গ্রন্থ পর্যালোচনা

‘বঙ্গবন্ধু-বাংলাদেশ’

বিধান চন্দ্র পাল

বঙ্গবন্ধু-বাংলাদেশ’—অধ্যাপক নজরুল ইসলামের লেখা গবেষণাধর্মী মননশীল প্রবন্ধের অনন্য একটি সংকলন। গ্রন্থটিতে একদিকে তুলে ধরা হয়েছে আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের কথা। খুব স্বাভাবিকভাবেই নেতৃত্বের প্রসঙ্গ এসেছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বেই পূর্ব বাংলার জনগণ, বাঙালি এবং অন্যান্য ভাষা সংস্কৃতির মানুষ সম্মিলিতভাবে প্রথমবারের মতো একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়েছিল। আর সেটিই বোধ হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সবচেয়ে বড় অবদান।

একথা বলা বাহুল্য, ওই সময়ের আগে ভূখণ্ডের মানুষের একক কিংবা নির্দিষ্ট কোনো রাষ্ট্র ছিল না। ভারতীয় উপমহাদেশের অনেক নেতাই সরব প্রয়াস চালিয়েছিলেন সত্যি কিন্তু সফলতা পাননি। বঙ্গবন্ধুই ভূখণ্ডের ভাষা-ধর্ম-সংস্কৃতি নির্বিশেষে সবাইকে একত্র ঐক্যবদ্ধ করে তুলতে পেরেছিলেন।

বাংলাদেশের মতো বিশাল জনসংখ্যা অধ্যুষিত, ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক রাজনৈতিক জটিল সমস্যাসংকুল একটি দেশ পরিচালনার দায়িত্ব অত্যন্ত কঠিনএকথা লেখক প্রথম গুচ্ছের দ্বিতীয় লেখাটির শুরুর দিকেই দ্ব্যর্থহীনভাবে উল্লেখ করেছেন। সেই রচনার শিরোনামশেখ হাসিনার অর্জন: উচ্চশিক্ষা, গ্রাম নগর উন্নয়ন, পরিবেশ সংস্কৃতি লেখাটির শিরোনাম থেকেই স্পষ্ট লেখক আসলে উচ্চশিক্ষা, গ্রাম নগর উন্নয়ন, পরিবেশ সংস্কৃতিগত অর্জনগুলোকে অংশে নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে মূল্যায়ন করেছেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারকাজ শুরু করাটাকে তিনি অত্যন্ত সাহসিকতা দৃঢ়চিত্ততার প্রমাণ হিসেবে দেখিয়েছেন। এছাড়া অনেক জেলায় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, জিডিপিতে নগর খাতের অবদান, পদ্মা সেতু, বৈশাখী ভাতা প্রবর্তন, সংস্কৃতিবলয় পরিকল্পনা নির্মাণ, ডিজিটাল তথ্য কেন্দ্র চালু করা প্রভৃতি বিষয়কে যেমন সফলতা হিসেবে দেখিয়েছেন, তেমনি জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর যথাযথ বাস্তবায়ন শিক্ষায় বৈষম্য হ্রাসের কথা তুলে ধরে তিনি . মুহম্মদ কুদরাত- খুদা শিক্ষা কমিশনে একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের সুপারিশের কথাটিও গুরুত্বসহকারে মনে করিয়ে দিয়েছেন। বৃহত্তর ঢাকা মহানগর অঞ্চলে কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা বা এসটিপি-বহির্ভূত কোনো রকম মেগা প্রকল্প গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। পরামর্শ দিয়েছেন গ্রাম হবে শহরএমন উন্নয়ন নিশ্চিত করতে গিয়ে গ্রামের ভৌত পরিবর্তনে যেন বাড়াবাড়ি কিছু না করা হয় সে বিষয়েও। অংশে তিনি অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক উন্নয়ন ব্যবস্থার প্রত্যাশা করেছেন। দুর্নীতি উন্নয়নের অনুষঙ্গ হবে না, সেটাও আন্তরিকভাবে কামনা করেছেন।

পরিশেষে, প্রবন্ধের উপসংহারে যে কথাটি লেখক লিখেছেন, সেটি অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। লেখক অনেকটা পরামর্শের আহ্বানের সুরে বলেছেন, ‘যা কিছু আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাবেন বা করেন বা করতে চেষ্টা করেন বা করবেন, তা সবই যেন বঙ্গবন্ধু নির্দেশিত সংবিধান সমর্থিত চার মূলনীতির অনুসরণেই করেন। তা হলেই বাঙালি জাতি তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে, বাংলাদেশ ধন্য হবে, সোনার বাংলার স্বপ্ন পূরণ হবে।

বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ঢাকায় পৌঁছার পর বঙ্গবন্ধু তার প্রথম ভাষণে ঘোষণা করেছিলেন: ‘আমি স্পষ্ট দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে দিতে চাই যে আমাদের দেশ হবে গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, জাতীয়তাবাদী সমাজতান্ত্রিক দেশ। দেশে কৃষক-শ্রমিক, হিন্দু-মুসলমান সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকবে।

অনন্য ঘোষণার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রচিন্তার মূলনীতিগুলো খুব অসাধারণভাবে ফুটে উঠেছিল। ১৯৭২ সালের বাংলাদেশের সংবিধানেও তাই জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা সমাজতন্ত্র চারটি নীতিকে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে সন্নিবেশিত করা হয়েছিল। লেখক বাংলাদেশ গুচ্ছের শুরুতেই বিষয়টিকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে সেই স্বপ্নের কথাই দৃঢ়ভাবে পুনর্ব্যক্ত করেছেন।

অধ্যাপক ইসলাম একজন খ্যাতিমান ভূগোল পরিবেশবিদ এবং নগর বিশেষজ্ঞ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র তিনি। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল পরিবেশ বিভাগে দীর্ঘ সময়, অর্থাৎ ১৯৬৩ সাল থেকে শুরু করে ৪৪ বছর শিক্ষকতা করেছেন। মাঝে ১৯৮২-১৯৮৬ চার বছর ব্যাংককের আন্তর্জাতিক পোস্ট গ্র্যাজুয়েট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এআইটি) নগর উন্নয়ন বিষয়ে অধ্যাপনা করেন।

তিনি ১৯৯৯ থেকে ২০০২ সালে ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। এছাড়া তিনি স্বাধীন গবেষণা সংস্থা নগর গবেষণা কেন্দ্রের (সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজ, সিইউএস) প্রতিষ্ঠাতা (১৯৭২) বর্তমান সাম্মানিক চেয়ারম্যান। তিনি সরকারের গৃহায়ন নীতিমালা এবং জাতীয় নগরায়ণ নীতিমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রেও নেতৃত্বদান করেছেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই নগরায়ণ অংশে প্রকাশিত হয়েছে তার গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতাগুলো, নান্দনিক দৃষ্টিকোণ এবং তথ্যসমৃদ্ধ বিশ্লেষণ।

ঢাকা শীর্ষক আরেকটি গুচ্ছ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে গ্রন্থটিতে।একাত্তরের স্মৃতি: ঢাকারচনাটিতে লেখক সেই সময়ের নানান স্মৃতির পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য যে স্মৃতিটি বিশেষভাবে তুলে ধরেছেন, সেটি হলো মার্চ রেসকোর্সের মাঠে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে যাওয়ার স্মৃতি। লেখকের ভাষায়, ‘আমরা চার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতায় উদ্দীপ্ত হয়েছিলাম। তবে শিক্ষকসুলভ রক্ষণশীলতাও আমাদের চরিত্রে বিদ্যমান ছিল। আমাদের চারজনের একজনও সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়িনি, যদিও বয়সে তরুণই ছিলাম বলা যায়।একপর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের তার বেশ কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে তিনি প্রত্যক্ষভাবে প্রতিরোধ আন্দোলনেও যুক্ত হয়েছিলেন, সেটাও স্পষ্টভাবে গ্রন্থে তুলে ধরা হয়েছে।

প্রাসঙ্গিকভাবে বিস্তৃত আলোচনা এসেছে রাজউকের ডিএমডিপি প্ল্যান নিয়েও। উপসংহার অংশে লেখক যথার্থই উল্লেখ করেছেন বর্তমানের কথা। তিনি বলেছেন, ‘বর্তমানে ঢাকার যে নানামুখী ত্রাহি পরিস্থিতি, এখান থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে এবং শহরটিকে দীর্ঘমেয়াদে টিকিয়ে রাখতে হলে বসবাসযোগ্য করতে হলে কালবিলম্বের আদৌ সুযোগ আমাদের নেই।

চিত্রকলার প্রতি আগ্রহ অধ্যাপক নজরুল ইসলামের গড়ে উঠেছিল তরুণ বয়স থেকেই। তিনি নিজেও ছবি আঁকেন এবং বলা বাহুল্য, শিল্প সমালোচক হিসেবে তার আলাদা একটা সুনাম অবস্থান রয়েছে। ফলে গুচ্ছের শুরুতেই পুরোপুরি ভিন্ন ধরনের অনন্য একটি প্রবন্ধ তিনি অন্তর্ভুক্ত করেছেন। প্রবন্ধটির শিরোনামবঙ্গবন্ধু: শিল্পীর চোখে। লেখাটিতে তিনি নানা তথ্য উপাত্ত দিয়ে দেখিয়েছেন বাংলাদেশের চিত্রশিল্পীরা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তাদের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা সম্মান কীভাবে জানিয়েছেন তাদের শিল্পকর্মের মাধ্যমে। বলা বাহুল্য, অংশে চিত্রকর্মের বিশেষত্বগুলোও তিনি স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের শিক্ষাভাবনা নিয়ে আলাদাভাবে একটি রচনাকে গ্রন্থে স্থান পেতে দেখা যায়। সে অংশে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের শিক্ষাদর্শন কেমন ছিল, তা খুব সুন্দরভাবে উপস্থাপন করে দেখিয়েছেন তিনি। সব শেষে এটাও প্রমাণ করে দেখিয়েছেন কেন তার এই শিক্ষাভাবনা প্রগতিশীল ভবিষ্যত্মুখী ছিল। নিঃসন্দেহে শিক্ষাভাবনা লেখাটি আমাদের এখনো প্রাসঙ্গিক বিভিন্নভাবে কাজে লাগবে।

পরের দুটি রচনায় লেখকঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের কথা, কিছু নিজেদের কথাএবংভূগোল পরিবেশ বিভাগে আমার শিক্ষকতার পাঁচ দশকশিরোনামে দুটি প্রবন্ধে তার ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণার পাশাপাশি অনেক তথ্য উপস্থাপন করেছেন; যা ভবিষ্যতে -সম্পর্কিত গবেষণা ইতিহাসকে আরো সমৃদ্ধ করবে।

পরিবেশ বিভাগে আমার শিক্ষকতার পাঁচ দশকপ্রবন্ধে খুঁজে পাওয়া যায় একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের কর্মবৈচিত্র্য নান্দনিকতা। একজন শিক্ষক শুধুই একজন শিক্ষক নন, চাইলে আরো বেশি কিছু করতে পারেন, করে দেখাতে পারেন, নিজের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিকশিত হয়ে উঠতে পারেন, প্রতিষ্ঠা সম্মান অর্জন করতে পারেন আন্তর্জাতিক মহলেও। প্রবন্ধটি পড়ে বিশেষভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এবং যারা ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে উঠতে চান, তাদের মনে বিশেষ নাড়া দেবে বলেই প্রত্যাশা করি। একই সঙ্গে একজন বিকশিত আদর্শ শিক্ষক হয়ে ওঠার জন্য প্রবন্ধটি বিশেষভাবে অনুসরণীয় হবে।

লেখকের বিভিন্ন লেখার নির্যাস থেকে এটা সুস্পষ্ট যে বর্তমান সংকটজনক পরিস্থিতিকে আমরা কীভাবে মোকাবেলা করতে যাচ্ছি, তার ওপরই নির্ভর করছে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জন্য যেসব বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হবে, লেখকের মতে সেগুলোর অন্যতম হলো বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান বিশাল জনসংখ্যা, ধর্মীয় জঙ্গিবাদ, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত, সুশাসনের অভাব এবং করোনাভাইরাসজনিত স্বাস্থ্য সংকট।

১৬ এপ্রিল তার জন্মদিন। জন্মদিনের মাসে বঙ্গবন্ধু-বাংলাদেশ গ্রন্থটি প্রকাশিত হলোএটা জন্মদিনের অনেক বড় একটা পাওয়া। আজকের এই বিশেষ দিনে আমি আন্তরিকভাবে শুভেচ্ছা শ্রদ্ধা জানাতে চাই অধ্যাপক ইসলামের জীবনব্যাপী অর্জনকে, তার অধ্যাপক নজরুল হয়ে ওঠাকে এবং আমাদের এই দেশে, নগরে, সাহিত্যে সংস্কৃতিতে তার অনিবার্য উপস্থিতিকে।

 

বিধান চন্দ্র পাল: গবেষক; সদস্য, নির্বাহী পরিষদ, নগর গবেষণা কেন্দ্র (সিইউএস, ঢাকা) এবং যুগ্ম সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন