কিটক্যাটের জাপান যাত্রা...

ইউসুফ আলী শিমুল

১৮৬২ সালে যুক্তরাজ্যের উত্তারঞ্চলের শহর ইয়র্কে একটি কোকোয়া ফার্ম কিনে নেন হেনরি রাউন্ট্রি নামে এক ব্যক্তি। অল্পদিনের মধ্যেই তিনি সেখান থেকে অন্যত্র চলে যান এবং তার ভাই জোসেফকে সঙ্গে নিয়ে ‘রাউন্ট্রি’ নামে পারিবারিক মিষ্টি তৈরির ব্যবসা গড়ে তোলেন। পরে তারা তাদের রেসিপিগুলোকে উন্নত করার জন্য একটি ফরাসি মিষ্টির কারিগরকে নিয়োগ দেন। ১৯৩০ সালে তাদের প্রতিষ্ঠান দুধ-চকলেটে মোড়ানো ওয়েফার বাজারে নিয়ে আসে, যা এখন আমরা কিটক্যাট নামে চিনি। পরবর্তীতে রাউন্ট্রির কোম্পানিটি কিনে নেয় বিখ্যাত নেসলে কোম্পানি। এখনো সারাবিশ্বে নেসলের অধীনেই বাজারজাত করা হয় কিটক্যাট। অবশ্য আমেরিকায় কিটক্যাট বাজারজাত হয় দ্য হারশে কোম্পানির অধীনে। 

কিন্তু শুরুর দিকে কিটক্যাটের যাত্রার গল্পটা বিপণন সংস্থা বা সংশ্লিষ্টদের জন্য এক অনন্য উদাহরণই বটে। বিশ্বব্যাপী এই জনপ্রিয় চকলেট বার প্রথম দিকেই খোলাই বিক্রি হতো। পরে রাউন্ট্রির শুরু করা ছোট্ট প্রতিষ্ঠানটির এক কর্মচারীর পরামর্শে ওয়েফারগুলোকে প্যাকেটজাত করা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, এগুলো একটা প্যাকেটে ভরিয়ে বিক্রি করা হলে কেউ কাজে গেলেও এই চকলেট সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবে।

যাত্রা শুরুর কিছুদিন পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে কঠিন সময়ে চকলেটের রেসিপি এবং ব্র্যান্ডিংয়ে পরিবর্তন আনতে বাধ্য হন রাউন্ট্রি। তবে যুদ্ধ থামার পর স্বাভাবিক জীবন যাপন শুরু হলে কিটক্যাটের জনপ্রিয়তা ফিরে আসে। সেসময় কিটক্যাটের স্লোগান ছিল ‘দ্য বিগগেস্ট লিটল মিল ইন ব্রিটেন’। জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকলে রাউন্ট্রি ব্রিটিশ শাসিত অঞ্চলগুলোতে এই চকলেট রফতানি করা শুরু করেন। ১৯৫০ সালে এসে চকলেট কোম্পানিটি তাদের স্লোগান পরিবর্তন করে, যা এখনো চলছে। স্লোগান দেয়া হয় ‘হ্যাভ এ ব্রেক, হ্যাভ এ কিটক্যাট’। 

১৯৭০ সালে যখন কিটক্যাট জাপানে যাত্রা শুরু করল, তখন এই চকলেট ক্রেতাদের কাছে ‘ব্রিটিশ আচরণের’ প্রতীক হিসেবে বিক্রি করা হতো। জাপানের ব্যবসায় শিক্ষার অধ্যাপক ফিলিপ সুগাই এক গবেষণায় লিখেছেন, জাপানের বিজ্ঞাপনে দেখানো হয়েছিল যে, ‘ব্রিটিশ জনগণ স্পষ্টতই ব্রিটিশ পরিবেশে কাজের ফাঁকে কিটক্যাট উপভোগ করছে। সেখানে বার্তা দেয়া হয়েছিল যে, জাপানিরা কীভাবে ব্রিটিশদের মতো জীবন উপভোগ করতে পারে।’

এই বিপণন বিজ্ঞাপনে সমর্থন যোগায় আরেক সুইজারল্যান্ডের বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান নেসলে। ১৯৮৮ সালে রাউন্ট্রির কোম্পানিটি কিনে নেয় নেসলে। কিন্তু তারপরও গ্লিকোর মতো স্থানীয় চকলেট কোম্পানিগুলোর সাথে পেরে উঠছিল কিটক্যাট। কিন্তু কয়েক দশকের ব্যবধানে জাপানে কী করে জনপ্রিয়তার শীর্ষে এলো কিটক্যাট- তার এক গবেষণা বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জাপানের জনসংযোগ প্রতিষ্ঠান এডেলম্যান জাপানের সাবেক প্রধান রস রাউবারির মতে, এই না পেরে ওঠার কারণ হল- জাপানে কিটক্যাটকে একটি বিদেশী চকলেট হিসাবে দেখা হতো এবং এটাই মনে করা হতো যে এটা কখনোই জাপানে জনপ্রিয়তা পাবে না।’ এমনকি একসময় জাপানের কোবিতে নেসলের আঞ্চলিক অফিসের কর্মকর্তাদের নিজেদের মনেই প্রশ্ন ওঠে যে, জাপানে আদৌ কিটক্যাটের কোন ভবিষ্যত আছে কি না? নেসলে পরে ক্রেতাদের নিয়ে তাদের পরিকল্পনা বদলায়, তারা জাপানের শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে।

কিন্তু এ ক্ষেত্রেও বাধা হয়ে আসে কিটক্যাটের স্লোগান। কারণ তবে নেসলের এথনোগ্রাফিক গবেষণা থেকে জানা যায় যে জাপানি কিশোর-কিশোরীরা ‘হ্যাভ এ ব্রেক’ স্লোগান পছন্দ করছে না। এই শিক্ষার্থীরা এমনিতে পরীক্ষার পড়া নিয়ে চাপে ছিল। এসময় তাদের কাছে ‘বিরতি’ শব্দটায় তারা সত্যি সত্যিই একটা বিরতি আশা করতো, কোন চকলেট নয়।

তবে এরপরেই আসে নাটকীয় একটা পরিবর্তন। এই অবস্থায় এসে পশ্চিমা করপোরেট কর্তাদের আর কিছুই বাকী ছিল না। ২০০০ সালের কিছু আগে, নেসলের স্থানীয় ব্যবস্থাপক মাসাফুমি ইশিবাশি এবং তার বস কোহজোহ তাকাওকা জানতে পারেন যে, দক্ষিণ জাপানের দ্বীপ কিউশুতে কিটক্যাটের বিক্রি বেড়েছে। এর কারণ অনুসন্ধানে নেমে তার জানতে পারেন, সেখানকার শিক্ষার্থীরা কিটক্যাট শব্দের জাপানি একটা অর্থ বের করেছেন। জাপানের একটি দুটি শব্দ ‘কিটেটা কাৎসু’-কে তারা সংক্ষেপে কিটক্যাট মনে করেছে। যার অর্থ হল ‘তুমিও জিতবে’। আর এ শব্দটিকে নিজেদের জন্য শুভকামনার অর্থেই মনে করেছিল। ব্যাপারটা এতটা ছড়িয়ে পড়ে যে, শিক্ষার্থীরা তাদের পরীক্ষার আগে একে অন্যকে শুভ কামনা জানাতে কিটক্যাট উপহার দেয়া শুরু করল। 

প্রাথমিকভাবে, এটাকে হয়তো ছেলেমানুষী ছাড়া কিছুই মনে হবে না। তাই নেসলের কোবে টিম চকলেটের স্লোগান ‘টেক এ ব্রেক’ পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়ার সাহস করেনি। কারণ তারা জানত যে সুইজারল্যান্ডে বসে তাদের কর্মকর্তারা কিটক্যাটকে বিশ্বের নামী একটা ব্র্যান্ড করার পরিকল্পনা করছিল। তবে তাকাওকা ও ইশিবাশি এবং তাদের দলের বাকিরা মিলে শিক্ষার্থীদের এই ক্রেইজটাকে কিউশু দ্বীপের বাইরে ছড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। তার ছোট্ট একটা কৌশল নিল, কিটক্যাটের জাপানি বিজ্ঞাপনগুলোতে ‘কিট্টো সাকুরা সাকু ইয়ো!’ নামে একটি বাক্যাংশ যুক্ত করে দিলেন, যার অর্থ ‘শুভকামনা সত্য হোক’। এছাড়াও তারা তাদের জাপানি বিজ্ঞাপনগুলোতে এবং পরীক্ষার কেন্দ্রের পাশের হোটেলগুলোতে সাঁটানো পোস্টারে আরো কিছু স্লোগানসহ শিক্ষার্থীদের মধ্যে কিটক্যাট বিতরণ করার বার্তা যোগ করে দেয়। তাদের স্লোগানগুলোর আক্ষরিক অর্থ দাঁড়ায় ‘চেরি ফুল ফুটবেই’। 

সুগাই তার গবেষণায় লিখেছেন, জাপানে চেরি ফুলের মৌসুমকে পবিত্র মনে করা হয়। আর সেখানে প্রচুর চেরি গাছও রয়েছে।

ইশিবাশি যোগ করেছেন, ‘আমরা কী করছিলাম তা সুইজারল্যান্ডে নেসলের সদর দফতরকে ঠিক জানাই নি, কারণ আমরা জানতাম যে এটি জাপানের বাইরের লোকদের কাছে অদ্ভুত লাগবে। আমরা কাজটা চুপচাপই শুরু করতে চেয়েছিলাম এবং এটি কার্যকর হবে কিনা তা দেখতে চেয়েছিলাম।’

কিন্তু যা ফলাফল হয়ে তা আশানুরূপ, জাপান জুড়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে কিটক্যাটের বিক্রী হুহু করে বেড়ে যায়। কিশোর-কিশোরীরা চকলেট বারটিকে সৌভাগ্যের প্রতীক হিসাবে দেখা শুরু করে দিয়েছিল। অবস্থা এমন হয়েছিল যে, শুভকামনা জানানোর প্রতীক সেখানে মন্দিরগুলোতেও এই চললেট বিক্রি হয়েছিল। 

২০০৩ সালের জানুয়ারিতে এক জরিপে ৩৪ শতাংশ জাপানি কিশোর-কিশোরীরা জানিয়েছে যে, একটি কিটক্যাট তাদের সৌভাগ্যের প্রতীক। পূজারিদের দেয়া ওমোমরি (সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে পরা হয়) পরেই যার অবস্থান।’

ইশিবাশি সেটিকে মনে করে বলেন, ‘এটি আশ্চর্যজনক ছিল, যে চকোলেট ওমোমরি হয়ে গেছে।’

পরে জাপানি দলটি নেসলের সদর দফরের এ ঘটনা জানিয়েছিল এবং তাদের কর্মকর্তারাও তাদের সেই কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন। পরে কোবেতে কিটক্যাটের প্যাকেজিং-এ শিক্ষার্থীদের শুভকামনা জানিয়ে বার্তা দেয়ার জায়গাও রাখা হয়েছিল। আর একসময় জাপানের পোস্টাল সার্ভিস এই প্যাকেটকেই অফিশিয়াল খাম হিসেবে নিতেও বাধ্য হয়। ‘সুগাইয়ের মতে, পোস্টাল সিস্টেমে এত বড় পরিবর্তন আগে কেউ আনেনি।

এমনকি ২০১১ সালেও পূর্ব জাপানের ফুকুশিমা যখন সুনামির কবলে পড়ল, তখন মানুষজন সেখানকার উদ্ধারকর্মীদের সাহস যোগাতে কিটক্যাটের উপহার বাক্স পাঠিয়েছিল। এমনকি পরে এই বিশেষ বাক্সগুলো ফুকুশিমায় পর্যটক বাড়ানোর জন্য একটি স্কিমের আওতায় ট্রেনের টিকিট হিসাবে বৈধ করা হয়েছিল।

ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস অবলম্বনে 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন