বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র

কয়লা সংকটে সারা বছরই অচল থাকছে দুটি ইউনিট

আবু তাহের

দেশের উত্তর জনপদে বিদ্যুতের চাহিদা পূরণে বড়পুকুরিয়া কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষত বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে এবং লো-ভোল্টেজ কমাতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু কয়লা সংকটে বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুটি ইউনিট বছরের বেশির ভাগ সময় বন্ধ রাখতে হচ্ছে। দুই বছর আগে সংকটের শুরু হলেও বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে ইউনিট দুটি চালু রাখার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো রূপরেখা নেই। ফলে সক্ষমতার এক-তৃতীয়াংশ উৎপাদন নিয়েই চালু রাখা হয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। এদিকে চলমান সেচ মৌসুম আসন্ন রমজানে বিদ্যুতের চাহিদা পূরণে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (পিডিবি)

সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন, দুই ইউনিটের উৎপাদন বন্ধ থাকায় লো-ভোল্টেজের পাশাপাশি বিদ্যুৎ বিভ্রাট হতে পারে ব্যাপক হারে। কারণ উত্তরাঞ্চলে এখনো বিদ্যুতের সবচেয়ে বড় সক্ষমতার কেন্দ্র বড়পুকুরিয়া। ফলে কেন্দ্র চালু করা না গেলে ক্ষুদ্র শিল্প-কারখানা এবং সেচকাজ ব্যাহত হবে।

তবে বিদ্যুতের গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেল আগেই বলেছে, বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করা না গেলে সেচ মৌসুমে লোডশেডিং হবে। একই সঙ্গে লো-ভোল্টেজের কারণে কারখানার মেশিনারিজের পাশাপাশি উৎপাদনেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

জানা গেছে, বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৫২৫ মেগাওয়াট সক্ষমতার মোট তিনটি ইউনিট রয়েছে। যার মধ্যে ১২৫ মেগাওয়াটের দুটি এবং ২৭৫ মেগাওয়াট সক্ষমতার একটি ইউনিট। বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ রংপুর রাজশাহী অঞ্চলের বেশকিছু এলাকায় সরবরাহ করা হয়। কিন্তু ২০১৮ সালের ১৯ জুন বড়পুকুরিয়া খনি থেকে লাখ ৪৪ হাজার টন কয়লা গায়েব হয়ে যায়। কয়লা সংকটে ২২ জুলাই থেকে কেন্দ্রটি বন্ধ হওয়ার পর থেকে আর কখনো পূর্ণ মাত্রায় চলতে পারেনি। কয়লা উধাও হওয়ার ঘটনার প্রায় পাঁচ মাস পর আংশিকভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালু করা হয়।

ওই সময় কয়লা সংকটের কারণে বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেলে উত্তরের চার জেলা রংপুর, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী কুড়িগ্রাম জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। একই সঙ্গে এসব জেলার ক্ষুদ্র মাঝারি যেসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান ছিল সেগুলোর উৎপাদন ব্যাহত হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে সে সময় সিরাজগঞ্জ থেকে বিদ্যুৎ নিয়ে যাওয়া হলেও বিদ্যুৎ বিভ্রাট নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রের ২৭৫ মেগাওয়াট সক্ষমতার ইউনিটটি চালু থাকলেও তা থেকে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ নিতে পারছে না পিডিবি। দৈনিক ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নিয়ে উত্তরাঞ্চলে সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখা হচ্ছে। এছাড়া জাতীয় গ্রিড থেকেও বিদ্যুৎ নেয়া হচ্ছে। কিন্তু দূরবর্তী কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ নিলে তাতে লো-ভোল্টেজ তৈরি হচ্ছে। ফলে শিল্প-কারখানা কিংবা মেশিনারিজে প্রভাব পড়ছে। তাছাড়া উত্তরাঞ্চলে বড়পুকুরিয়া ছাড়া বড় ধরনের কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র নেই। ছোট বিদ্যুৎকেন্দ্রের কোনো একটি অচল হয়ে পড়লে পুরো সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে বলে সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন।

বড়পুকুরিয়া কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা পিডিবির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এসএম ওয়াজেদ আলী সরদার বণিক বার্তাকে বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট থেকে আমরা বিদ্যুৎ নিচ্ছি। বাকি দুটি ইউনিটের মধ্যে প্রথম ইউনিটটি আমরা রমজানের আগেই চালু করব। এটা নিয়ে কাজ চলছে। তবে দ্বিতীয় ইউনিট কবে চালু হবে সে বিষয়ে তিনি কিছু বলেননি।

কয়লা সংকটের নিরসন হয়নি, অবস্থায় বিদ্যুৎকেন্দ্র কীভাবে চলবে এমন পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কয়লার সংকট আছে। তবে যে পরিমাণ কয়লা মজুদ আছে তা দিয়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র চলবে।

পিডিবির তথ্যমতে, রংপুর অঞ্চলের বিদ্যুৎ সরবরাহে মোট সাতটি বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রয়েছে। এর মধ্যে বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের তিনটি ইউনিট বাদে বাকিগুলো ১০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার নিচে। ফলে বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণে বড়পুকুরিয়ার তিন ইউনিটের গুরুত্ব অপরিসীম।

বিদ্যুতের গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মাদ হুসাইন বণিক বার্তাকে বলেন, বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ থাকলে কী ধরনের প্রভাব পড়বে তার একটি রূপরেখা আমরা আগেই করে রেখেছিলাম। কয়লা না পেলে মজুদকৃত কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র চলবে। সে অনুযায়ী রেশনিং করে কেন্দ্র চালাতে হচ্ছে।

পাওয়ার সেলের পরিকল্পনা অনুযায়ী মজুদকৃত কয়লা দিয়ে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত বিদ্যুৎকেন্দ্র চলবে। এরপর কীভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকার বড়পুকুরিয়া নিয়ে নতুন পরিকল্পনা করছে। নতুন ফেজে কয়লা উত্তোলন শুরু হলে আমরা পূর্ণ মাত্রায় বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে সক্ষম হব। তবে নতুন ফেজে কয়লা  উত্তোলনের বিষয়ে কোনো তথ্য তিনি দিতে পারেননি।

পাওয়ার সেলের পরিকল্পনা অনুযায়ী, বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ নিতে কেন্দ্রটির নম্বর ইউনিট চালু রাখার পরিকল্পনা করা হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ১৮০-২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। ফলে প্রতিদিন প্রায় দুই হাজার টন কয়লার প্রয়োজন হবে। অন্যদিকে কয়লার মোট মজুদ রয়েছে আড়াই লাখ টন। পরিমাণ কয়লা দিয়ে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ইউনিটটি চালাতে পারবে পিডিবি। কিন্তু এরপর কেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেলে কীভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা হবে তার কোনো রূপরেখা নেই সংস্থাটির।

বড়পুকুরিয়া কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আবদুল মোত্তালিবের মোবাইলে একাধিকবার কল দেয়া হলে তিনি ফোন ধরেননি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক বদরুল ইমাম বণিক বার্তাকে বলেন, উত্তর অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহে এখনো একক ভূমিকা পালন করছে বড়পুকুরিয়া। উৎপাদন খরচ বিবেচনা করলে এখনো তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে সাশ্রয়ী। সরকার যদি কেন্দ্রের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা দ্রুত নির্ধারণ না করতে পারে, তাহলে বড়পুকুরিয়ার তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে।

তিনি বলেন, উৎপাদনে থাকার চেয়ে বড় সমস্যা হলো বিদ্যুৎকেন্দ্রের যে সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে, সেটি কয়লা উত্তোলনের ওপর নির্ভর করে করার কথা ছিল। কিন্তু সেই মডেল না মেনেই বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছিল। ফলে সমস্যা যে প্রকট হবে তা স্বাভাবিকই।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন