গণপরিবহন চললেও জমেনি বইমেলা

আল ফাতাহ মামুন

মার্চের গরমে নভেল করোনাভাইরাসের দাপট কমে আসবে মূলত এমন চিন্তা থেকেই ফেব্রুয়ারির মেলা মার্চ-এপ্রিলে গড়ায়। সব হিসেবে-নিকেশ পাল্টে দিয়ে মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে কভিড-১৯ সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী। পরিস্থিতির ক্রমাগত অবনতিতে এপ্রিল থেকে শুরু হয়েছে এক সপ্তাহের লকডাউন। ফলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বইমেলা এখন জনশূন্য প্রান্তরে পরিণত হয়েছে। যতই দিন যাচ্ছে, প্রকাশকদের দীর্ঘশ্বাস ততই ভারী হচ্ছে। প্রকাশকরা বলছেন, বাংলা একাডেমি আমাদের পথে বসিয়ে ছাড়ল। এতদিন বেচাবাট্টা যা- ছিল, লকডাউনে শূন্য হাতে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে।

লকডাউনের তৃতীয় দিনে গণপরিবহন চালু হলেও বইমেলায় পাঠক-দর্শনার্থীর উপস্থিতি ছিল খুবই কম। গত তিনদিন বিক্রির খাতাই খোলেনি এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৯৫ শতাংশ।

সরেজমিন বইমেলা ঘুরে দেখা যায়, ব্যক্তিগত গাড়ি বা মোটরসাইকেলে চড়ে অল্প কয়েকজন দর্শনার্থী মেলায় এসেছেন। এর মধ্যে গণমাধ্যমকর্মী লেখকদের সংখ্যাই বেশি। প্রায় স্টলেই বিক্রয়কর্মীদের অবসর সময় যাপন করতে দেখা গেছে। তবে কয়েকটি প্যাভিলিয়নে তুলনামূলক বেশি ভিড় দেখা গেছে। পাঠকরা পরিচিত দু-একটি প্যাভিলিয়নে ঢুকে বইপত্র নেড়েচেড়ে দেখেন। প্রথমা প্রকাশনের বিক্রয়কর্মী তামান্না আক্তার বলেন, এতদিন বেচাবাট্টা ভালোই হয়েছে। লকডাউনের দিন থেকে অবস্থা খারাপের দিকে।

ঐতিহ্য, সময় প্রকাশন, পাঞ্জেরী, জিনিয়াস, সালাউদ্দিন বইঘর, সরল রেখা প্রকাশনা সংস্থাসহ বেশ কয়েকটি স্টলের বিক্রয়কর্মীরা বলেন, বইমেলা শুরু হওয়ার পর থেকেই করোনা সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে। তখনো টুকটাক বেচাবিক্রি হতো। মানুষজন আসত। বই দেখত। হাতে নিত। ভালো লাগত। লকডাউনের পর থেকে মানুষ তো দূরের কথা কাকপক্ষীও আসে না। এক-দুজন এলেও এক-দুটো প্যাভিলিয়নে ঢু মারে, কিন্তু স্টলে ঢোকে না।

সরল রেখা প্রকাশনা সংস্থার প্রকাশক নাজমুস সাদাত বণিক বার্তাকে বলেন, বইমেলায় অর্থনীতির একটি বিষয় আছে। কিন্তু তারও আগে প্রদর্শনীটা গুরুত্বপূর্ণ। মানুষজন আসবে, দেখবে, আমাদের প্রতিষ্ঠান এবং প্রকাশিত বই সম্পর্কে জানবে। বিক্রি না হলেও প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন প্রচার তো হলো। কিন্তু লকডাউনের পর থেকে মানুষই আসছে না।

পুস্তক প্রকাশক বিক্রেতা সমিতির নেতারা বলেন, আমরা তো এমন বইমেলা চাইনি। দীর্ঘ এক বছর পর প্রকাশকরা ধারদেনা করে মেলা করেছেন, কিন্তু শুরু থেকেই মেলা নিয়ে ছিনিমিনি খেলে আসছে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ। ক্ষোভ প্রকাশ করে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক বিক্রেতা সমিতির পরিচালক জহুরুল ইসলাম বুলবুল বলেন, লকডাউনে গণপরিবহন বন্ধ রেখে মেলা খোলা রাখার কোনো মানেই হয় না। প্রকাশকরা তো এমনিতেই মড়া, তাদের ওপর খাঁড়ার ঘা দিল বাংলা একাডেমি। আগামী বইমেলা আসতে আসতে অনেক প্রকাশককে ব্যবসা ছেড়ে দিতে হবে।

একই অবস্থা মেলার শিশুতোষ প্রকাশকদের। ফুলকলি, ঝিলিমিলি, রাঙা সকাল, রঙতুলি, ঝিঙেফুলসহ বেশ কয়েকটি প্রকাশনার বিক্রয়কর্মীরা বলেন, অন্যান্য বছর শিশুদের বই বেশি বিক্রি হতো। কিন্তু বছর করোনা সংক্রমণের ঝুঁকির কারণে মেলায় শিশুদের উপস্থিতি খুবই কম হয়েছে। গত তিনদিনে শিশুতোষ প্রকাশকদের বিক্রির খাতায় কোনো অংক যোগ হয়নি বলে আফসোস করতে শোনা গেছে প্রকাশকদের। শিশুতোষ বই বিক্রির জন্য পাঞ্জেরীর বেশ নামডাক রয়েছে। কিন্তু গতকাল পাঞ্জেরীর প্যাভিলিয়নও ছিল প্রায় দর্শকশূন্য।

শুরু থেকেই বইমেলায় পাঠক-দর্শনার্থীর উপস্থিতি কম ছিল এবং লকডাউনে প্রকাশকরা চূড়ান্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন উল্লেখ করে জ্ঞান সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি ফরিদ আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, প্রকাশকদের অবস্থা খুবই খারাপ। খুব আশা ছিল এবারের মেলা ঘিরে। কিন্তু পরিস্থিতি কোনোভাবেই আমাদের অনুকূলে আসেনি। সর্বশেষ লকডাউনে প্রকাশকরা চূড়ান্ত ক্ষতিগ্রস্ত হলো।

প্রকাশনা শিল্প বাঁচিয়ে রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, একেকজন প্রকাশক থেকে ১০ লাখ টাকা খরচ করে বইমেলা করেছেন। বেশির ভাগ প্রকাশকই ধারদেনা করে টাকার জোগান দিয়েছেন। কিন্তু মেলায় দোকান খরচও ওঠেনি প্রকাশকদের।

বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী বণিক বার্তাকে বলেন, করোনাকালীন মেলা স্বাভাবিক সময়ের মতো হবে না জেনেই প্রকাশকরা মেলা করতে এসেছেন। প্রকাশক নেতারাও বিষয়টি বুঝেই ফেব্রুয়ারির মেলা মার্চ-এপ্রিলে করার দাবি জানিয়েছিলেন। মেলা শুরু হওয়ার পরও পরিস্থিতি ভালো ছিল। হঠাৎ করোনা পরিস্থিতির অবনতি হয়। সরকার যেভাবে দিকনির্দেশনা দিয়েছে, আমরা সেভাবেই মেলা চালিয়ে যাচ্ছি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন