নীতি-নির্দেশনা

ব্যাংকিং খাতের অমানিশা কাটবে কী করে?

মামুন রশীদ

পৃথিবীর তাবৎ সেরা এবং সফল বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের বৈশিষ্ট্য হলো, এগুলো পরিচালনা পর্ষদের সহযোগিতা, তদারকি এবং নিরীক্ষণের মধ্যে থেকেও স্বাধীনভাবে কাজ করে। নির্দিষ্ট নিয়মানুসারে চলা এসব তদারকির মধ্যে কোনো অবাঞ্ছিত কিংবা অযৌক্তিক হস্তক্ষেপ হয় না।

লব্ধপ্রতিষ্ঠ এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কৌশলগত এবং কার্যপ্রণালির প্রধান সিদ্ধান্তগুলো পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক উপযুক্ত নিরীক্ষা, পর্যালোচনা অধ্যবসায়ের পর চূড়ান্ত প্রয়োগ করা হয়। নিবিড় পর্যবেক্ষণের পর দেখা গেছে অনেক সফল এসব ব্যাংকের সফলতার পেছনে অনেক স্বাধীন পরিচালক ব্যক্তিগত স্বার্থের বাইরে থেকে ব্যাংকের উন্নতি এবং অর্জনের কথা চিন্তা করে কাজ করেছেন।

বাংলাদেশের বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের বর্তমান অবস্থায় উদ্বেগের বিষয় হলো, বাংলাদেশের বেশির ভাগ বাণিজ্যিক ব্যাংক স্বাধীন কিংবা স্বায়ত্তশাসিত নয়। চল্লিশের অধিক বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে শুধু কিছুসংখ্যক ব্যাংক, এদের পরিচালনা পর্ষদ দ্বারা সঠিক দিকনির্দেশনা এবং সহযোগিতায় আংশিকভাবে স্বায়ত্তশাসিত। বলা বাহুল্য, এই মুষ্টিমেয় ব্যাংকগুলোই দেশে সবচেয়ে সফল, দৃঢ় এবং প্রশংসিত।

বাস্তব অবস্থা হলো, বাংলাদেশের পরিচালনা পর্ষদ নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকগুলো দৈনিক ভিত্তিতে তাদের দ্বারা চালিত। কিন্তু নীতি কার্যকর করার ক্ষেত্রে এখানে পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে ব্যবস্থাপনা পর্ষদের ভারসাম্য এবং সমঝোতার অভাব রয়েছে। এই সমঝোতা এবং ভারসাম্যের অভাবের কারণ বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ অধিক কর্তৃত্বপরায়ণ।

পরিচালনা পর্ষদের বেশির ভাগ কিংবা কিছু পরিমাণ সদস্যও যদি বাস্তবিক রূপে স্বাধীন হতেন, তাহলেও অন্তত অবস্থা মেনে নেয়া যেত। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা হয়নি।

বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে সরাসরি এর মালিকানার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি, রাজনৈতিক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি, এমনকি মালিকদের নিকটাত্মীয়রাও প্রভাবশালী হিসেবে পরিগণিত হন।

রকম অবস্থার কারণে দেখা যায় ব্যক্তিগত লাভের আশায় ব্যাংকের কার্যক্রম নীতি তৈরির ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলা হয়। বলা যায়, অনেক সময় পুরো কার্যপ্রণালিই দূষিত হয়ে ভুল পথে ব্যাংকগুলো চালিত হয়।

যেখানে ব্যাংকের পরিচালকরা নিজেরা স্বাধীন নন, উপরন্তু তাদের দ্বারাই নানা অনৈতিক হস্তক্ষেপ আসে, সেখানে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রাথমিক পরিকাঠামোই ভুলভ্রান্তি ভরা হয়ে থাকে এবং নীতিতেও নানা জটিলতা তৈরি হয়। যেহেতু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পরিচালনা পর্ষদের এই প্রভাব থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকের অদূরভবিষ্যতেও মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা নেই, অবস্থায় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদকে কেমন করে উন্নত এবং দৃঢ় করার মাধ্যমে ব্যাংক পরিচালনার সার্বিক উন্নতি করা যায়, সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে।

স্বাধীন পরিচালক থাকার গুরুত্ব সুবিধা

বাণিজ্যিক ব্যাংক পরিচালনার ইতিহাসের ক্ষেত্রে মালিকানা কিংবা দলের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের চেয়ে নির্বাহী দায়িত্ব নিয়ে কাজ করা পরিচালকদের কাজ বেশি ফলপ্রসূ হয়েছে। ব্যাংকের সঙ্গে এসব পরিচালকের সরাসরি কোনো বিশেষ সম্পর্ক থাকে না এবং কারণে তাদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য থাকে কাজের মাধ্যমে ব্যাংকের উন্নতি।

পদ্ধতিতে পরিচালকদের ব্যাবসাসংক্রান্ত চিন্তা থেকে বের করে আনা হয় যেন তাদের মুনাফা লাভের দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক রেখে নতুন পরিকল্পনা, ধারণা তৈরি করেন এবং তা নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে কাজে পরিণত করা সম্ভব হয়।

পদ্ধতি অনুসারে ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার জন্য ব্যাংক খাতে তার বহুদিনের অভিজ্ঞতা না থাকলেও খাত কীভাবে কাজ করে, সে সম্পর্কে সম্যক অবগত হওয়া প্রয়োজন।

এছাড়া এই স্বাধীন পরিচালকরা প্রয়োজনীয় বাস্তবসম্মত ধারণা এবং প্রযুক্তিগত কাজগুলো অন্যান্য কার্যনির্বাহী পরিচালকের কাছ থেকে শিখে নিতে পারেন। কেননা একটি প্রতিষ্ঠানের নিয়ম, গঠন কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে জানা প্রয়োজন।

দক্ষতার সঙ্গে স্বাধীনতাকে মিলিয়ে ফেললে ভুল হবে। যদিও পৃথিবীব্যাপী স্বাধীন পরিচালকদের সুবিধা সম্পর্কে প্রচুর উদাহরণ আছে কিন্তু এদের অবশ্যই শিল্প সম্পর্কে জানতে হবে। কেননা কাজ কীভাবে হয় তা না জানলে কাজ করা সম্ভব নয়।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তাদের অবশ্যই মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন হতে হবে। কেননা এর মাধ্যমে অন্য সদস্যদের যুক্তি বা দৃষ্টিভঙ্গি বুঝে কাজ করা সহজ হবে।

পাশাপাশি বাইরের জগতের সঙ্গে ভালো যোগাযোগ বা পরিচয় থাকলে ধরনের পরিচালকরা বাজার, শিল্প এবং মানুষের মিশ্রণে বৈচিত্র্য সৃষ্টি করে প্রতিষ্ঠানকে আরো সংহত করতে সক্ষম হন।

যেহেতু পরিচালকরা ব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্কের বন্ধনে যুক্ত নন, তাই তারা সহজেই নানা প্রশ্ন তুলতে এমনকি সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন। ফলে একপক্ষীয় সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না কিংবা ভুলভ্রান্তির প্রতি যে প্রশ্ন উঠে তা শোধরানো যায়।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, স্বাধীন পরিচালকরা তাদের শুভবুদ্ধি এবং কাজ দ্বারা প্রতিষ্ঠানের হিতসাধন করে থাকেন।

কিছু আন্তর্জাতিক/আঞ্চলিক ব্যাংকের উদাহরণ

জেপি মরগান চেজের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের মধ্যে পেশাদারি খাত সম্পর্কে জ্ঞান, ব্যবসায়িক, আর্থিক দক্ষতা, উচ্চপর্যায়ের ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি এসবের উপস্থাপনার বৈচিত্র্যের ভারসাম্যের দিকে গুরুত্ব দেন।

মূলনীতি মেনে নেতৃত্ব, ব্যবসায়িক ব্যবস্থাপনা, জেপি মরগান চেজ এবং এর ব্যবসা সম্পর্কে অভিজ্ঞ লোকদের মধ্য থেকে আবার যারা বিচারবুদ্ধি, অর্জন, সততা এবং চ্যালেঞ্জ গ্রহণে আগ্রহী, পরিচালনা পর্ষদে তাদের নিয়োগ করা হয়। প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার নীতি অনুসারে বলা হয়, বোর্ডের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য অন্তত স্বাধীন হবেন।

অন্তর্ভুক্তির কিছু মানদণ্ড অনুসারে যেসব প্রার্থী বিশেষভাবে নীতির প্রমাণ দেখিয়েছেন, ব্যবসায়িক, পেশাজীবী প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা কিংবা সমপর্যায়ের নীতিনির্ধারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, বিশেষ কোনো কাজে দক্ষ কিংবা এর আগে কাজ করেছেন বলে সদস্যদের কেউ বলে থাকেন; আর্থিক বিষয়ে এমন দক্ষতা আছে, যা দ্বারা নানা বিষয় নিরীক্ষণ করতে পারবেন; সবার সঙ্গে মিলে বিশ্বস্ততার সঙ্গে কাজ করার সঙ্গে ব্যবস্থাপনার নানা বিষয়ে প্রশ্ন তুলতে ইচ্ছুক, এমন ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

এইচএসবিসি হোল্ডিংসের নীতি অনুসারে এর পর্ষদে স্বাধীন কার্যনির্বাহী পরিচালকদের প্রাধান্য থাকতে হবে, যাদের কাজ হবে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা নিরীক্ষণ এবং চ্যালেঞ্জ করার পাশাপাশি কৌশলগত বিষয়ের উন্নতিকল্পে সাহায্য করা। প্রতিষ্ঠানের ঝুঁকির পাশাপাশি গৃহীত নীতি এবং ব্যবস্থাপনা মূল্যায়ন করে তা জানানোও তাদের কাজ।

স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের পরিচালনা পর্ষদে বর্তমানে ১৬ জন সদস্য রয়েছেনচেয়ারম্যান, ছয়জন নির্বাহী পরিচালক এবং নয়জন -নির্বাহী পরিচালক। এভাবে গঠনের উদ্দেশ্য একটি যৌথ পরিচালকমণ্ডলী, যাদের দক্ষতা, ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানের উন্নতি লাভ করা সম্ভব হয়। কৌশলগত নির্দেশনা দেয়ার ক্ষেত্রে এখানে তদারকি, মূল্যায়ন ইত্যাদির নিরিখে নেতৃত্ব নিশ্চিত করা হয়। পর্ষদ সব -নির্বাহী পরিচালককে যেকোনো ধরনের ব্যবসায়িক বা অন্যান্য সম্পর্ক, যা নীতিনির্ধারণে প্রভাব ফেলতে পারে, তা থেকে স্বাধীন বিবেচনা করে।

আঞ্চলিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে কিছু যেমন ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক অব সিঙ্গাপুর (ডিবিএস) কিংবা ইউনাইটেড ওভারসিজ ব্যাংক (ইউওবি); ভারতের এইচডিএফসি বা আইসিআইসিআই ব্যাংকের পাশাপাশি শ্রীলংকার কমার্শিয়াল বা সাম্পাথ ব্যাংক অনেকটা এমনই মতাদর্শে চলে। এসব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ প্রাথমিক রূপে স্বাধীন পরিচালকদের হাতেই চলে।

পরিচালকদের বেশির ভাগই প্রাসঙ্গিক বিষয়ে যথেষ্ট প্রশংসিত এবং স্বাধীন পরিচালক হিসেবে তারা আক্ষরিক অর্থেই ব্যাংকের কৌশল এবং ব্যবস্থাপনাকে প্রভাবিত করেন। তাদের পারিশ্রমিকও তদ্রূপ তাদের উৎসাহী এবং কর্মদক্ষতাকে সুবিচার করার মতো করেই পরিকল্পিত।

এসবের ভিত্তিতে বলা যায় বিশ্বের বেশির ভাগ আন্তর্জাতিক মানের ব্যাংক, এমনকি অনেক আঞ্চলিক ব্যাংকও স্বাধীন নির্বাহী পরিচালক নিয়োগে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের সফলতা এবং প্রবৃদ্ধি প্রমাণ করে যে অর্জনের পেছনে স্বাধীন পরিচালক থাকাই সরাসরি ভূমিকা রাখে।

কারণেই স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে যে বাংলাদেশ কেন তাদের বাণিজ্যিক ব্যাংকের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবযুক্ত কিংবা ব্যাংকের মালিকানার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের ভুল সিদ্ধান্ত দ্বারা ব্যাংক খাতকে ক্ষতির মুখে ঠেলে না দিয়ে স্বাধীন পরিচালক নিয়োগ দিতে পারছে না। 

বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ব্যাংক নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে

জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি অনুসারে ১৯৭৫ সাল থেকে হিসাব করে বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ বলা হয়েছে। ২০১৫ সালে দেশটি নিম্নমধ্যম আয়ের কাতারে পৌঁছেছে। ২০১৮ সাল নাগাদ দেশটি এই স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হওয়ার তিনটি শর্ত পূরণ করে এবং এখন তালিকা থেকে বের হওয়ার সঠিক পথে রয়েছে।

বিষয়টি মাথায় রেখে বাংলাদেশ তার সমস্যাসংকুল ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে পুনরায় উজ্জীবিত এবং দৃঢ় করার চেষ্টা করছে এবং করা উচিত। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে প্রবেশের জন্য এটি জরুরি।

স্বল্পোন্নত দেশগুলো সাধারণত আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নানা রকম ছাড় পেয়ে থাকে এবং স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর আর এসব সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায় না।

যেহেতু একটি দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা এর আর্থিক বাণিজ্যিক ব্যবস্থার মেরুদণ্ড এবং ভিত্তি হিসেবে ব্যবহূত হয়, নিঃসন্দেহে দৃঢ়, টেকসই এবং দক্ষ ব্যাংকিং খাত তৈরি হলে তা বাংলাদেশকে আরেক ধাপ এগিয়ে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করবে।

কারণেই ব্যাংক পরিচালনার ক্ষেত্রে নতুন করে চিন্তাভাবনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাঠামো গড়ার পাশাপাশি স্বাধীন পরিচালকদের দায়িত্ব, কর্তব্য, ভূমিকা পুনর্গঠন করাই হবে সর্বপ্রথম এবং সর্বোত্কৃষ্ট পদক্ষেপ।

 

মামুন রশীদ: অর্থনীতি বিশ্লেষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন