স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী

বাংলাদেশের চমকপ্রদ উন্নয়নে যেসব দিক বিবেচ্য

ড. মইনুল ইসলাম

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছে জাতি। একই সঙ্গে চলছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন। ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকার ১০ দিনের অনুষ্ঠানমালার মাধ্যমে সাড়ম্বরে দুটো ঐতিহাসিক উৎসবকে জাতির সামনে উপস্থাপন করেছে।

সারা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের বিরাট বিস্ময়। ১৯৭১ সালের জন্মলগ্নে যে দেশটি বিশ্বের জনগণের সহায়তা ছাড়া টিকে থাকতে পারবে না বলা হচ্ছিল, সে দেশটি এই ৫০ বছরে উন্নয়নের মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। করোনাভাইরাস মহামারী আঘাত হানার আগে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দশমিক শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। মহামারীর অভিঘাত সত্ত্বেও বিশ্বের যে কয়েকটি দেশ জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে ধনাত্মক রাখতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ তার অন্যতম। ২০১৯-২০ অর্থবছরেও আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল দশমিক ২৪ শতাংশ। আরো বিস্ময়কর হলো, মহামারী সত্ত্বেও ২০২০ সালে বৈধ চ্যানেলে প্রবাসী রেমিট্যান্স ২৩ শতাংশ বেড়ে ২১ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গেছে। ফলে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২১ সালের মার্চে ৪৪ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার কমে দশমিক ২৪ শতাংশে দাঁড়ালেও তা বিশ্বের উন্নয়ন চিন্তাবিদদের দৃষ্টিতে অত্যন্ত প্রশংসনীয়। কারণ ২০২০ সালে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই জিডিপি প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক হয়ে গেছে মহামারীর অভিঘাতে। ২০১৮ সালে উন্নয়নশীল দেশে উত্তীর্ণ হওয়ার শর্ত পূরণকারী বাংলাদেশ ২০২১ সালে ওই উত্তরণ নিশ্চিত করেছে। ১৯৮১-৮২ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণ অনুদান দেশের জিডিপির ১৩ দশমিক শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। তা ক্রমান্বয়ে কমে এখন জিডিপির শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। পাকিস্তানকে উন্নয়নের প্রায় সব সূচকে পেছনে ফেলে এসেছে বাংলাদেশ। ২০২১ সালের বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ারইমার্জিং টাইগারঅভিহিত করা হচ্ছে। ২০২০ সালে মাথাপিছু জিডিপির বিচারে বাংলাদেশ ভারতকেও টপকে যাবে বলে পূর্বাভাস দিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে আইএমএফ।

বাংলাদেশের উন্নয়নের যেসব মাত্রা বিশ্বের কাছে চমকপ্রদ বিবেচিত হচ্ছে সেগুলো হলো:

. ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যার ৮২ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছিল, যেখান থেকে ২০২০ সালের মার্চে করোনাভাইরাস মহামারীর তাণ্ডব শুরু হওয়ার পর্যায়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী জনসংখ্যার অনুপাত ২০ দশমিক শতাংশে নেমে গেছে (গত এক বছরে মহামারীর কারণে দারিদ্র্য শতাংশ বেড়েছে বলে অনুমান করা হচ্ছে)

. ১৯৭৬-৭৭ থেকে ১৯৮১-৮২ অর্থবছর পর্যন্ত বাংলাদেশের জিডিপির অনুপাত হিসেবে বৈদেশিক ঋণ-অনুদান ১০ শতাংশের বেশি ছিল। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জিডিপির শতাংশেরও নিচে নেমে গেছে। বাংলাদেশ এখন আর সহায়তানির্ভর দেশ নয়; একটি বাণিজ্যনির্ভর দেশ।

. এক দশক ধরে প্রায় প্রতি বছর বাংলাদেশ তার লেনদেন ভারসাম্যের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত অর্জন করে চলেছে। এর মানে বাণিজ্য ভারসাম্যের ঘাটতি এখন আর সংকটজনক নয়। প্রবাসী বাংলাদেশীদের বৈধ পথে প্রেরিত রেমিট্যান্সের চমকপ্রদ প্রবৃদ্ধির হার এবং বাংলাদেশের রফতানি আয়ের প্রশংসনীয় প্রবৃদ্ধি দেশের লেনদেন ভারসাম্যের স্বস্তিকর অবস্থা সৃষ্টি করেছে।

. জনসংখ্যার অত্যধিক ঘনত্ব, জমি-জন অনুপাতের অত্যল্পতা এবং চাষযোগ্য জমির ক্রমসংকোচন সত্ত্বেও বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করে এখন ধান উদ্বৃত্ত দেশে পরিণত হয়েছে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের ধান উৎপাদন ছিল মাত্র কোটি ১০ লাখ টন। ২০১৯ সালে তা সোয়া তিন গুণেরও বেশি বেড়ে কোটি ৬২ লাখ টন ছাড়িয়ে গেছে। ধান, গম ভুট্টা মিলে ২০১৯ সালে খাদ্যশস্য উৎপাদন ছিল কোটি ৫৩ লাখ টন। ৭০ লাখ টন আলুর অভ্যন্তরীণ চাহিদার বিপরীতে ২০১৯ সালে বাংলাদেশে কোটি লাখ টন আলু উৎপাদন হয়েছে (এখনো আমরা অবশ্য ৫০-৫৫ লাখ টন গম আমদানি করি) মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয় স্থান অর্জন করেছে। শাক-সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ। বলতে গেলে বাংলাদেশে একটি কৃষি বিপ্লব চলমান।

. করোনা মহামারীর আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অর্জিত হয়েছে দশমিক শতাংশ। মহামারী সত্ত্বেও ২০১৯-২০ অর্থবছরে মাথাপিছু জিএনআই প্রাক্কলিত হয়েছে হাজার ৬৪ ডলার, যা ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ছিল হাজার ৯০৯ ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে শিক্ষা খাতের অবদান জিডিপির ৩৫ শতাংশে পৌঁছে গেছে, বিনিয়োগ-জিডিপির অনুপাত ৩১ দশমিক ৫৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।

. ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের রফতানি আয় ছিল ৪২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। অথচ ১৯৮১-৮২ অর্থবছরে রফতানি আয় ছিল মাত্র ৭৫২ মিলিয়ন ডলার (করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে ২০১৯-২০ অর্থবছরে রফতানি আয় ৩৩ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলারে নেমে গেছে) রফতানি আয়ের প্রায় ৮৪ শতাংশই আসছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। চীনের পর বাংলাদেশ পোশাক রফতানিতে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের পাট পাটজাত পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে আবারো সঞ্জীবিত হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। চামড়াজাত পণ্য, ওষুধ, সিরামিক পণ্য, জাহাজ নির্মাণ কৃষিভিত্তিক খাদ্যপণ্য রফতানি বাজারে ভালোই সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।

. বাংলাদেশের কোটি ২০ লাখেরও বেশি মানুষ বিদেশে কাজ করছেন বসবাস করছেন। ২০২০ সালে প্রাতিষ্ঠানিক পথে রেমিট্যান্সপ্রবাহ ২১ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গেছে।

. ক্ষুদ্রঋণ আন্দোলনের সাফল্য গ্রামের ভূমিহীন নারীদের কাছে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ পৌঁছে দেয়ার একটা অত্যন্ত কার্যকর হাতিয়ার বাংলাদেশকে উপহার দিয়েছে। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর এক-চতুর্থাংশের বেশি ঋণগ্রহীতা তাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে সাফল্য অর্জন করেছেন। অবশ্য ক্ষুদ্রতর অনুপাতের ঋণগ্রহীতা সাফল্যের সঙ্গে দারিদ্র্য থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পেরেছেন। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, শুধু ক্ষুদ্রঋণকে দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা কর্তৃক লালিত দারিদ্র্য সৃষ্টি পুনঃসৃষ্টির প্রক্রিয়াগুলোকে কার্যকরভাবে মোকাবেলার যথার্থ প্রতিষেধক বিবেচনা করা সমীচীন নয়। কিন্তু দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ পৌঁছে দেয়ার সফল উদ্ভাবনটিকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি ইতিবাচক দিক উন্মোচনের কৃতিত্ব দিতেই হবে।

. বাংলাদেশের নারীদের প্রায় ৩৮ শতাংশ বাড়ির আঙিনার বাইরে অর্থনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে ক্রিয়াশীল। দেশের দ্রুত বিকাশমান পোশাক শিল্পে ৩৩ লাখের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। আর শ্রমিকদের ৬০ শতাংশেরও বেশি নারী। সমাজের দরিদ্র প্রান্তিক অবস্থানের এসব নারীর প্রাতিষ্ঠানিক শিল্প খাতে কাজের ব্যবস্থা করাটা তাদের বঞ্চনা চরম দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে একটি তাত্পর্যপূর্ণ নিরোধক হিসেবে ভূমিকা রাখছে। ক্ষুদ্রঋণের সহায়তায় নারীর স্বকর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও বাংলাদেশ বিশ্বে সফল দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে।

১০. বাংলাদেশে এখন ১৬ কোটি মোবাইল টেলিফোন রয়েছে, ১১ কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে।

বাংলাদেশের অর্থনীতিকে প্রশংসনীয়ভাবে গতিশীল করার প্রধান কৃতিত্ব বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে দিতেই হবে। এখন তার অগ্রাধিকার হওয়া উচিতবৈষম্য নিরসনকারী প্রবৃদ্ধিকৌশল অবলম্বন করে একটি সমতাকামী সমাজ প্রতিষ্ঠা। কৃষিতে গণমুখী নীতি প্রণয়ন, শিক্ষা ব্যবস্থার বৈষম্য হ্রাস, দরিদ্র জনগণকে সুলভে আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, সুলভে উৎপাদনশীল জনগণের কাছে ব্যাংকঋণ পৌঁছানো, অগ্রাধিকার সহকারে প্রয়োজনীয় ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ, কঠোরভাবে দুর্নীতি দমন এবং সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থাকে জোরদার করা কৌশলের মূল স্তম্ভ। সর্বোপরি আয়বৈষম্য নিরসনের লক্ষ্যে আয় পুনর্বণ্টনকে রাষ্ট্রের মূল মিশন হিসেবে গ্রহণ করতেই হবে।

 

. মইনুল ইসলাম: একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন