সারা বছরের নিজস্ব ব্যবসায়িক ও আর্থিক হিসাবের বিভিন্ন তথ্যের সমন্বয়ে আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করে কোম্পানি। আর সে প্রতিবেদন নিরীক্ষণের কাজটি করে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস প্রতিষ্ঠান। এক্ষেত্রে যাচাই করে দেখতে হয়, প্রতিবেদনটি তৈরিতে বিদ্যমান আইন, বিধিবিধান ও নিরীক্ষামান অনুসরণ করা হয়েছে কিনা। একই সঙ্গে যাচাই-বাছাই করে দেখা হয় বিভিন্ন তথ্য। নিরীক্ষার গুণগত মান ধরে রাখতে গিয়ে নিরীক্ষকদের বেশ সময়ও ব্যয় করতে হয়। বিশেষ করে ব্যাংক ও শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে নিরীক্ষা কার্যক্রমে মাসাধিককালও লেগে যায়। এর পরও পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২০২০ সালে পাঁচটি নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান মোট ৪ হাজার ৮৮৯টি কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন নিরীক্ষা করেছে। এর মধ্যে এ মতিন অ্যান্ড কোম্পানি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস একাই নিরীক্ষা করেছে ২০০২টি কোম্পানির।
পেশাদার হিসাববিদদের সংগঠন ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশের (আইসিএবি) তথ্য বলছে, সংগঠনটির সনদপ্রাপ্ত নিরীক্ষকরা গত বছর প্রায় ১৬ হাজার আর্থিক প্রতিবেদন নিরীক্ষা করেছেন। এর মধ্যে ৩০ শতাংশই করেছে পাঁচটি নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান। সংখ্যার দিক থেকে এ মতিন অ্যান্ড কোম্পানিই শীর্ষে।
আইসিএবির তথ্য বলছে, এ মতিন অ্যান্ড কোম্পানি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসের অংশীদার হিসেবে রয়েছেন দুজন পেশাদার নিরীক্ষক—এ কে আব্দুল মতিন ও নিতাই চাঁদ তালুকদার। এর আগে ২০১৬ সালে আইসিএবিতে জমা দেয়া তথ্যে প্রতিষ্ঠানটি ৮২টি কোম্পানির নিরীক্ষা করার তথ্য জানিয়েছিল। যদিও একই সময়ে রেজিস্ট্রারার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মসের (আরজেএসসি) কাছে জমা দেয়া তথ্যে ৩২৬টি কোম্পানির নিরীক্ষা করার কথা জানিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। আইসিএবির পক্ষ থেকে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানটির কাছে ২০১৬ সালের ২৪৪টি নিরীক্ষা নথি তলব করা হলেও তারা সেটি জমা দিতে পারেনি।
অল্প সময়ে এত বেশি কোম্পানির নিরীক্ষা কার্যক্রম চালানো কীভাবে সম্ভব হয়েছে, সে বিষয়ে জানতে চাইলে এ মতিন অ্যান্ড কোম্পানি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসের ব্যবস্থাপনা অংশীদার এ কে আব্দুল মতিন বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা ব্যাংক কিংবা তালিকাভুক্ত কোম্পানির নিরীক্ষা করি না। এ ধরনের কোম্পানির নিরীক্ষার জন্য সময় বেশি লাগে। তাছাড়া আমাদের প্রতিষ্ঠানে দুজন পার্টনার ছাড়া ১৫ জন স্টাফ ও ৪০ জনের মতো ছাত্র রয়েছে। সবাই মিলেই নিরীক্ষার কাজ করা হয়। তাছাড়া আইসিএবিতে আমরা নিরীক্ষার যে তথ্য দিয়েছি, সেখানে ২০২০ সালসহ এর আগের বছরের তথ্যও দেয়া হয়েছে। এ কারণে নিরীক্ষার সংখ্যা বেশি দেখাচ্ছে। এ বিষয়ে আমরা আইসিএবির কাছেও ব্যাখ্যা করেছি।
ওই সময় আইসিএবি ও আরজেএসসি দুই ধরনের নিরীক্ষার তথ্য দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এজন্য আইসিএবি থেকে আমাদের ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে এবং আমরা জরিমানার অর্থ পরিশোধ করে দিয়েছি।
আইসিএবির তথ্য বলছে, বর্তমানে ৩৮৭ জন পেশাদার নিরীক্ষক (চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট) কাজ করছেন। অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কম-বেশি ১৬২টি নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন তারা। এসব প্রতিষ্ঠান প্রতি বছর কতগুলো নিরীক্ষা কার্যক্রম চালিয়েছে, সে তথ্য আইসিএবির কাছে জমা দিতে হয়। এ তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, অল্প সময়ে এত বেশিসংখ্যক নিরীক্ষা কার্যক্রম চালানো প্রতিষ্ঠানগুলোয় অংশীদারের সংখ্যা এক থেকে তিনজনের মধ্যে। এ সীমিত জনবল ও সক্ষমতা নিয়েই প্রতিষ্ঠানগুলো এত বেশি কোম্পানির নিরীক্ষা করেছে, যা অনেক বড় ও শীর্ষস্থানীয় নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষেও করা সম্ভব হয় না।
ব্যাংক কোম্পানি আইনানুসারে, ব্যাংকের নিরীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি ও নিরীক্ষার জন্য দুই মাস সময় থাকে। তবে প্রয়োজন হলে এটি আরো দুই মাস বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। অন্যদিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) বিধান অনুসারে চার মাসের মধ্যে নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন জমা দিতে হয়।
দেশের শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নিরীক্ষা কার্যক্রমে সময় কেমন লাগবে, তা নির্ভর করে কোম্পানির ব্যবসার আকার, আর্থিক লেনদেনের পরিমাণসহ আনুষঙ্গিক আরো বেশকিছু বিষয়ের ওপর। তবে এক্ষেত্রে ন্যূনতম এক সপ্তাহ থেকে সর্বোচ্চ তিন মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। এমনকি যদি কোনো কোম্পানির ব্যবসায়িক কার্যক্রম না-ও থাকে, সেক্ষেত্রে শুধু শেয়ার মূলধন ও ব্যাংকের সঙ্গে কিছু লেনদেনের তথ্য ও রাজস্বসংক্রান্ত তথ্য নিরীক্ষায়ও অন্তত দুদিন সময় লাগবে।
গত বছর নিরীক্ষা সংখ্যার দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে রহমান মোস্তাফিজ হক অ্যান্ড কোম্পানি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস। ২০২০ সালে ৯৪২টি কোম্পানির নিরীক্ষা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে এটিএম মোস্তাফিজুর রহমান, ইকরামুল হক ও কাজী গিয়াসউদ্দিন নামে তিনজন অংশীদার রয়েছেন। সম্প্রতি এটিএম মোস্তাফিজুর রহমান মারা গিয়েছেন।
আরজেএসসিতে ২০১৬ সালে ১ হাজার ৭৪৬টি কোম্পানির নিরীক্ষার তথ্য দিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। অন্যদিকে আইসিএবির কাছে জমা দেয়া তথ্যে এর পরিমাণ বলা হয়েছিল ৭৮টি। বিষয়টি নিয়ে আইসিএবির পক্ষ থেকে যাচাই করা হলে প্রতিষ্ঠানটি ১ হাজার ৭৪৬টি নিরীক্ষা নথির তথ্য দিতে পারেনি।
কম সময়ে গুণগতমান বজায় রেখে এত বেশিসংখ্যক নিরীক্ষা করা কীভাবে সম্ভব হয়েছে জানতে চাইলে রহমান মোস্তাফিজ হক অ্যান্ড কোম্পানি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসের অংশীদার ইকরামুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা যেসব কোম্পানির নিরীক্ষা করেছি, সেগুলো অধিকাংশই নামসর্বস্ব কোম্পানি। নিবন্ধনের শর্তানুসারে আরজেএসসির কাছে আর্থিক প্রতিবেদন জমা দেয়ার বাধ্যবাধকতা থাকায় তারা আমাদের কাছ থেকে নিরীক্ষা করিয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। আর এসব কোম্পানির ব্যবসায়িক কার্যক্রম না থাকায় তাদের নিরীক্ষার জন্য খুব বেশি সময় প্রয়োজন হয় না। তাছাড়া আমাদের স্বাক্ষর ও প্রতিষ্ঠানের নাম জাল করেও কিছু নিরীক্ষা প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে।
চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট প্রতিষ্ঠান মোহাম্মদ আতা করিম অ্যান্ড কোম্পানিতে অংশীদার দুজন। তারা হলেন এএসএম আতাউল করিম ও ইমরুল কায়েস। ২০২০ সালে ৬৯০টি কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন নিরীক্ষার তথ্য দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এর আগে ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠানটি আইসিএবির কাছে ৬১টি ও আরজেএসসির কাছে ৮৫১টি নিরীক্ষার তথ্য জমা দিয়েছিল। আইসিএবির পক্ষ থেকে পর্যালোচনা করা হলে প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে ৭৯০টি নিরীক্ষা নথির তথ্য পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মোহাম্মদ আতা করিম অ্যান্ড কোম্পানি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসের অন্যতম অংশীদার এএসএম আতাউল করিম বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা যেসব কোম্পানির নিরীক্ষা করি তার ৭০ শতাংশেরই কার্যক্রম বন্ধ। মাত্র ৩০ শতাংশের ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালু আছে। এজন্য কম সময়ে বেশি নিরীক্ষা করা সম্ভব হয়েছে।
ইরশাদউল্লাহ পাটোয়ারি অ্যান্ড কোম্পানি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস ২০২০ সালে ৬৫৩টি কোম্পানির নিরীক্ষা করেছে। প্রতিষ্ঠানটির একমাত্র অংশীদার মো. ইরশাদউল্লাহ পাটোয়ারি। ২০১৬ সালে জমা দেয়া তথ্যে আইসিএবিতে ১২৩টি ও আরজেএসসিতে ৫০৫টি নিরীক্ষা করার কথা জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। আইসিএবির পক্ষ থেকে এ ৫০৫টি নিরীক্ষার নথি পর্যালোচনার জন্য চাওয়া হয়েছিল। যদিও তা পায়নি সংগঠনটি।
এনকে রায় অ্যান্ড কোম্পানি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসে একমাত্র অংশীদার হিসেবে রয়েছেন নিখিল কান্তি রায়। ২০২০ সালে প্রতিষ্ঠানটি ৬০২টি কোম্পানির নিরীক্ষা করেছে। এর আগে ২০১৬ সালে আইসিএবির কাছে ১১টি ও আরজেএসসির কাছে ৩৩০টি কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন নিরীক্ষণের তথ্য জমা দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। অবশ্য ৩৩০টি নিরীক্ষার নথি পর্যালোচনার জন্য চাইলে প্রতিষ্ঠানটি সেটি আইসিএবিকে দিতে পারেনি।
পেশাদার হিসাববিদদের সনদ ও নিরীক্ষাচর্চার জন্য লাইসেন্স প্রদানের পাশাপাশি এ খাতের প্রাথমিক নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবেও কাজ করে আইসিএবি। নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বার্ষিক ভিত্তিতে জমা দেয়া তথ্য পর্যালোচনা করে সেগুলোর ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপও নিয়ে থাকে সংস্থাটি। নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন অনিয়ম ও ব্যত্যয়ের বিষয়গুলো তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয় আইসিএবির ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড ডিসিপ্লিনারি কমিটি। বিভিন্ন সময়েই নানা অনিয়মের অভিযোগে নিরীক্ষকদের জরিমানাও করেছে আইসিএবি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইসিএবির প্রেসিডেন্ট মাহমুদউল হাসান খসরু বণিক বার্তাকে বলেন, নিরীক্ষাচর্চার মানোন্নয়নের জন্য আমরা ব্যাপকভাবে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছি। বিভিন্ন সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে নিরীক্ষা কার্যক্রম পুরোপুরি অটোমেশনের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। এতে অনিয়ম ও ব্যত্যয়ের সুযোগ অনেকাংশেই কমে যাবে। আর অনিয়ম ও ব্যত্যয়ের ক্ষেত্রে আইসিএবি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে।
আইসিএবির পাশাপাশি ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলও (এফআরসি) হিসাব ও নিরীক্ষাচর্চার মানোন্নয়নে কাজ করছে। এরই মধ্যে কাউন্সিল বেশকিছু নিরীক্ষকের অনিয়ম চিহ্নিত করেছে। তবে প্রয়োজনীয় বিধিবিধান প্রণীত না হওয়ার কারণে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারেনি এফআরসি। তবে কাউন্সিল সূত্রে জানা গিয়েছে, এ-সংক্রান্ত বিধিবিধান প্রণয়নের কাজ চলছে। কাউন্সিলের পক্ষ থেকে শিগগিরই নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিদর্শনের উদ্যোগ নেয়া হবে। এক্ষেত্রে যেসব প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক মান অনুসারে নিরীক্ষা করবে না বা যারা নামসর্বস্ব নিরীক্ষা করবে, তাদের এফআরসির জনস্বার্থ সংস্থার নিরীক্ষার জন্য যোগ্য নিরীক্ষক প্যানেলে অন্তর্ভুক্ত করা হবে না। আর জনস্বার্থ সংস্থার পরিধি ব্যাপক হওয়ায় প্রকৃতপক্ষে এসব প্রতিষ্ঠানের আর নিরীক্ষাচর্চা করার সুযোগ থাকবে না বললেই চলে। তাছাড়া ব্যত্যয়ের জন্য আইনানুসারে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেয়া হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এফআরসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. হামিদ উল্লাহ ভূঁঞা বণিক বার্তাকে বলেন, এক বছরে এত বেশি পরিমাণ নিরীক্ষা করার বিষয়টি অস্বাভাবিক। এ ধরনের বেশকিছু ঘটনা আমাদের নজরেও এসেছে। আমরা নিরীক্ষকদের তালিকাভুক্তির উদ্যোগ নিয়েছি। এজন্য বেশকিছু মানদণ্ড নির্ধারণ করা থাকবে। যারা এসব মানদণ্ডের মধ্যে পড়বে, তাদেরই এফআরসির নিরীক্ষক প্যানেলে তালিকাভুক্ত করা হবে। এর বাইরে যারা থাকবে তারা কোনো কোম্পানির নিরীক্ষা করতে পারবে না। আর যারা আমাদের প্যানেলে তালিকাভুক্ত থাকবেন, তাদের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের ব্যত্যয় দেখা গেলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।