝুলিতে রয়েছে আজীবন সম্মাননাসহ দুটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। রয়েছে আরো অনেক সম্মাননা। অভিনয়ের পাশাপাশি পরিচালনায়ও নাম লিখয়ে ছিলেন তিনি। ছবির কাজেই ব্যস্ত ছিলেন। করোনার মধ্যেও কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিছুটা অপূর্ণতা নিয়েই গেলেন বোধহয়!

লেখক: সাংবাদিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন