দোকানপাট ও মার্কেট খোলা রাখার সিদ্ধান্ত

কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি পরিপালন নিশ্চিত করতে হবে

করোনায় দেশে মৃত্যুর রেকর্ডের মধ্যেই একের পর এক বিধিনিষেধ শিথিল করা হচ্ছে। বিভিন্ন পক্ষের দাবি আন্দোলনের মুখে সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। এতে করোনা প্রতিরোধের বিষয়টি গণ্য হয়ে পড়ছে। প্রথম দফায় সিটি করপোরেশন এলাকায় পরিবহন চালু এবং সর্বসম্প্রতি মার্কেটও খুলে দেয়া হলো। বিপুলসংখ্যক মানুষের দৈনন্দিন জীবিকাসহ অর্থনৈতিক বাস্তবতাও যে আর অস্বীকার করা চলে না, সে কথাও বলা হচ্ছে। একই বিবেচনায় বিশ্বের অনেক দেশে লকডাউন শিথিল করা হচ্ছে। তবে ঝুঁকির বিষয়টি কোথাও খাটো করে দেখা হচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কোনো এলাকায় লকডাউন শিথিল করার সময় কর্তৃপক্ষ নাগরিকদের বলে দিয়েছে, শিথিলতার ফলে সংক্রমণ বাড়লে আবারো লকডাউনের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আমাদের অর্থনৈতিক বাস্তবতা যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের ধনী দেশগুলোর মতো নয়। দেশে বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবনধারণ নির্ভর করে দৈনিক আয়-রোজগারের ওপর। ফলে এখানে লকডাউন কার্যকর করা কঠিন বৈকি। সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ তাদের জন্য পর্যাপ্ত নয়। অনেক মানুষ খাদ্যকষ্টের মধ্যে পড়েন। হতদরিদ্র, নিম্নমধ্যবিত্ত এমনকি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের পক্ষেও কর্মহীন, রোজগারহীন থাকা সম্ভব নয়। বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে লকডাউন শিথিল করা বা কোথাও কোথাও তুলে নেয়া হলে স্বাস্থ্যগত দিকে যে বাড়তি ঝুঁকি পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে, তা- খেয়াল রাখা প্রয়োজন।

গণপরিবহন চালু, মার্কেট খুলে দেয়ার মধ্য দিয়ে মানুষের কাছে যেন বার্তা না যায় যে বিপদ কেটে গেছে। বরং আরো জোরালোভাবে বার্তা পৌঁছতে হবে যে বিপদ একটুও কমেনি; স্বাভাবিক কাজকর্ম চলাকালে মানুষে মানুষে সংস্পর্শের মাধ্যমে ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি আরো বেড়েছে। এখন প্রতিটি মানুষকে নিজের সুরক্ষার বিষয়ে আরো সচেতন হতে হবে। সংক্রমণ থেকে মুক্ত থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে নিজেকেই। আমাদের দেশে এখনো বিপুলসংখ্যক মানুষের মধ্যে করোনাভাইরাসের ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে ওঠেনি। ভাইরাসটির সংক্রমণের প্রক্রিয়া সম্পর্কে ধারণার অভাবে অনেক মানুষ সামাজিক শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারে না। তাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে ব্যাপক প্রচারণার উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। গ্রাম, ইউনিয়ন পৌর শহরগুলোর ওয়ার্ড পর্যায়ে জনসচেতনতা বাড়ানোর ওপর বাড়তি জোর দিতে হবে। নতুনভাবে প্রচারণা শুরু করতে হবে প্রধানত বার্তা ছড়িয়ে দিতে যে প্রত্যেককে নিজের স্বাস্থ্য সুরক্ষা জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে মেনে চলার মাধ্যমে।

সরকার বলেছে, জীবন জীবিকা উভয়ই রক্ষা করতে হবে। সেক্ষেত্রে জীবনই অগ্রাধিকার পাবে। যে বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছে, তার মাধ্যমে যদি সংক্রমণ মৃত্যুর হার নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, সেটি বড় অর্জন হবে। তবে সেজন্য সরকারকে বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নিতে হবে এবং বিষয়টিকে সামগ্রিকভাবে দেখতে হবে। যে দেশে এখনো প্রায় এক-চতুর্থাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, মোট শ্রমজীবী মানুষের ৮০ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন, সেখানে জীবন-জীবিকার ভারসাম্য রক্ষা করা কেবল কঠিন নয়, অত্যন্ত দুরূহ। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আয়ের পথ বন্ধ হলে কী হবে, সেটা বিবেচনায় নেয়া জরুরি। তাদের জন্য কোনো ব্যবস্থা না রেখে বিধিনিষেধ কার্যকর করা অসম্ভব। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হাতে নগদ অর্থসহায়তা দ্রুত পৌঁছে দেয়া হতে পারে অন্যতম সমাধান।

এক বছরের বেশি সময় ধরে করোনা পরিস্থিতি বিরাজ করছে। গত বছর দীর্ঘ লকডাউন গেছে। তখন অনেকে জীবিকা হারিয়েছেন। যে দারিদ্র্যের হার ২০১৯ সালের শেষের দিকে ২০ শতাংশের মতো ছিল, সেটা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেড়েছে বলছেন গবেষকরা। নতুন কোনো চাপ নেয়ার ক্ষমতা জনগোষ্ঠীর নেই। সংক্রমণ রোধে বিধিনিষেধ আরোপের সিদ্ধান্ত হয়েছে কিন্তু দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সাহায্য-সহায়তার বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হয়নি। গত সাধারণ ছুটিতে সরকার প্রান্তিক মানুষের জন্য যে বরাদ্দ দিয়েছিল, তা যথাযথভাবে তাদের কাছে পৌঁছেনি। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই। স্থানীয় সরকারগুলোর সহায়তায় দরিদ্রদের তালিকা তৈরি করে জরুরি ভিত্তিতে আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। এসএমই উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে বিনা সুদে ঋণ নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে গত বছরের প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা কিন্তু খুব একটা সুখকর নয়।

গত বছর দেশে করোনা মহামারী দেখা দেয়ার পর আমরা জীবন জীবিকা নিয়ে লড়াই করেছি। কিন্তু এবারের চ্যালেঞ্জ গতবারের চেয়েও বেশি। কারণ এবার নতুন করে করোনার তিনটি ভ্যারিয়েশন (বৈচিত্র্য) দেশে চলে এসেছে। সেগুলো হলো ব্রিটিশ, সাউথ আফ্রিকান ব্রাজিলিয়ান। তিনটি ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ছড়াচ্ছে খুবই দ্রুতগতিতে। পরিস্থিতি যদি নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, তাহলে লকডাউন আমাদের মতো করে বাস্তবায়ন করতে হবে। নভেল করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ায় দেশজুড়ে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে ইরান। করোনা সংক্রমণের হার হিসেবে রঙভিত্তিক শহর কাউন্টির তালিকা হালনাগাদ করা হয়েছে। সাদা রঙের অর্থ ওই এলাকায় করোনা সংক্রমণের ভয় নেই, আর লাল রঙ দিয়ে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল চিহ্নিত করা হয়েছে। লাল রঙের এলাকাগুলো অন্তত দুই সপ্তাহ আংশিক লকডাউন থাকবে। অর্থাৎ সেখানে জরুরি সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বাদে সব বন্ধ থাকবে। তবে এক-তৃতীয়াংশ সরকারি কর্মকর্তারা অফিস করতে পারবেন। বাংলাদেশেও এলাকাভিত্তিক লকডাউন ফলপ্রসূ হতে পারে। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের মতে, সারা দেশে প্রচলিত লকডাউনের পরিবর্তে কভিডের রোগীর সংখ্যা চিহ্নিত হওয়ার ভিত্তিতে ছোট ছোট এলাকা (যেমন ইউনিয়ন বা উপজেলা)-কেন্দ্রিক লকডাউন করা যেতে পারে। বিষয়টি পর্যালোচনা সাপেক্ষে বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে। তাছাড়া যতদিন করোনার প্রভাব থাকবে, ততদিন বাড়ির বাইরে অবস্থানের সময় বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক ব্যবহার স্বাস্থ্যবিধি মানার ওপরও জোর দেয়া প্রয়োজন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন