অভিজ্ঞতা বিনিময়

স্বাস্থ্য সমতা নিয়ে কিছু কথা

ড. আহমদ মোশতাক রাজা চৌধুরী

১৯৯৫ সালে রকফেলার ফাউন্ডেশন সুইডিশ সরকারের অর্থানুকূল্যে একটি আন্তর্জাতিক প্রকল্প শুরু হয়, যার উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বিদ্যমান বৈষম্য বা হেলথ (ইন) ইকুইটি বিষয়ে বিশদ পর্যালোচনা করা। গ্লোবাল হেলথ ইকুইটি ইনিশিয়েটিভ নামে প্রকল্পে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রায় ১০০ জন খ্যাতিমান বিশেষজ্ঞ অংশগ্রহণ করেন। ঊর্ধ্ব, মধ্যম নিম্ন আয়ভুক্ত বেশ কয়েকটি দেশের ওপর কেস স্টাডি করা হয়। বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশ থেকে আব্বাস ভূঁইয়া এবং আমি এতে যুক্ত হই। পরবর্তী সময়ে ফারুক আহমেদ (বিশ্বব্যাংক, ঢাকা; পরে নির্বাহী পরিচালক, ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনাল) আমাদের সঙ্গে যোগ দেন। প্রকল্পের জন্য আমরা একটি কেস স্টাডি তৈরি করি, যাতে মতলবে ব্র্যাক-আইসিডিডিআর,বির যৌথ প্রকল্প থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা উপস্থাপন করা হয়। এখানে পুনরুল্লেখ করা যায় যে মতলবে নিবিড় এক গবেষণায় আমরা দেখেছিলাম কীভাবে ব্র্যাকের নারীকেন্দ্রিক ক্ষুদ্রঋণ প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম স্বাস্থ্য বিষয়ে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য নিরসনে বিশেষ অবদান রাখছে। পরবর্তী সময়ে একটি বই প্রকাশ করে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, যেখানে আমাদের কেস স্টাডি স্থান পায়। বইটিকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতার একটি উপাখ্যান বলা চলে। Challenging Inequalities in Health : From ethics to actions’ শিরোনামের বইটিতে মোট ২১টি অধ্যায় রয়েছে। তাত্ত্বিক বিষয় ছাড়াও বইয়ে ভিয়েতনাম, কেনিয়া, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চিলি, ভারত, জাপান, দক্ষিণ আফ্রিকা, সুইডেন বাংলাদেশের কেস স্টাডি স্থান পায়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বিখ্যাত অনেকেই বিভিন্ন অধ্যায়ে তাদের নাম লেখান। তাদের মধ্যে আছেন অমর্ত্য সেন, মার্গারেট হোয়াইটহেড, লিঙ্কন চেন, জিওভেন্নি বানিলিঙ্গার, বিল শাও, লুসি জিলসন, টিম ইভান্স প্রমুখ। বইয়ে আমাদের লেখা স্থান পাওয়ায় আমরা খুবই উল্লসিত হয়েছিলাম। পরিতৃপ্তি পেয়েছিলাম এই ভেবে যে এর মাধ্যমে উন্নয়নে ব্র্যাকের প্রভাবের প্রামাণিক তথ্যরাজি আন্তর্জাতিকভাবে প্রচারিত হয়েছিল।

হেলথ ইকুইটির প্রকল্পের সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। বইটির কাজ যখন শেষ পর্যায়ে তখন এর প্রধান সম্পাদক টিম ইভান্স (রকফেলার ফাউন্ডেশন) আমাকে ফোন করলেন। বললেন, বইটিতে তিনি উন্নয়নশীল দেশের কোনো নেতার লেখা মুখবন্ধ আকারে অন্তর্ভুক্ত করতে চান। বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বাড়ানোর একটি সুযোগ ভেবে সঙ্গে সঙ্গেই আমি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর নাম প্রস্তাব করলাম। তিনি রাজি হয়ে গেলেন। কিন্তু কীভাবে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর কানে পৌঁছানো যায়? খুব বেশি অসুবিধা হলো না। কারণ আমার ভাই তখন প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব। তার দ্বারস্থ হলাম। ঝামেলা ছাড়াই প্রধানমন্ত্রীর সায় পাওয়া গেল। এবারে লেগে গেলাম মুখবন্ধ লিখতে। কয়েকবার টিম ইভান্সের সঙ্গে পাণ্ডুলিপি বিনিময়ের পর পাঠিয়ে দিলাম প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। মুখবন্ধে শেখ হাসিনা বাংলাদেশ থেকে সব ধরনের বৈষম্য দূর করতে তার প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন। ২০০১ সালে যখন প্রধানমন্ত্রীর ছবিসহ মুখবন্ধটি আলোর মুখ দেখল, তখন নতুন প্রধানমন্ত্রী দেশের দায়িত্বে। বইটির একটি কপি আমরা শেখ হাসিনার কাছে পাঠিয়েছিলাম।

১৯৯৮ সালে অমর্ত্য সেন নোবেল পুরস্কার পেলে পৃথিবীময় বাঙালিদের মধ্যে আনন্দের ঝড় বয়ে যায়। হেলথ ইকুইটি প্রকল্পের তখন শেষ পর্যায়। সমাপনী কর্মশালা হবে ঢাকায়। আয়োজক ব্র্যাক আইসিডিডিআর,বি। টিম ইভান্সের সঙ্গে বিষয় নিয়ে সবসময় যোগাযোগ হচ্ছিল। প্রায় ৫০ জন বিশ্বনন্দিত গবেষক আসবেন। তাদের ভিসা, টিকিট ইত্যাদি ছাড়াও প্রকল্পের ভাবমূর্তি এবং আকর্ষণ কীভাবে বাড়ানো যায়, তা নিয়ে প্রতিনিয়ত আলোচনা হতো। টেলিফোনে একদিন টিমকে বললাম, অমর্ত্য সেনকে নিয়ে আসা যায় না? মনে হলো প্রস্তাবটি তাকে খুব আন্দোলিত করেছে। অমর্ত্য সেনের সঙ্গে লিঙ্কন চেনদের (হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি) অনেক জানাশোনা ছিল। টিম লিঙ্কনকে ফোন করলেন। দুদিন পরই লিঙ্কনের ফিরতি ফোন। অমর্ত্য সেন রাজি হয়েছেন। সুইডেনে আনুষ্ঠানিকভাবে নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করেই তিনি কলকাতা আসবেন এবং তার পরেই ঢাকা। কী যে উল্লাস আমাদের মধ্যে! সঙ্গে সঙ্গেই আলাপ করলাম আবেদ ভাই এবং আইসিডিডিআর,বির পরিচালকের সঙ্গে। দুজনেই সায় দিলেন। শুরু হলো বিস্তারিত আয়োজন। মূলত দুটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান থাকবেপ্রারম্ভিক অনুষ্ঠান, যেখানে অমর্ত্য সেন বক্তৃতা করবেন এবং তিন দিনব্যাপী মূল বৈজ্ঞানিক কর্মশালা, যেখানে সংশ্লিষ্ট গবেষকরা তাদের তথ্যগুলো এবং বিশ্লেষণ উপস্থাপন করবেন। ভাবলাম, প্রারম্ভিক অনুষ্ঠানে যদি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে আসা যায় তাহলে এর গুরুত্ব অনেক বাড়বে। মিডিয়ায়ও ফলাও করে প্রচার হবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে অনুষ্ঠানে আসার জন্য রাজি করানো যাবে? অনুষ্ঠানটি হবে ঢাকার বাইরে রাজেন্দ্রপুরের ব্র্যাক সেন্টারে। এটাও একটা সীমাবদ্ধতা বলে মনে হলো। তবুও আমার ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ করলাম। তাকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম কেন প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে যোগ দেয়া উচিত হবে। একে তো এটা একটা হাইপ্রোফাইল গবেষকদের সমাবেশ, উপরন্তু এখানে বাংলাদেশের কেস স্টাডিও উপস্থাপিত হবে, যেখানে দেশের বৈষম্য দূরীকরণের সফলতা বিধৃত রয়েছে। তার ওপর রয়েছে অমর্ত্য সেনের উপস্থিতি। ভাই সফল হলেন। জানালেন, প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে রাজি হয়েছেন, এমনকি রাজেন্দ্রপুরে যেতেও। প্রধানমন্ত্রীকে ধরনের অনুষ্ঠানে পাওয়া বেশ এক বিড়ম্বনাও বটে। প্রটোকল, নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনার জন্য আমাদের ডাক এল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ব্র্যাকের উপদেষ্টা ফারুক চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হলাম প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। সেখানে আমার ভাই ছিলেন। তিনি নিয়ে গেলেন মুখ্য সচিবের কাছে। ফারুক ভাইকে দেখে মুখ্য সচিব ভীষণ খুশি হলেন এবং আমাদের সভার এক সফল পরিসমাপ্তি ঘটল। ব্যস্ত হয়ে গেলাম বিস্তারিত আয়োজনে। প্রায় প্রতিদিনই আমরা মিলিত হতাম ব্র্যাকে, না-হয় আইসিডিডিআর,বি-তে। আমাদের সঙ্গে বড় একটি টিম ছিল।

মধ্য ডিসেম্বরের সেই সাড়ম্বর গুরুগম্ভীর অনুষ্ঠান ছিল বিশেষ তাত্পর্যময়। দেশের সব বিশিষ্টজনের সমাগম ঘটেছিল সেই অনুষ্ঠানে। ফজলে হাসান আবেদ, ফারুক চৌধুরী, কামাল হোসেন, হামিদা হোসেন, মুহাম্মদ ইউনূস, আনিসুর রহমান, রেহমান সোবহান, আনিসুজ্জামান, সৈয়দ হুমায়ুন কবীর, ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, সিমিন মাহমুদ, জামিলুর রেজা চৌধুরী, রাশেদা কে. চৌধূরী, সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী, তাহেরুন্নেসা আবদুল্লাহ, মাহফুজ আনাম, সুলতানা কামালসহ অনেকেই ছিলেন। আরো ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব সৈয়দ আবদুস সামাদ এবং একান্ত সচিব আহমদ মাহমুদুর রাজা চৌধুরী। অনুষ্ঠানে তোলা একটি ছবি এখনো আমার স্টাডিতে শোভা পাচ্ছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে কিংবদন্তি তিন বাঙালিকেঅমর্ত্য সেন, মুহাম্মদ ইউনূস ফজলে হাসান আবেদ।

আবেদ ভাই অমর্ত্য সেনকে নিয়ে রাজেন্দ্রপুরে পৌঁছলেন  বেলা ৩টার দিকে। মূল ফটকে তাকে ফুল দিয়ে বরণ করল আমাদের দুই সন্তান ওয়ামেক ইমিতা। ওয়ামেক তার নিজের আঁকা পোর্ট্রেট তুলে দিল অমর্ত্য দার হাতে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অমর্ত্য সেন হেলথ ইকুইটি নিয়ে তার দর্শন তুলে ধরলেন। সমাজ পরিবর্তনে রাজা রামমোহন রায় থেকে শুরু করে যুগের বিভিন্ন মনীষীর দর্শন এবং তাদের অবদানের কথা অতিথিদের স্মরণ করিয়ে দিলেন। তিনি বাংলাদেশের উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং এতে ব্র্যাকসহ অনেকের অবদানের কথা উল্লেখ করেন। অমর্ত্য দার সঙ্গে আরো অনেকবার সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছে। ২০০৬ সালে হেলথ ওয়াচের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি ছিলেন প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি ছিলেন জর্জ সরোজ অ্যাড্রিয়েন জার্মেইন। এর কিছুদিন পরেই অমর্ত্য দার নিমন্ত্রণে ক্যালকাটা গ্রুপ-এর এক সভায় যোগ দিতে কলকাতা গিয়েছিলাম। সেখানে আমি বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে একটি প্রবন্ধ পেশ করেছিলাম। সেই সভায় গ্রুপের অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশ থেকে আরো উপস্থিত ছিলেন রেহমান সোবহান রওনক জাহান। শেষ দেখা হয়েছে বছর তিনেক আগে, বোস্টনের ক্যামব্রিজে। হার্ভার্ড স্কোয়ারের এক রেস্টুরেন্টে আমাকে মধ্যাহ্নভোজে আপ্যায়িত করেছিলেন। তার সঙ্গে সেলফিও তুলেছিলাম। অমর্ত্য দার জন্য রাশি রাশি শ্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতা। আপনি সুস্থ থাকুন আর শতায়ু হোন।

হেলথ ইকুইটি প্রকল্পের সুবাদে আমার অনেক দেশে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। এমন একটি সফরের কথা এখানে উল্লেখ না করে পারছি না। সম্ভবত এমন সফর আর দ্বিতীয়টি হবে না। ১৯৯৭ সাল। প্রকল্পের এক সভায় যোগদান করার জন্য আমন্ত্রণ এল। এবারের গন্তব্য চীন। আমরা তিনজন রওনা হলাম বেইজিংয়ের উদ্দেশে। আব্বাস ভূঁইয়া, ফারুক আহমেদ এবং আমি। তিন বন্ধু মিলে অনেক জল্পনা-কল্পনা করলাম। আব্বাস ভূঁইয়ার এটি দ্বিতীয় চীন সফর কিন্তু বাকি দুজনের প্রথম। তাই এক্সাইটমেন্ট তুঙ্গে। আমাদের জানানো হলো, এবারকার কর্মসভাটি একটি জাহাজে তিনদিন ধরে হবে। ঢাকা থেকে ব্যাংকক হয়ে বেইজিং। সেখানে দুদিন থেকে যেতে হবে চংচিং। সেখানেই চড়তে হবে জাহাজে। চংচিং পৌঁছে হোটেলে অন্যদের সঙ্গে দেখা হলো। প্রায় ৩০ জন। নৈশভোজের আয়োজন করলেন স্থানীয় চীনা গভর্নর। পরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। নাচ-গানে ভরপুর চৈনিক অনুষ্ঠান আমরা দারুণ উপভোগ করলাম।

পরদিন ভোরে নৌবন্দরে গিয়ে উপস্থিত হলাম। সফরের আয়োজনকারী ইয়ানলি লিউ। তিনি হার্ভার্ডের একজন শিক্ষক এবং এই ইকুইটি প্রকল্পের চীন সম্পর্কিত অধ্যায়ের প্রধান ব্যক্তি। সঙ্গে তার বোনকেও দেখলাম। সে- আমাদের গাইড। মহানন্দে জাহাজে চড়ে বসলাম। প্রত্যেকের জন্য আলাদা কেবিন। কেবিন থেকেই বাইরের দৃশ্য দেখা যায়। জাহাজ ছাড়ল। বুঝতে পারলাম, এটি প্যাসেঞ্জার জাহাজ। অনেক যাত্রীই ছিল জাহাজে। বেশির ভাগই স্থানীয়। জাহাজ ভেসে চলল ইয়াংসি নদী ধরে। তিনদিন থাকতে হবে জাহাজে। গন্তব্যস্থল উহান। ভীষণ রোমাঞ্চিত মনে হচ্ছিল। এই সেই ইয়াংসি নদী, পৃথিবীর দীর্ঘতম নদীগুলোর একটি। চীনের ইতিহাস পড়লে ইয়াংসি নদী আসবেই। চীনের সুখ-দুঃখের সঙ্গে এর রয়েছে প্রাণের যোগ। ঢাকা ছাড়ার আগেই আমাদের সফরের বিষয়ে নানা তথ্য দেয়া হয়েছিল। ছিল National Geographic নামের সাময়িকীর একটি কপি। সাময়িকীর বিশেষ সংখ্যাটি ছিল ইয়াংসি নদীর ওপর নির্মিতব্য থ্রি গর্জেস ড্যাম নিয়ে। শুনেছিলাম যে আমরাই হব ইয়াংসি নদীর ওপর দিয়ে বিঘ্নহীনভাবে ভেসে যাওয়া মনুষ্যকুলের শেষ কয়েকজন। গর্জ মানে হলো গিরি। ইয়াংসি নদী তার দীর্ঘ পথ চলায় অনেক জনপদ পাহাড়-পর্বতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। যে অবস্থানে নদীটি বিশাল তিনটি গিরিপথ অতিক্রম করে, সেখানেই চীন সরকার একটি বাঁধ নির্মাণ করছিল। উদ্দেশ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন। বাঁধের নাম দেয়া হয়েছে থ্রি গর্জেস ড্যাম

জাহাজ ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে, আর আমরা তিন বন্ধু দুই পাড়ের বিচিত্র সব মনোরম দৃশ্য দেখে অভিভূত হচ্ছিলাম। লাঞ্চের পরে প্রথম সেশন শুরু হলো। কর্মশালার জন্য জাহাজ কর্তৃপক্ষ বিচ্ছিন্ন একটি জায়গার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। যদিও কোনো কোনো যাত্রীর কৌতূহলী দৃষ্টি এবং জাহাজের শব্দে মাঝে মাঝে ব্যাঘাত ঘটছিল। তবে পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং ইয়াংসির ওপর কর্মশালার কথা চিন্তা করে আমরা ভীষণ আন্দোলিত উত্ফুল্ল ছিলাম। রাতে ছিল ডিনার এবং তারপর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

দ্বিতীয় দিন। ইয়ানলি লিউয়ের বোন মাঝে মাঝে এসে জাহাজের অবস্থান বিষয়ে বর্ণনা দিচ্ছিল। থ্রি গর্জেস ড্যাম এলাকা পার হচ্ছি আর দুই পাড়ের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হচ্ছি। দুই দিকেই পর্বতসম পাথরের পাহাড়, মাঝে মাঝে সবুজ রাশি আর কিছু লোকালয়। অপূর্ব! বাঁধ নির্মাণের ফলে স্থানীয় লাখ লাখ লোক গৃহহীন হয়ে পড়বে। তাদের বসতবাড়ি, জমিজমা সব ৫০ থেকে ১০০ ফুট পানির নিচে তলিয়ে যাবে। ভাবছিলাম, আসলে কি এটার প্রয়োজন ছিল? চীনারা কি অন্য কোনো উপায়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারত না। আমাদের মতো অনেক পরিবেশবাদীও বাঁধের বিরোধিতা করছিলেন কিন্তু চীনারা নির্বিকার। এমন সময় গাইড বলল, জাহাজ কিছুক্ষণের জন্য নোঙর করবে। আমাদের নিয়ে যাবে একটি নতুন শহর দেখাতে। বাঁধ নির্মাণের ফলে যেসব লোক গৃহহীন হবে, তাদের জন্য এই নতুন শহর। এক বিশাল কর্মকাণ্ড। দেখলাম, কীভাবে এই গৃহহীনদের নতুন করে পুনর্বাসন করা হবে। তাদের জন্য সম্পূর্ণ আধুনিক সব ব্যবস্থা। বিদ্যুৎ, পানি, রাস্তাঘাট সবই আছে। প্রতিটি বাড়িতেই আছে ফ্রিজ, টেলিভিশনসহ আধুনিক সব আসবাব বিনোদনসামগ্রী। আছে বড় বড় শপিং সেন্টার, স্কুল-কলেজ, হাসপাতালসহ সব প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা। জানি না, চৌদ্দ পুরুষের ভিটা ত্যাগ করে কীভাবে এই নতুন জীবনধারায় নিজেদের খাপ খাওয়াবে বা মানিয়ে নেবে। তবে চীনারা যে তাদের নাগরিকদের জন্য এত কিছু আগে থেকেই চিন্তাভাবনা করে রেখেছে, তা দেখে সামান্য হলেও মনটা হালকা হলো। মনে পড়ল স্কুলজীবনের প্রথম দিকে পড়া গোলাম মোস্তফার লেখা একটি লাইন। পাঠের নাম ছিল পদ্মা বন্যার সময় পদ্মাপারের লোকজনের দুঃখের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে লেখক একটু আবেগতাড়িত হয়েছিলেন সত্য কিন্তু তার ভালোর দিকটাও মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন বাক্যটি দিয়েকীভাবে বন্যার সময় পদ্মা নদী দিয়ে পলি মাটি এসে জমিকে উর্বর করে এবং কৃষকের ঘরে আনন্দের বন্যা বইয়ে দিয়ে যায়। তিনি লিখেছিলেন, বৃহত্তর স্বার্থের জন্য ছোটখাটো ক্ষয়ক্ষতি মেনে নিতে হয়। কিন্তু কোনটা বৃহত্তর আর কোনটা ছোটখাটো, তা সংজ্ঞায়িত করবে কে?

তৃতীয় দিন দুপুরের দিকে পৌঁছে গেলাম উহান। নভেল করোনাভাইরাসের কারণে উহানের নাম আজ কে না জানে! তবে উহান তখনও একটি বড় পরিচিত নগরী ছিল। উহানেই ইয়াংশি নদীতে সাঁতার কাটতে মাও সে তুং বছরে একবার আসতেন। ষাটের দশকে পিকিং রিভিউ নামে একটা সাময়িকী আমাদের দেশে পাওয়া যেত। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র পত্রিকাটি ছিল দামে খুবই সস্তা। আমি এটার একজন নিয়মিত পাঠক ছিলাম। মনে পড়ে সেই পত্রিকায় কয়েকবার চেয়ারম্যান মাওয়ের ইয়াংশিতে স্নানের দৃশ্য দেখেছিলাম। যাহোক, উহানে আমাদের কর্মসভার শেষ অধিবেশন। বিশাল এক হোটেলে আমাদের থাকার জায়গা হলো। চীন মানেই সবকিছু বৃহদাকার। হোটেলের বিশাল ভবনের কুড়িতলা থেকে শহরটা দেখছিলাম। সামনে-পেছনে সব ভবনই সুউচ্চ। মনে হলো, এর অনেকগুলোই হয়তো হোটেল। বেশির ভাগ ভবনেরই ওপর থেকে নিচ অব্দি বড় বড় লাল ব্যানারে চীনা ভাষায় কী সব লেখা। কিছুই পড়তে পারলাম না। একেক অক্ষরের একেক ডিজাইন। মনে পড়ল ছোটবেলায় শোনা এক মজার গল্প। তখন আমরা পাকিস্তানের অংশ। পূর্ব পাকিস্তান থেকে এক সাংস্কৃতিক দল গেছে চীন সফরে। দলে অন্যদের সঙ্গে রয়েছেন নামকরা এক কণ্ঠশিল্পী। মূল অনুষ্ঠান সন্ধ্যায়। দিনের বেলা তেমন কিছু করার নেই। হোটেলের বাইরে এক ভবনে দেখলেন ঝুলে আছে লাল রঙের একখানা শাড়ি, যার মধ্যে সুন্দর মোটিফ করা ডিজাইন। মনে মনে ভাবলেন, এটা তো অপূর্ব এক মোটিফ। তার সোনালি শাড়িতে মানাবে ভালো। শুরু করে দিলেন সুই-সুতার কাজ। সন্ধ্যায় উপস্থিত হলেন অনুষ্ঠানস্থলে, পরনে সেই শাড়ি। নিজেকে খুব ধন্য ভাবলেন এমন একটা কাজ এত কম সময়ে সম্পন্ন করতে পেরে। দলের অন্যরা বাহবা দিচ্ছিলেন। তবে তার মনে একটু খটকা লাগতে শুরু করল। কারণ কোনো চৈনিকই তাকে বাহবা দিচ্ছিল না। বরং তারা একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন মুচকি মুচকি হাসছিল। এমন সময় পাকিস্তানি দূতাবাসের এক বাঙালি কর্মকর্তা তার দিকে দৌড়ে এসে যা বললেন, তা শুনে তো শিল্পীর হার্ট অ্যাটাক হওয়ার মতো অবস্থা। বললেন, আপনি আপনার শাড়িতে যা উঠিয়েছেন, তা চীনা ভাষার কয়েকটি অক্ষর। যার মানে হলো টু ল্যাট! পরের ঘটনা আর সেই গল্পের মধ্যে নেই। রকম আরেকটি গল্প। সেই পাকিস্তান সময়কার। তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান এক সফরে চীন গিয়েছিলেন। মাও সে তুংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ। মোনায়েম খান চেয়ারম্যান মাওয়ের সঙ্গে কী আর আলাপ করবেন? অনেক চিন্তাভাবনা করে শোধালেন: চেয়ারম্যান মাও, আপনি কোন গ্রুপেমেনন না মতিয়া? মাও সে তুং কি উত্তর দিয়ে ছিলেন, তা আর জানা যায়নি। (চলবে)

 

. আহমদ মোশতাক রাজা চৌধুরী: ব্র্যাকের সাবেক ভাইস চেয়ারপারসন, জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথের প্রতিষ্ঠাতা ডিন, বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের আহ্বায়ক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন