মানব পাচার রোধ

আইনের প্রয়োগ ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় সহযোগিতা বাড়ুক

মানব পাচার একটি বৈশ্বিক সমস্যা। তবে বাংলাদেশে এর ভয়াবহতার মাত্রা অনেক বেশি। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদন এবং যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মানব পাচারবিষয়ক প্রতিবেদনে প্রায়ই আমাদের দেশের নাম তালিকার প্রথম দিকে থাকছে। ওইসব প্রতিবেদনে বাংলাদেশের যে চিত্র উঠে আসছে, তা ভীষণ উদ্বেগজাগানিয়া। দীর্ঘদিন ধরে মানব পাচার নিয়ে বিভিন্ন ফোরামে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। রাজধানীতে বিষয়ে এখনো চলছে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন। সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে দেয়া বক্তাদের ভাষ্যে বিপুলসংখ্যক মানুষ অব্যাহতভাবে দেশী-বিদেশী মানব পাচারকারীর প্রলোভনের শিকার হচ্ছে বলে উঠে এসেছে। এতে একদিকে ভুক্তভোগীদের অধিকার যেমন ব্যাহত হচ্ছে, তেমনি ক্ষুণ্ন হচ্ছে দেশের ভাবমূর্তি। সর্বোপরি তৈরি হচ্ছে বহুমাত্রিক সামাজিক মানবিক সংকট। কাজেই মানবতাবিরোধী ঘৃণ্য অপরাধ সর্বাত্মকভাবে প্রতিরোধ হওয়া প্রয়োজন।

রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের দিক থেকে মানব পাচার রোধে অঙ্গীকার প্রচেষ্টার ঘাটতি নেই। তবু পাচারের ব্যাপকতা কমছে না। এর পেছনে স্পষ্টত কিছু কারণ বিদ্যমান। সেগুলোর মধ্যে দারিদ্র্য, বৈষম্য, কর্মের সুযোগের অভাব স্বল্প শিক্ষা অন্যতম। সাধারণ মানুষের অসচেতনতার সুযোগ নিয়ে পাচারকারী চক্র নানা প্রলোভন দেখিয়ে নারী, পুরুষ শিশুদের পাচার করছে। তথ্য বলছে, পাচারের শিকার মানুষের অধিকাংশই নারী শিশু ( প্রায় ৭০ শতাংশ) তাদের যৌন নিগ্রহ জোরপূর্বক কায়িক শ্রমে বাধ্য করা হয়। এটি জাতিসংঘ ঘোষিত সর্বজনীন মানবাধিকার সনদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এটি অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। দেশে মানব পাচার প্রতিরোধে শক্ত আইন রয়েছে। এর যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা দরকার। ২০১২ সালে আইনটি প্রণীত হলেও দুঃখজনকভাবে মানব পাচারবিষয়ক অপরাধের তদন্ত, মামলা পরিচালনা অপরাধীর দণ্ড দেয়ার ক্ষেত্রে অগ্রগতি সামান্য। অনেক মামলা দীর্ঘ সময় ধরে ঝুলে আছে। এসব মামলার বিচার প্রক্রিয়ায় গতি আনতে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল দাবি করছেন সংশ্লিষ্টরা। এর বাস্তবায়ন জরুরি। পাচারকারীদের অপতত্পরতা বন্ধে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও আরো চৌকস হতে হবে। আজকাল ডিজিটাল প্রযুক্তি, ট্র্যাকিং ডিভাইস ব্যবহার করে পাচারকারী তাদের অবস্থান চিহ্নিত করা সহজ। এগুলোর ব্যবহার বাড়াতে হবে। অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, সীমান্ত এলাকা দেশের সুনির্দিষ্ট কিছু জায়গাকে পাচারকারীরা ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করে। এসব জায়গায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহল বাড়াতে হবে। নতুন কোনো স্থানকে অপরাধীরা ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করছে কিনা, সেটি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া চাই।

মানব পাচার শুধু দেশীয় চৌহদ্দির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এর একটা আন্তর্জাতিক ব্যাপ্তি আছে। তাই ইচ্ছা থাকলেও বাংলাদেশ এটি সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করতে পারবে না। এজন্য বৈশ্বিক সহযোগিতা বাড়াতে হবে। বাস্তবতা হলো, এখন পর্যন্ত অনেক মানুষের মৃত্যুর কারণ হলেও মানব পাচারকারী চক্রগুলো ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। মূল চক্রগুলো লিবিয়া, দুবাই, তুরস্ক প্রভৃতি দেশে কার্যক্রম চালানোর কারণে তাদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না বলে খবর মিলছে। অবস্থায় ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহূত দেশগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করা যায় কিনা, সেটি ভাবতে হবে। আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ানো গেলে মূল দুর্বৃত্তদের ধরা অসম্ভব নয়। তার জন্য কূটনৈতিক তত্পরতা এবং সরকার টু সরকার পর্যায়ে মানব পাচারবিরোধী আলোচনা জোরদার করা প্রয়োজন।

পাচারের সমস্যাটি নিছকই আইন-শৃঙ্খলাজনিত নয়, এর সঙ্গে মানুষের সত্যিকারের অর্থনৈতিক প্রয়োজনটিও ভীষণভাবে যুক্ত। দেশে কর্মসংস্থানের ঘাটতি রয়েছে। নতুন কাজের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। অবস্থায় দেশের বিপুলসংখ্যক বেকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস, বিদেশে গেলে তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরবে, পারিবারিক সচ্ছলতা আসবে।  বিশ্বাসই কাজে লাগাচ্ছে পাচারকারীরা এবং তাদের প্রলোভনে অবৈধভাবে বিদেশে পাড়ি জমাতে জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছে অনেক তরুণ-তরুণী। ২০১৫ সালে থাইল্যান্ডে বাংলাদেশীদের গণকবর পাওয়া যাওয়া, ২০১৯ তিউনিসিয়া উপকূলে নৌকাডুবিতে ৩৭ জন বাংলাদেশীর মৃত্যু, কিছুদিন আগে লিবিয়ায় ২৬ জন বাংলাদেশীকে অপহরণ প্রভৃতি ঘটনা তারই প্রমাণ। তাই মানব পাচার রোধে দেশের অভ্যন্তরে কর্মনিয়োজন বাড়াতেও উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে অভিবাসন প্রক্রিয়ায়ও বদল দরকার। আমাদের অভিবাসন প্রক্রিয়া এখনো দালালনির্ভর। বিদেশে যাওয়া কর্মীদের বেশির ভাগই রিক্রুটিং এজেন্সির নাম-পরিচয় সম্পর্কে অবগত থাকেন না। ফলে দালাল কর্তৃক সহজেই প্রতারিত হন। এটিও মানব পাচারে পরোক্ষ ভূমিকা রাখছে। কাজেই পাচার রোধে অভিবাসনের ক্ষেত্রেও সংস্কার আনা এখন সময়ের দাবি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন