পোশাক খাতে পেশাদারি মানসিকতার কোনো ঘাটতি নেই

আগামী এপ্রিল অনুষ্ঠিত হবে পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ নির্বাচন।  এতে অংশ নিচ্ছে পোশাক শিল্প মালিকদের নির্বাচনী  জোট ফোরাম জোটটির প্যানেল লিডার হিসেবে লড়ছেন বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি হান্নান গ্রুপের চেয়ারম্যান এবিএম সামছুদ্দিন সম্প্রতি তিনি  বণিক বার্তার সঙ্গে একান্ত আলোচনায় অংশ নেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন

বদরুল আলম

আপনি দীর্ঘদিন পোশাক খাতকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। অভিজ্ঞতাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

পোশাক খাতে আমার পদচারণা প্রায় ২৯ বছরের। ১৯৯৩ সালে পথচলা শুরু করি। যেকোনো কাজের শুরুতে খুব বেগ পেতে হয়। ধীরে ধীরে পরিপক্বতা আসে। পোশাক খাতেও তাই দেখেছি। শুরুর দিকে আমাদের তেমন কোনো অবকাঠামো ছিল না। ধীরে ধীরে আমরা অবকাঠামো নির্মাণ করলাম। অনেক কিছুই অগোছালো ছিল, ধীরে ধীরে গুছিয়ে আনি। এর মধ্যে শিশুশ্রম আইন পাস হলো। বিজিএমইএ শিশুশ্রমকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নেয়। শিশুশ্রমিকদের জন্য বাধ্যতামূলক স্কুল প্রতিষ্ঠা করল। শিশুরা চাইলে পড়াশোনার ফাঁকে সুবিধাজনক সময়ে কাজ করতে পারবে, সুবিধা শিশুশ্রমিকদের মনে রঙিন স্বপ্নের দুয়ার খুলে দিল। নব্বইয়ের দশকেই মুক্তবাজার অর্থনীতির সুদিন ধরা দিল। সময়ের পর পোশাক খাতকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে অনেকেই বিনিয়োগে আগ্রহী হলেন।

বিনিয়োগে আগ্রহ বাস্তবায়নের সময়টা কেমন ছিল?

২০০০ সালের কথা বলছি। তখন পোশাক খাতে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। মূলত সময়টাতেই পোশাক খাত শক্ত অবস্থান নিয়ে এগিয়ে যেতে শুরু করে। ২০০০ থেকে ২০০৬-০৭ পর্যন্ত বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ঊর্ধ্বমুখী ছিল। রানা প্লাজা তাজরীন গার্মেন্টসের ভয়াবহ দুর্ঘটনা খাতকে তুমুলভাবে নাড়া দেয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এত বড় দুর্ঘটনা কমই দেখেছে মানুষ। এর পরও পোশাক খাতের শক্ত অবস্থানের খুব একটা ব্যত্যয় ঘটেনি। এসব দুর্যোগ মোকাবেলা করেই আমরা এগিয়ে যেতে থাকি। তবে কারখানার কর্মপরিবেশ মূল্যায়নে অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের মতো আন্তর্জাতিক জোটগুলোর সঙ্গে নেগোসিয়েশনের দুর্বলতা আমাদের অনেক ভুগিয়েছে। আমাদের দেশের প্রকৌশলীরা আমেরিকার টুইন টাওয়ারের স্থপতি। সে প্রকৌশলীরাই যখন গার্মেন্টের কারখানা ভবন বানাবে, বায়াররা তা অনুমোদন করে না। আমি মনে করি, অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের কর্মসূচির প্রভাবে আমাদের ভোগান্তি বিজিএমইএর নেতৃত্বের অদূরদর্শিতা অযোগ্যতা ছাড়া কিছুই নয়। উদাহরণস্বরূপ বলতে চাই, সাত বছরের মতো তারা বাধাহীনভাবে আমাদের এখানে ব্যবসা করেছে। মনে হয়েছে, বাংলার বুকে নতুন করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আগমন হয়েছে। বিজিএমইএর একজন নেতাও তাদের এসব স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে টুঁ শব্দও করেনি। বর্তমান সভাপতি রুবানা হক দায়িত্ব পাওয়ার পর জোটগুলোর অযাচিত বিষয়গুলো মোকাবেলা একটা অংশগ্রহণমূলক পর্যায়ে আনা সম্ভব হয়েছে।

বর্তমান বিশ্ব কভিড-১৯ মহামারীতে ভুগছে। এর প্রভাবে পরিবর্তিত চ্যালেঞ্জগুলো পোশাক খাত কীভাবে মোকাবেলা করবে?

বৈশ্বিক করোনা মহামারীর ঢেউ বাংলাদেশে একটু পরই আসে। আমি বলব, বাংলাদেশের কভিড-১৯ পরিস্থিতি তুলনামূলক ভালো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সামনে থেকে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবেলায় তত্পর থাকায় আমরা অনেকটাই ভালো আছি। বিজিএমইএর প্রতি প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ নজর সবসময়ই ছিল। এর কারণ হলো, পোশাক খাতে সবচেয়ে বেশি নারী শ্রমিক কাজ করেন এটি প্রধানমন্ত্রীর ভাবনায় থাকে। প্রধানমন্ত্রী বিশেষ প্যাকেজের মাধ্যমে শ্রমিকদের চার মাসের বেতনের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, যা পোশাক খাতের জন্য সত্যিই বড় ব্যাপার। কভিড-১৯ দুর্যোগে পোশাক খাত টিকে থাকার পেছনে প্রধানমন্ত্রীর অবদান এশিয়ার আর কোনো দেশের সরকারপ্রধান করেছেন বলে আমার জানা নেই। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, প্রণোদনার টাকা গত জানুয়ারি থেকে কিস্তিতে পরিশোধ করার কথা ছিল। পরবর্তী সময়ে সে মেয়াদ আরো বাড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী পোশাক শিল্প মালিকদের বোঝা হালকা করেছেন।

করোনাভাইরাসজনিত পরিবর্তিত বিশ্বে পোশাক খাত কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবে বলে মনে করেন?

এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কভিডজনিত পরিবর্তিত বিশ্বে পোশাক শিল্পের ভবিষ্যৎ কেমন হবে, ভালো-মন্দ কিছু অনুমান করা গেলেও সবকিছু ঠিক কী হবে তা আগেভাগে বলা যাবে না। এমন অনেক পরিস্থিতি আসবে, যখন তাত্ক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আর এজন্য বিজিএমইএর দরকার দক্ষ নেতৃত্ব গবেষক প্যানেল। যাদের কাছে বিশ্বের খবরাখবর সবসময় আসবে এবং সে পরিস্থিতির আলোকে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা তাদের থাকবে।

পোশাক খাতে সার্বিক পেশাদারিত্ব সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই

আমি মনে করি, পোশাক খাতে পেশাদারি মানসিকতার কোনো ঘাটতি নেই। তবে যারা খাতের নেতৃত্বে ছিলেন, তাদের মধ্যে পেশাদারিত্বের প্রতিফলনটা ধারাবাহিক ছিল না। কেউ কেউ কারখানার স্বার্থের চেয়ে নিজের স্বার্থটাকে বড় করে দেখেছেন। ফলে যোগ্যতার ঘাটতি না থাকা সত্ত্বেও তাদের পেশাদারিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

ব্যবসায়ীরা কি পুরোপুরি পেশাদার হতে পেরেছে বলে মনে করেন?

এক্ষেত্রে আমি মিডিয়ার নেতিবাচক মনোভাবের কথা বলতে চাই। দেখুন, যখন রানা প্লাজার ঘটনা ঘটল, তখন দেশের সবকটা মিডিয়া দুর্ঘটনাকে বিশ্বের দুয়ারে লাইভ সম্প্রচারের মাধ্যমে তুলে ধরল। নিজের দেশের বদনাম এভাবে বিশ্বের দুয়ারে তুলে ধরা কি ঠিক হয়েছে? ব্যবসায়ীরা পেশাদার না হলে বাংলাদেশের পোশাক খাত এতদূর পর্যন্ত পৌঁছাল কীভাবে? তার পরও প্রশ্নের উত্তরে বলব, এটা যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার।

বিজিএমইএর নেতৃত্ব নির্ধারণের নির্বাচন আসন্ন। নেতৃত্বে যারাই আসুক তাদের করণীয়গুলোর অগ্রাধিকারে কী থাকবে?

পোশাক শ্রমিকরা যে চার মাসের বেতন পেলেন, এজন্য কিন্তু . রুবানা হকের ভূমিকা আছে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিষয়টা যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছেন বলেই খুব অল্প সময়ে বাংলাদেশের সব গার্মেন্ট শ্রমিক মাত্র শতাংশ সুদে চার মাসের বেতন পেয়েছেন, যা শ্রমিকের হাতে পৌঁছে গেছে সরাসরি। এটা সম্ভব হয়েছে যোগ্য নেতৃত্বের কারণে। যারাই পরবর্তী নেতৃত্বে আসবেন, তাদের এসব বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। আমিও যদি নেতৃত্বে আসি, আমিও সে ধারাবাহিকতা বজায় রাখব।

শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন সম্পর্কে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

গত দুই বছরে ইউরোপসহ অনেক দেশই বাংলাদেশের শ্রমিকদের জীবনমানের উন্নতির বিষয়টি বেশ প্রশংসা করেছে। শ্রমিকদের যারা নেতৃত্ব দেন, তাদের অনেকেই গার্মেন্টস সম্পর্কে ধারণা রাখেন না। একজন উকিল, শিক্ষক পোশাক শ্রমিক নেতা বনে বসে আছেন। তিনি কীভাবে পোশাক শ্রমিকদের সুখ-দুঃখ বুঝবেন? এসব বিষয় মিডিয়ায় আরো বেশি আলোচনা হওয়া উচিত বলে মনে করি। শ্রমিকবান্ধব নেতা এলেই শ্রমিকদের জীবনমানের উন্নতি হবে বলে বিশ্বাস করি।

পোশাক খাতের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে আরো এগিয়ে নিতে কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত?

বর্তমান প্রেক্ষাপটে পোশাক খাতের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে দেশের সব খাতকে ভূমিকা রাখতে হবে। সবার সমন্বিত প্রচেষ্টা থাকলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সুসংহত করা কেউ আটকে রাখতে পারবে না। তবে পদক্ষেপগুলো হতে হবে বাস্তবসম্মত। আর যে পদক্ষেপই গ্রহণ করা হোক, তা যথাযথভাবে বাস্তবায়নও করতে হবে, যা বলা হবে তার সঙ্গে কর্মের কোনো মিল না থাকলে হবে না। ইংরেজিতে একটা কথা আছে, যার বাংলা হলো একজন মিথ্যাবাদী নিজেকে ঠকায়। যখন মানুষ নিজেকে নিজে ঠকাতে শুরু করে, তখন অন্য কেউ তাকে কীভাবে ঠকাবেন?

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন