পর্যালোচনা

ডিজিটাল মুদ্রার অভীষ্ট লক্ষ্য ও বাস্তবতা

ড. মোহাম্মদ দুলাল মিয়া

মনে করেন আপনি দুটো পিত্জার ফরমায়েশ দিলেন, কিন্তু প্রচলিত মুদ্রা (যেমন টাকা) ছাড়া অন্য কোনো কিছুর বিনিময়ে তার মূল্য পরিশোধ করবেন। আপনি কত টাকা মূল্যের অন্য কোনো বস্তু পরিশোধ করবেন? উত্তর খুব সোজা, দুটো পিত্জার যা দাম হয়, যেমন হাজার বা হাজার টাকা বা সমপরিমাণ মূল্যের বস্তু। এমনকি হতে পারে যে পরিশোধিত বস্তুর মূল্য কয়েকশ বা কয়েক হাজার কোটি টাকা? হতেই পারে না, অসম্ভব। আসলে এমনটাই হয়েছিল বাস্তবে। ২০১০ সালের ২২ মেলাসলো হ্যানিয়েজনামের জনৈক ব্যক্তি ১০ হাজারবিটকয়েন’-এর বিনিময়ে দুটো পিত্জা কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। কোনো এক সরবরাহকারী তাকে পিত্জা দুটো সরবরাহ করেছিল প্রতিশ্রুতবিটকয়েন’-এর বিনিময়ে। এটাই ছিলবিটকয়েন’-এর মাধ্যমে সর্বপ্রথম কোনো বাণিজ্যিক লেনদেন। ২০১০ সালে একটিবিটকয়েন’-এর মুদ্রামান ছিল মাত্র কয়েক টাকা। ২০২১ সালের মার্চে প্রতিটি বিটকয়েনের মুদ্রামান ৬০ হাজার ৮০০ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়। সেই হিসেবে, ১০ হাজার বিটকয়েনের বর্তমান মূল্য ৬০ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলার, যা টাকায় রূপান্তর করলে দাঁড়ায় হাজার কোটি টাকারও বেশি। দুটো পিত্জার মূল্যমাত্র।

২০০৮ সালে সাতোশি নাকামোতো নামে (মনে করা হয় এটা তার ছদ্মনাম) একজন জাপানিজ নাগরিক একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন, যেখানে তিনি দেখান যে কোনো রকম মধ্যস্থতাকারী (যেমন আর্থিক প্রতিষ্ঠান) ছাড়া কীভাবে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির কাছে (পিয়ার টু পিয়ার) টাকা নগদে আদান-প্রদান করা যায়। প্রশ্ন ওঠে, মধ্যস্থতাকারী পরিহার করার প্রয়োজনীয়তা কি? প্রথমত, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে অর্থ প্রেরণে, সেটা কেনাকাটা বা অন্য যেকোনো প্রয়োজনেই হোক, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হতে হয়। আর্থিক প্রতিষ্ঠান লেনদেন সম্পন্ন করতে কিছু ফি চার্জ করে। যেমন এমএফএসে টাকা আদান-প্রদানে সাধারণত শতাংশ ফি দিতে হয়, যা বাস্তবে অনেক বেশি (ব্যাংকের ক্ষেত্রে কিছুটা কম) কেনাকাটায় বহুল ব্যবহূত ভিসা বা মাস্টার কার্ডের ফি নেহাত কম নয়। দ্বিতীয়ত, যেকোনো আর্থিক লেনদেনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি নিতে হয়। এতে যেমন কালক্ষেপণ হয়, তেমনি সব রকমের লেনদেন ইচ্ছামতো সম্পন্ন করা অনেক সময় সম্ভব হয় না।

তৃতীয়ত, অনেক দেশের প্রচলিত মুদ্রার এত বেশি অবমূল্যায়ন হয় যে আদতে মুদ্রার অন্তর্নিহিত কোনো মূল্য থাকে না। আফ্রিকা মহাদেশের অনেক দেশেরই এমন অবস্থা। হাল আমলে ভেনিজুয়েলার মুদ্রার কথা বলা যেতে পারে। অবমূল্যায়ন হতে হতে মুদ্রাটির অন্তর্নিহিত মূল্য একেবারে তলানিতে ঠেকেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যেহেতু কাগজি বা ধাতব মুদ্রা (যাদের বলেফিয়াট মানি’) সরবরাহের একক অধিকার রয়েছে, সরকারের চাহিদামতো মুদ্রার সরবরাহ বাড়ানো-কমানোতে মুদ্রার প্রকৃত মূল্যের হেরফের হয়। মোট কথা, ‘ফিয়াট মানি ওপর সরকারের একটা প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ থাকে। এসব সমস্যা দূর করার অভিপ্রায়ে ডিজিটাল মুদ্রা বা ক্রিপ্টোকারেন্সি, যেমন বিটকয়েনের আবিষ্কার, অন্তত সাতোশি নাকামোতোসহ ডিজিটাল মুদ্রায় যারা বিশ্বাস করেন, তাদের ধারণা এমনই।

ডিজিটাল মুদ্রা বা ক্রিপ্টোকারেন্সি হলো প্রচলিত মুদ্রার একটি বিকল্প। কোনো দেশের মুদ্রার নিয়ন্ত্রণ যেমন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে কেন্দ্রীভূত, ডিজিটাল মুদ্রার ক্ষেত্রে সেটা একেবারেই বিপরীত, বিকেন্দ্রীভূত। যেমন গতানুগতিক নিয়মে আপনার কাউকে টাকা পাঠাতে হলে কোনো ব্যাংকে অবশ্যই অ্যাকাউন্ট থাকতে হবে এবং সেই অ্যাকাউন্টের মাধ্যমেই লেনদেন সম্পন্ন করতে হবে। আর ক্রিপ্টোকারেন্সির ক্ষেত্রে আপনাকে কোনো মাধ্যম হয়ে যেতে হবে না। আপনার সংগ্রহে যদি যথেষ্ট পরিমাণ ক্রিপ্টোকারেন্সি থাকে, তবে যে কাউকেই সরাসরি পাঠাতে পারবেন বা কোনো কিছুর মূল্য পরিশোধ করতে পারবেন। এখানে শুধু দাতা এবং গ্রহীতা জড়িত (পিয়ার টু পিয়ার) এভাবে আপনি প্রতিদিন যে পরিমাণ লেনদেন করবেন, তা যথাযথভাবে একটি নির্দিষ্ট খতিয়ানে লিখে রাখবেন। খতিয়ানের প্রতিটি পৃষ্ঠা একটি ব্লকের মতো। আপনি যতগুলো পাতা তৈরি করবেন একটার পর একটা চেইনের মতো ব্লক হিসেবে খতিয়ানে যোগ হতে থাকবে। এজন্যই ক্রিপ্টোকারেন্সি প্রযুক্তিকে বলা হয় ব্লকচেইন। যারা ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করেন তাদের প্রত্যেকের একটি সমন্বিত লেনদেনের রেকর্ড তৈরি করতে খতিয়ানের নিজস্ব কপি রয়েছে। প্রতিটি নতুন লেনদেন যেভাবে ঘটে, ঠিক তেমনভাবে সফটওয়্যারে লিপিবদ্ধ করে এবং সব রেকর্ডকে অভিন্ন, নির্ভুল রেখে নতুন ব্লকচেইনের প্রতিটি অনুলিপি একই সঙ্গে আপডেট করে। ব্লকগুলো মুছে ফেলা, টেম্পারিং বা কোনো রকম পরিবর্তনের ঝুঁকি থেকে সুরক্ষিত। কারণ, প্রতিটি লেনদেনের একটি ডিজিটাল রেকর্ড এবং স্বাক্ষর থাকে যা শনাক্ত, বৈধতা, সংরক্ষণ এবং শেয়ারিংয়ের নিশ্চয়তা প্রদান করে।

যারা ব্লকগুলোকে বৈধতার কাজে নিযুক্ত থাকে, তাদের বলা হয় ক্রিপ্টো মাইনার বা নোড (খনি শ্রমিক) স্বর্ণ যখন বিনিময়ের মাধ্যম ছিল, তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একক কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। যারা খনি থেকে স্বর্ণ আহরণ করতে পারত, তারাই স্বর্ণের মালিক হতো এবং আহরিত স্বর্ণের বিনিময়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আদান-প্রদান করতে পারত। তেমনি ক্রিপ্টো মাইনার অত্যাধুনিক কম্পিউটারের সাহায্যে কিছু সমীকরণ (ইকুয়েশন) সমাধান করার মাধ্যমে নতুন নতুন ব্লক গঠন করে চেইনে সংযুক্ত করে। এভাবেই ব্লকচেইন তৈরি হয়। বিনিময়ে মাইনাররা ক্রিপ্টোকারেন্সি পেয়ে থাকে। একটি নতুন ব্লক যুক্ত করার সঙ্গে সঙ্গে পরের সমীকরণটি জটিল থেকে জটিলতর হতে থাকে এবং সমীকরণ এমনভাবে সাজানো হয় যেন একটি নির্দিষ্ট নোড অনেকগুলো সমীকরণ সমধানের মাধ্যমে বেশি পরিমাণ ক্রিপ্টোকারেন্সির মালিক হতে না পারে। এভাবেই ক্রিপ্টোকারেন্সির বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত করা হয়। বর্তমানে সাড়ে হাজারেরও বেশি ক্রিপ্টোকারেন্সি বিদ্যমান। তন্মধ্যে মাত্র কয়েকটি প্রধান, যেমন বিটকয়েন, ইথেরিয়াম, লাইটকয়েন ইত্যাদি। তবে বিটকয়েনের দামই ধরাছোঁয়ার বাইরে। গত এক বছর প্রায় হাজার ২০০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৬০ হাজারের মার্কিন ডলারের বেশি দামে অবস্থান করছে বিটকয়েন। ২১৪০ সাল পর্যন্ত ২১ মিলিয়ন বিটকয়েন মাইন করা যাবে এবং এরই মধ্যে সাড়ে ১৮ মিলিয়নের বেশি মাইনিং করা হয়েছে।

তবে ক্রিপ্টোকারেন্সি তার ঈপ্সিত লক্ষ্য অর্জনে কতটুকু সফল হবে, তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক আছে। প্রথমত, ক্রিপ্টোকারেন্সির লক্ষ্য হলো প্রচলিত মুদ্রাকে প্রতিস্থাপন করে ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে লেনদেন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা। একসময় বিনিময়ের মাধ্যম ছিল স্বর্ণমুদ্রা, যা বহন সংরক্ষণ করা জটিল, ব্যয়সাপেক্ষ এবং ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। তাই ফিয়াট মানি বা কাগজি মুদ্রার আবির্ভাব ঘটে। স্বর্ণের একটি বিশেষ সুবিধা হলো যে এর একটি অন্তর্নিহিত মূল্য বিদ্যমান। যেমন অলংকার বানিয়ে ব্যবহার করার কারণে স্বর্ণের ব্যবহারিক দিক বর্তমান। অন্যদিকে, কাগজি মুদ্রার অন্তর্নিহিত কোনো মূল্য নেই, কিন্তু এটা একটা বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত। যেমন চাহিবা মাত্র ইহার (কাগজি মুদ্রার) বাহককে দিতে (কাগজে লিখিত মূল্যের সমপরিমাণ) বাধ্য থাকিবে। অর্থাৎ কেউ যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে কাগজটি (যেমন টাকা) জমা দিয়ে সমপরিমাণ দ্রব্য (স্বর্ণ) দাবি করে, ব্যাংক তা দিতে বাধ্য থাকিবে। কাগজি মুদ্রার মাধ্যমে যারা লেনদেন করে সবাই এটা বিশ্বাস করে যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দাবি পূরণে কখনো ব্যর্থ হবে না।

ক্রিপ্টোকারেন্সিতে পরিশোধের ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে যে বিশ্বাসের চেয়ে ক্রিপ্টোগ্রাফিক প্রমাণের ভিত্তিতে লেনদেন অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য। কিন্তু কাগজি মুদ্রার মতোই ক্রিপ্টোকারেন্সির অন্তর্নিহিত কোনো মূল্য নেই। ডলারের ভিত্তিতে ক্রিপ্টোকারেন্সির দাম নির্ধারণ হয় চাহিদা জোগানের ভিত্তিতে। আর এখানেই সব বিপত্তি। কিছু দেশে যেমন যুক্তরাজ্য, নাইজেরিয়া, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ায় ক্রিপ্টোকারেন্সিতে লেনদেনের পরিমাণ বাড়লেও ডিজিটাল মুদ্রার ব্যবহার এখনো একেবারেই নগণ্য। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হলো, ক্রিপ্টোকারেন্সিকে প্রচলিত মুদ্রায় রূপান্তর করা। ডিজিটাল মুদ্রা এখনো বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে সার্বজনীন নয়, তাই ক্রিপ্টোকারেন্সি গ্রহণে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের যথেষ্ট অনীহা। কারণ প্রচলিত মুদ্রার বিপরীতে ক্রিপ্টোকারেন্সির দাম খুব বেশি ওঠানামা করে। এজন্য স্থিতিশীল বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ডিজিটাল মুদ্রা এখনো বাস্তবতার নিরিখে জুতসই হয়ে উঠতে পারেনি।

তদুপরি, যেহেতু লেনদেনের কোনো কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ নেই, অপরাধমূলক কাজে যেমন নেশাজাতীয় দ্রব্য বা কালোবাজারে লেনদেন হয় এমন সব পণ্যের কেনাবেচায় ডিজিটাল মুদ্রার ব্যবহার বেড়ে গেলে দেখার কেউ থাকবে না। সেই সঙ্গে সন্ত্রাসমূলক কর্মকাণ্ডে অর্থের জোগান বেড়ে যেতে পারে অনেক বেশি। আবার, অনেক নামিদামি কোম্পানি যেমন ফেসবুক, অ্যামাজন ইত্যাদি বহুজাতিক কোম্পানি নিজেদের ক্রিপ্টোকারেন্সি তৈরিতে অনেক দূর এগিয়েছে। ফেসবুক এরই মধ্যেলিব্রানামের ক্রিপ্টোকারেন্সি চালু করার কথা ছিল। রাষ্ট্রীয় চাপের মুখে সেটা পিছিয়ে গেছে। তবে নামের পরিবর্তন করেডায়েমনামে নতুন ক্রিপ্টোকারেন্সি বাজারে আনার ঘোষণা দিয়েছে ফেসবুক।

এসব বড় বড় কোম্পানি যদি নিজেদের মুদ্রাবাজারে নিয়ে আসে এবং তা বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার হয়, তবে গতানুগতিক মুদ্রানীতি কোনোভাবেই মুদ্রার চাহিদা জোগানের সমন্বয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সমর্থ হবে না। আবার ফেসবুক বা অ্যামাজনের কাছে সংরক্ষিত গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকা মূল্যের ডিজিটাল মুদ্রা জমা থাকবে, কোম্পানিগুলো এসব সঞ্চিত মুদ্রা ব্যবহার করলে গ্রাহক জানতেও পারবে না আবার কোনো রকম রিটার্নও পাবে না। অন্যদিকে কোম্পানিগুলো অর্থের তারল্যের দিক দিয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠবে। এতে করে ধনী-গরিবের বৈষম্য বেড়ে যাবে। তদুপরি, বর্তমান মুদ্রা ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর যে বিশ্বাস, সেটা কতিপয় বড় কোম্পানির উপস্থাপন করা হবে, যা সমষ্টিক অর্থনীতির জন্যে সুফল বইয়ে আনবে না। এসব সমস্যার সমধান করতে পারলেই কেবল ডিজিটাল মুদ্রা প্রচলিত মুদ্রাকে প্রতিস্থাপন করার যে স্বপ্ন সেটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।

 

. মোহাম্মদ দুলাল মিয়া: সহযোগী অধ্যাপক বিভাগীয় প্রধান, ফাইন্যান্স অর্থনীতি বিভাগ, নিজওয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ওমান

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন