ভ্লাদিমির পুতিন

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পাকা খেলোয়াড়

সাইফ বাপ্পী

সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন স্রেফ অতীত। সে অতীতের স্মৃতিতে কাতর রুশবাসী। কাতরতাকে সঙ্গে করেই বিদায় নিয়েছে বিশ শতক। এমনই এক মুহূর্তে নতুন প্রেসিডেন্টের অধীনে নতুন শতক শুরু করে রাশিয়া। ২০০০ সালে দেশটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথমবারের মতো শপথ নেন সাবেক কেজিবি এজেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এরপর পেরিয়েছে দুই দশকেরও বেশি সময়। এখনো রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। মাঝে চার বছর বাদে পুরোটা সময় ধরেই ক্রেমলিনের সর্বোচ্চ পদে আসীন তিনি।

পুতিনের বয়স এখন প্রায় ৬৮। বয়সেও তিনি একজন দক্ষ ঘোড়সওয়ার। অ্যাথলিট হিসেবে তার শারীরিক সক্ষমতা এখনো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের চর্চার বিষয়। বলা হয়, কেজিবির গুপ্তচরদের অপরিহার্য গুণ হিসেবে সক্ষমতা অর্জন করেছিলেন পুতিন। তবে স্পোর্টসম্যানশিপের দক্ষতা রাজনীতিতেই বেশি দেখিয়েছেন তিনি। কোটি ৭১ লাখ বর্গকিলোমিটারেরও বেশি আয়তনের দেশ রাশিয়া শাসন করছেন দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে। তার চলমান মেয়াদ শেষ হচ্ছে ২০২৪ সালে। এরপর তার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল রাশিয়ার সংবিধান। তবে ভ্লাদিমির পুতিন পাকা অ্যাথলিটের মতো সে বাধাও অনায়াসেই টপকে গিয়েছেন। পথ সুগম করে নিয়েছেন আরো টানা এক যুগ ক্ষমতায় থাকার। এজন্য পরিবর্তন এনেছেন রাশিয়ার সংবিধানেও।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এক যুগ নয়; পুতিন চাইছেন আজীবনের জন্য প্রেসিডেন্ট হতে। এক কথায় ক্রেমলিনের ক্ষমতার আসনে রীতিমতো চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে নিতে চাইছেন তিনি। সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে তারই ভিত গড়ে নিলেন তিনি।

তার চলমান মেয়াদ শেষ হচ্ছে ২০২৪ সালে। নতুন সংশোধনীর কারণে ২০৩৬ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে পারবেন তিনি। সে সময় তার বয়স হবে ৮৩। পর্যবেক্ষকদের মতে, এর পরও ক্রেমলিনের লাগাম ধরে রাখার পথ ঠিকই বের করে নেবেন পুতিন।

এতদিন নিয়ম ছিল, কোনো ব্যক্তি রাশিয়ায় পরপর দুবার প্রেসিডেন্ট থাকার পর তৃতীয়বার আর সে পদে থাকতে পারবেন না। সাংবিধানিক ওই বাধার কারণে মাঝে ২০০৮ থেকে ২০১২ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রিত্ব নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে পুতিনকে। সে সময় প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন পুতিনঘনিষ্ঠ দিমিত্রি মেদভেদেভ। যদিও বলা হয়, সে সময়টাতেও মস্কোর সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ব্যক্তি পুতিনই ছিলেন। ক্রেমলিনের নিয়ন্ত্রণ পুরোটাই ছিল তার হাতে। বন্ধু মেদভেদেভ সে সময় পরবর্তী রুশ প্রেসিডেন্টদের মেয়াদ চার বছর থেকে বাড়িয়ে ছয় বছর করেছিলেন। এর সুবাদেই পরের দুই মেয়াদে টানা ১২ বছর প্রেসিডেন্ট পদে আসীন থাকার সুযোগ পেয়েছেন পুতিন।

টানা তিন মেয়াদ প্রেসিডেন্ট থাকতে না পারার নিয়মটিকে যে পুতিন বদলে দেবেন, সে বিষয়ে অনেকটাই নিঃসন্দেহ ছিলেন পর্যবেক্ষকরা। তবে তা কীভাবে বদলাবেন, তা নিয়ে ছিল নানা মুনির নানা মত। এমনটাও ধারণা করা হচ্ছিল, প্রয়োজনে রাশিয়ার মানচিত্র বদলে দিয়ে হলেও ক্ষমতায় থাকবেন পুতিন। সেক্ষেত্রে তিনি রাশিয়ার সঙ্গে বেলারুশকে একীভূত করার মাধ্যমে নতুন ইউনিয়ন গঠনের উদ্যোগ নিতে পারেন। তবে ধারণার মূল সমস্যা হলো বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কোও পুতিনের মতো দীর্ঘদিন ধরে শাসন করছেন। নতুন ইউনিয়নে কোনোভাবেই রাশিয়ার প্রাদেশিক শাসনকর্তা হয়ে থাকতে চাইবেন না তিনি। কারণে যুক্তির যথার্থতা নিয়েও সন্দিহান ছিলেন অধিকাংশ পর্যবেক্ষক।

এমন নানা সম্ভাবনা হিসাবনিকাশকে উল্টে দিয়ে সবচেয়ে সহজ পথটিই বেছে নিয়েছেন পুতিন। ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার জন্য সংবিধানকেই বদলে দিয়েছেন তিনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মধ্য দিয়ে ক্রেমলিনে নিজের কর্তৃত্বকে আরো শক্ত করেছেন পুতিন। কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার কাজে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকেও কাজে লাগাচ্ছেন তিনি। রুশ সমাজে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো প্রভাবশালী করে তুলতেও সংবিধানে পরিবর্তন আনার পরিকল্পনা রয়েছে পুতিনের।

প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম দিন থেকেই পুতিন বারবার বলেছেন, রাশিয়ার হারানো প্রতাপ ফিরিয়ে আনার বিষয়ে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। রাশিয়ার প্রতাপ কতটা ফিরেছে, সে বিষয়ে নানা আলোচনা থাকলেও একটি বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা একমতগত দুই দশকে ভ্লাদিমির পুতিনের প্রতাপ ক্রমেই বেড়েছে।

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে এতদিন আশঙ্কা করা হচ্ছিল, রুবলের অবমূল্যায়ন, অর্থনৈতিক স্থবিরতা রুশ জনগণের ক্রমহ্রাসমান আয় রুশ জনগণের মধ্যে পুতিনের শাসন নিয়ে অসন্তোষ তৈরি করতে পারে। তবে সে আশঙ্কা শেষ পর্যন্ত ভুল প্রমাণিত হয়েছে। উল্টো দেশটিতে পুতিনের প্রভাব ক্রমেই বেড়েছে।

পুতিনের সমালোচকরা বলছেন, তার ক্ষমতার অন্যতম প্রধান ভিত্তি হলো রুশ জনগণের রাজনীতিবিমুখতা। এর সপক্ষে লেভাদা সেন্টার নামে এক সংস্থার সাম্প্রতিক জরিপের তথ্য সামনে নিয়ে আসছেন তারা। সম্প্রতি রাশিয়ায় পুতিনের জনপ্রিয়তা যাচাই করতে জরিপ চালিয়েছিল সংস্থাটি। এতে দেখা যায়, রাশিয়ার জনগণের মধ্যে সমসাময়িক রাজনৈতিক ঘটনাবলি নিয়ে আগ্রহ রয়েছে মাত্র ১৩ শতাংশের। দেশটির জনগণের মধ্যে বর্তমানে ধারণা তৈরি হয়েছে, সরকারি বিভিন্ন সিদ্ধান্তে তাদের ভূমিকা রাখার সুযোগ কম। কারণে বিষয়টি নিয়ে তেমন আগ্রহ নেই তাদের।

রুশ প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধজনরা বলছেন, দেশটিতে বর্তমানে ক্ষমতাঘনিষ্ঠ অভিজাত একটি শ্রেণী তৈরি হয়েছে। নিয়ে প্রজেক্ট সিন্ডিকেটে সম্প্রতি প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়, অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে দুর্নীতিপরায়ণতার মাত্রা অনেক বেশি। এর পরও স্রেফ পুতিনের প্রতি আনুগত্যের জোরে তারা পার পেয়ে যাচ্ছেন। অন্যদিকে রুশ প্রেসিডেন্টকে তার ক্ষমতা আরো সুসংহত করার সুযোগ করে দিয়েছে চলমান কভিড-১৯ মহামারী। মহামারীর বিপর্যয়কর মুহূর্তকে কাজে লাগিয়ে রাশিয়ায় নিজেকে অপরিহার্য শাসক হিসেবে উপস্থাপনের সুযোগ পেয়েছেন তিনি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন