কর্মহীনদের আর্থিক সহায়তা প্রদানের উদ্যোগ

দ্রুততম সময়ে বিতরণ হোক

দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায় দেশে এখন চলছে লকডাউন। চলাচল সীমিতকরণে বিধিনিষেধ জারি করেছে সরকার। নিষেধাজ্ঞার কারণে শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকা ব্যাহত হচ্ছে। প্রেক্ষাপটে তাদের সহায়তায় সরকার ৫৭২ কোটি লাখ ২৫ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়ার খবর মিলছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বরাদ্দকৃত সহায়তা উদ্দিষ্ট পরিবারকে পৌঁছে দেয়ার কথা। স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় সুফলভোগী চিহ্নিত করে উদ্যোগটির সুষ্ঠু বাস্তবায়নই জরুরি।

বস্তুত চলমান লকডাউনে সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম সীমিত হয়ে পড়ায় শ্রমিক, গৃহকর্মী, রেস্তোরাঁকর্মী, দিনমজুরসহ খেটে খাওয়া মানুষের আয়-রোজগারের পথ আবারো রুদ্ধ হয়ে পড়েছে। বিপুল শ্রমজীবী মানুষ এখন কর্মহীন। পরিবার-পরিজন নিয়ে আর্থিক কষ্টে দিনাতিপাত করছেন তারা। অবস্থায় সরকার ঘোষিত আর্থিক সহায়তা কর্ম হারানো এসব শ্রমজীবী মানুষের জন্য নিশ্চয়ই স্বস্তিদায়ক। কিন্তু সহায়তা প্যাকেজ বাস্তবায়ন বড় চ্যালেঞ্জের বৈকি। কেননা নিকট অতীতের অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য সুখকর নয়। গত বছর সাধারণ ছুটির সময় সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় নিম্ন আয়ের মানুষ, দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে খাদ্যসহায়তা দিয়েছিল। তাতে সুফলভোগী পরিবার নির্বাচন থেকে শুরু করে বিতরণসব পর্যায়ে ছিল পদে পদে অনিয়ম। ফলে যাদের বেশি দরকার, তাদের অনেকেই পাননি; আবার যাদের সহায়তা দরকার নেই, তাদের অনেকেই পেয়েছিল। বলা চলে, অনেক সচ্ছল পরিবারও পেয়েছিল খাদ্যসহায়তা। তদুপরি কিছু পরিবার একাধিকবার পেলেও কিছু পরিবার একবারও না পাওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছিল। এসব অনিয়মের জেরে সরকার পরে খাদ্যসহায়তা থেকে সরে এসে কর্মহীন পরিবারগুলোয় নগদ অর্থসহায়তার পদক্ষেপ নিয়েছিল। এমএফএস হিসাবের মাধ্যমে গত দুই ঈদের আগে দুবার দেয়া হয়েছিল অর্থ। এতেও বিভিন্ন জেলায় নগদ অর্থসহায়তার তালিকায় সুফলভোগী নির্বাচনে কিছু অনিয়ম সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছিল। বিশেষত একই পরিবারের একাধিক সদস্যকে অন্তর্ভুক্তি, জনপ্রতিনিধিদের আত্মীয়স্বজনদের নাম সংযোজন, একই ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর বেশ কয়েক জায়গায় ব্যবহারের মতো কিছু ঘটনা ঘটেছিল। কারণে প্রকৃত সুফলভোগীদের অনেকেই নগদ সহায়তাপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছিল। কর্মহীনদের জন্য ঘোষিত এবারের আর্থিক সহায়তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অতীতের পুনরাবৃত্তি কাম্য নয়।

সহায়তা কার্যক্রম বাস্তবায়নের কাজটি রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের জন্য নতুন নয়। দুর্যোগপ্রবণ হওয়ায় দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগে থাকে। প্রতি বছরই বন্যা-ঘূর্ণিঝড়ে বিপুল মানুষের জীবন-জীবিকা সংকটে পড়ে। এছাড়া প্রায়ই সারা বছর সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদসহ স্থানীয় সরকারগুলোর মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়ন করা হয়। তাদের একটি বিস্তৃত তালিকা রয়েছে। আবার অনেক এনজিও প্রতিষ্ঠানও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে। তাদের কাছেও নাজুক জনগোষ্ঠীর একটি দীর্ঘ তালিকা আছে। সময়ান্তরে হয়তো সেখান থেকে অনেকে বাদ পড়েছে, আবার অনেকে হয়তো তাতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সরকারি বেসরকারি সংস্থার তালিকা পর্যালোচনা করে আলোচ্য নগদ সহায়তা প্রদানের জন্য নতুন তালিকা তৈরি করা যেতে পারে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করে সরকারি প্রশাসনকেই কাজটি করতে হবে। সুফলভোগী নির্বাচন থেকে শুরু করে বিতরণ পর্যায়ে আগে যেসব ত্রুটি বা দুর্বলতা ছিল, তা দূর করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। সহায়তা যেন প্রকৃত সুফলভোগীদের কাছে পৌঁছে, তা নিশ্চিতের দায়িত্ব প্রশাসনের।

করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে আবারো দেশে এক অনিশ্চয়তাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। শ্রমশক্তির বেশির ভাগই অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত হওয়ায় আমাদের জন্য এটি আরো উদ্বেগের। এমনিতেই অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মীরা নানাভাবে শ্রম অধিকার থেকে বঞ্চিত। এর মধ্যে কভিডের অভিঘাত দীর্ঘায়িত হলে আরো পর্যুদস্ত হবে তারা। কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়তে হবে জনগোষ্ঠীর অনেককে। নীতিনির্ধারকদের এটি মাথায় রাখা চাই। অনেক দেশেই কভিডের দ্বিতীয় তৃতীয় ঢেউ চলছে। তারা মানুষের জীবন-জীবিকার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করছে। তারা কীভাবে কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়ন করছে এবং সহায়তা কার্যক্রমের ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিতে তাদের অভিজ্ঞতাগুলো কেমন প্রভৃতি বিষয় আমলে নিয়ে আমরাও পদক্ষেপ নিতে পারি। আগে থেকে দেশে বেকারত্বের হার, বিশেষ করে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ঊর্ধ্বমুখী। কভিড পরিস্থিতি এটি আরো বাড়িয়েছে। কাজেই স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থার পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগের কথা ভাবারও সময় এসেছে। অনেক দিন ধরে দেশে বেকার ভাতা প্রবর্তনের কথা বলা হচ্ছে। রাজনৈতিকভাবে আশ্বাস প্রতিশ্রুতি মিললেও এটি বাস্তবায়ন হয়নি। উন্নত দেশগুলোর সমান্তরালে কিছু উন্নয়নশীল দেশেও বেকার ভাতার চল রয়েছে। চলমান মহামারীতে তারা কার্যক্রম আরো জোরদার করেছে। তাদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে সামাজিক সুরক্ষায় বেকার ভাতা চালু করা এখন সময়ের দাবি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন