নৌ-নিরাপত্তা

নৌ-চলাচল অধ্যাদেশ-১৯৭৬ সংশোধনপূর্বক বাস্তবায়ন করা হোক

সহজে কম খরচে চলাচলের জন্য নৌপথ হতে পারত দেশের অন্যতম যোগাযোগ মাধ্যম। কিন্তু সঠিক নৌ-চলাচল আইন ব্যবস্থা না থাকায় ক্রমে অনিরাপদ হয়ে উঠেছে মাধ্যমটি। আধুনিক জলযানের অভাব যেমন আছে, তেমনি অব্যবস্থাপনার কারণে প্রায়ই ঘটছে নৌ-দুর্ঘটনা। গত রোববার শীতলক্ষ্যা নদীতে মালবাহী জাহাজের ধাক্কায় ছোট আকারের যাত্রীবাহী লঞ্চডুবিতে প্রাণ হারিয়েছে অনেকে। সময়ান্তর নৌ-দুর্ঘটনা যেন নিয়মিত ঘটনা হয়ে উঠেছে। এমন অবস্থায় মুজিব বর্ষের শপথ, নিরাপদ রবে নৌপথ’— প্রতিপাদ্য সামনে রেখে গতকাল থেকে শুরু হয়েছে নৌ-নিরাপত্তা সপ্তাহ। নৌপথের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কার্যকর নৌ-আইন বাস্তবায়নের পাশাপাশি দায়ীদের শাস্তি দেয়া জরুরি। 

জার্মানি, তাইওয়ান, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ উন্নত দেশে নৌ-দুর্ঘটনার হার অনেক কম। নৌরুট মনিটরিংয়ের পাশাপাশি তারা নিরাপদ টেকসই নৌ-ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দেয়। আধুনিক যানবাহন নিশ্চিতের পাশাপাশি দেশগুলোয় রয়েছে কার্যকর নৌ-আইন। অথচ আমাদের দেশে গত কয়েক বছরেও অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল অধ্যাদেশ-১৯৭৬ সংশোধন হয়ে অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল আইনে রূপ নেয়নি। ২০১৯ সালে নৌ-দুর্ঘটনার সাজা বাড়িয়ে ১০ বছরের বিধান রাখা হলেও চাপের মুখে তা আবার পাঁচ বছর করে খসড়া তৈরি করে নৌ-পরিবহন অধিদপ্তর। ওই খসড়া নিয়ে এখনো কাজ করছে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়। অভিযোগ রয়েছে, মালিক শ্রমিক সংগঠনগুলোর চাপের কারণে এমন হচ্ছে। জাহাজের আকার অনুযায়ী সর্বনিম্ন হাজার টাকা সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা জরিমানা এবং এক মাসের কারাদণ্ডের প্রস্তাব করেছে মালিকপক্ষের সংগঠনগুলো। তাছাড়া তারা নৌযানের বয়সসীমা ৪০ থেকে বাড়িয়ে ৫০ বছর করার প্রস্তাবনাও রেখেছে। অবস্থায় নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সক্রিয়তা জরুরি। কেননা বিদ্যমান আইনে লঞ্চ মালিক চালকদের শাস্তির যে বিধান আছে, তা কার্যকর করা যেমন দুরূহ, তেমনি আইনের ফাঁকফোকরও অনেক বেশি। ফলে আইনটির পরিবর্তন বা সংশোধন করা গুরুত্বপূর্ণ। আইনে বিভিন্ন অপরাধ বিধি লঙ্ঘনের জন্য বিদ্যমান সাজার মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে।

বর্তমানে প্রায় ছয় হাজার নৌপথ থাকলেও এর বেশির ভাগই অরক্ষিত। বৈধভাবে তিন হাজার ছোট-বড় লঞ্চ চলাচলের অনুমতি দেয়া হলেও অনুমোদনহীনভাবে চলছে কয়েক গুণ বেশি জলযান। সবচেয়ে ভয়াবহ দিকটি হচ্ছে, বেশির ভাগ নৌযানের ফিটনেস সনদ নেই। পুরনো   মেয়াদোত্তীর্ণ নৌযানকে নতুন করে জোড়াতালি দিয়ে কাজ চালিয়ে নেয়া হলেও তা তদারক করা হয় না। বলার অপেক্ষা রাখে না, ফিটনেসবিহীন লঞ্চ চলাচলের সুযোগ ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত যাত্রী বহন লঞ্চ দুর্ঘটনা বা ডুবির অন্যতম কারণ। নৌ-দুর্ঘটনা রোধে লঞ্চসহ বিভিন্ন নৌযানের ফিটনেস পরীক্ষা নিশ্চিত করা চাই।

অভিযোগ আছে, বেশির ভাগ নৌযান চালকই দক্ষতাসম্পন্ন নন। অনেকের লাইসেন্স নেই। নৌযান সংঘর্ষের ঘটনা প্রতিরোধ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞানের অভাবও রয়েছে তাদের। তাই নৌযানে কর্মরত মাস্টার, ড্রাইভার, সুকানি আনসারদের জন্য নদীবন্দরগুলোয় নিয়মিত নৌ-নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট কর্মশালার আয়োজনের মাধ্যমে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে। দেশের বিভিন্ন নৌপথে নিরাপদে চলাচলের স্বার্থে পর্যাপ্তসংখ্যক আধুনিক নৌ-সহায়ক যন্ত্রপাতি স্থাপন করা প্রয়োজন। পাশাপাশি ঈদসহ বিভিন্ন ছুটি উৎসবের সময় অতিরিক্ত যাত্রী বহন পরিহারের লক্ষ্যে স্পেশাল লঞ্চ সার্ভিসের ব্যবস্থা করতে হবে। কোথাও লঞ্চডুবির ঘটনা ঘটলে দ্রুত উদ্ধার অভিযানের লক্ষ্যে আধুনিক জাহাজ, স্পিডবোট হেলিকপ্টার প্রয়োজন হয়। পাশাপাশি সঠিক নকশা অনুযায়ী লঞ্চ নির্মাণ করা হচ্ছে কিনা, এসবও নিয়মিতভাবে স্বচ্ছতার সঙ্গে তদারক করা আবশ্যক।

নৌপথে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে নৌ-পুলিশ। তাদের লোকবল বৃদ্ধির পাশাপাশি আধুনিক জলযান সরবরাহ করতে হবে। কিছু সার্ভে জাহাজ স্পিডবোট দিয়ে স্বল্পসংখ্যক নৌ-পুলিশের পক্ষে নৌপথের সার্বিক শৃঙ্খলা রক্ষা করা অসম্ভব বৈকি। পাশাপাশি নৌ-দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য নৌ-ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা উন্নত করা প্রয়োজন। যাত্রীদের সচেতন করা জনসচেতনতামূলক প্রচারণা চালানোর বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি অতিরিক্ত যাত্রী বহন রোধ করা, লঞ্চে জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জামাদিসহ সার্ভে সনদ অনুযায়ী মাস্টার ড্রাইভার যথাযথভাবে আছে কিনা, এসব মনিটর করা জরুরি। কোনো লঞ্চ অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করলে এবং ওই লঞ্চে জীবনরক্ষাকারী পর্যাপ্তসংখ্যক সরঞ্জামাদি না থাকলে সেই লঞ্চের যাত্রা স্থগিত করাসহ সংশ্লিষ্ট নৌ-আদালতে মামলা করতে হবে।

পৃথিবীজুড়ে সবচেয়ে নিরাপদ হচ্ছে নৌ-যোগাযোগ খাত। অনেক দেশে কৃত্রিমভাবে নৌ-যোগাযোগ বাড়ানো হয়েছে। আমাদের নদীমাতৃক দেশ হওয়া সত্ত্বেও প্রতি বছর নৌরুট কমে আসছে। বন্ধ হচ্ছে নৌ-খাতের লাইন। তেমনি একের পর এক দুর্ঘটনার কারণে ঝুঁকিও বাড়ছে। সেই সঙ্গে নজরদারি যতটুকু বৃদ্ধির কথা ছিল, তা বাড়েনি। ফলে গোটা নৌ-খাত নজরদারির অভাবে ধুঁকছে, একথা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। নৌরুট বন্দরের দুর্বল ব্যবস্থাপনা কাটিয়ে ওঠার মাধ্যমে নৌপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা দেশের অর্থনীতির জন্যই লাভজনক। উন্নত প্রযুক্তি যান্ত্রিক উপকরণ ব্যবহার করে আমাদের নৌপথের দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য সহজ গতিশীল করা জরুরি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন