সিপিডির সংলাপে বক্তারা

রাজস্বে চাপ সৃষ্টি হবে না এমন বিদ্যুৎ উৎপাদন দরকার

নিজস্ব প্রতিবেদক

ভিশন-২০৪১ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে দেশে বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনা (পিএসএমপি) হাতে নিয়েছে সরকার। তবে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সক্ষমতা অনুযায়ী বিদ্যুতের চাহিদা তৈরি করতে পারেনি সরকার। ফলে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ দেশের অর্থনীতিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। ফলে বিদ্যুৎ চাহিদার সামঞ্জস্যতা তৈরিতে মহাপরিকল্পনা পুনর্মূল্যায়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। মহাপরিকল্পনায় রাজস্বে চাপ সৃষ্টি হবে না এমন বিদ্যুৎ উৎপাদনে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

গতকাল সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত প্রোপজড পাওয়ার অ্যান্ড এনার্জি সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যান (পিইএসএমপি): চ্যালেঞ্জেস অব প্রজেক্টিং র্যাশনাল ইলেকট্রিসিটি ডিমান্ড শীর্ষক সেমিনারে এসব কথা বলেন বক্তারা।

ওয়েবিনারে শুরুতেই মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। মূল প্রবন্ধে তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে বিদ্যুৎ জ্বালানির মহাপরিকল্পনা নিয়ে যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, সেটিকে আমরা অভিনন্দন জানাই। সিদ্ধান্ত এমন সময় নেয়া হলো, যখন বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতে আমরা নানামুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছি। জাপান ইন্টারন্যাশনাল করপোরেশনকে আমরা সাধুবাদ জানাই। মহাপরিকল্পনা পুনর্মূল্যায়নে তারা আমাদের দেশের বিদ্যুতের ক্যাপাসিটি ডেভেলপমেন্টকে সহায়তা দেবে। একই সঙ্গে আমরা মনে করি, জিরো কার্বন নিঃসরণে তারা কী উদ্যোগ নিতে চায় সেটিও আমাদের অবহিত করবে।

মূল প্রবন্ধে পিইএসএমপির ক্ষেত্রে বেশকিছু সীমাবদ্ধতা দেখা গেছে, বিশেষত স্বল্প সংখ্যক সূচক ব্যবহার করে মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে, জিডিপি ব্যবহার করে হিসাব করা হয়েছে, সেখান থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা প্রয়োজন।

মহাপরিকল্পনায় আর্থিক ঝুঁকির বিষয়ে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে আর্থিক দায়ের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) এবং বিদ্যুৎ জ্বালানি বিভাগ। সেই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসার প্রয়োজন। একই সঙ্গে অতিরিক্ত যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে, সেগুলো কমিয়ে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করতে হবে।

এক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশ যে ম্যাথড ব্যবহার করে, বিশেষ করে টপ ডাউন বা বটম অ্যাপ ম্যাথড। সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যেটি সুবিধাজনক সেটি ব্যবহার করা দরকার। তথ্য-উপাত্তের যে ঘাটতি রয়েছে, সেটির জন্য নতুন করে যদি জরিপ চালানোর প্রয়োজন পড়ে তাহলে সেটি করতে হবে।

ওয়েবিনারে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বুয়েটের অধ্যাপক তামিম বলেন, বিদ্যুৎ জ্বালানির প্রক্ষেপণ অনুযায়ী চাহিদায় যে চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে, সেটি নিয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে। একই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় না গিয়ে পাঁচ বছর এবং ১০ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে। এতে দীর্ঘমেয়াদে বিদ্যুৎ-জ্বালানির অর্থায়নগত জটিলতা থেকে বেরিয়ে আসা যাবে।

তিনি বলেন, আমরা যদি ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত পর্যালোচনা করি, সেখানে দেখা গেছে, যে পরিমাণ পাওয়ার প্লান্ট হওয়ার কথা ছিল তার ৬০ শতাংশ মাত্র কাজ শুরু করতে পেরেছিল, বাকি ৪০ শতাংশ করতে পারেনি। এখন যেসব পরিকল্পনা করা হচ্ছে, সেখানেও চ্যালেঞ্জ হবে। সেক্ষেত্রে আরো বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা করা উচিত।

ওয়েবিনারে বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি বলেন, মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী বিদ্যুৎ খাতে বাংলাদেশ সাফল্যের ধারা অব্যাহত রেখেছে। তবে এখন সময় এসেছে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে গুরুত্ব দেয়ার। ভবিষ্যতের জ্বালানি সক্ষমতা বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশকে জলবায়ু পরিবর্তনে গুরুত্ব দিতে হবে। এজন্য নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে যাওয়ার আহ্বান জানান তিনি। মাতারবাড়ীতে যে বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে, সেটি নিয়ে বাংলাদেশে বিতর্ক হবে এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না জাপান।

মহাপরিকল্পনায় দেশীয় বিশেষজ্ঞ না রাখায় সমালোচনা করে প্রফেসর আনু মুহাম্মদ বলেন, দেশের বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতের একটা মহাপরিকল্পনা করা হয়েছে, অথচ সেখানে দেশীয় কোনো বিশেষজ্ঞ রাখা হয়নি। গত ৫০ বছরে কী দেশে কোনো বিশেষজ্ঞ তৈরি হয়নি? জানি না সরকার এটা কীভাবে দেখছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পটভূমি বিবেচনা করে কী ধরনের জ্বালানি প্রয়োজন, দেশের সঙ্গে সেটা কীভাবে যাচ্ছে, সেটি কী দেশীয় বিশেষজ্ঞদের ধারণা নেই? এখানে জাপানি বিশেষজ্ঞ দিয়ে মহাপরিকল্পনা করায় তাদের দেশের প্রকৌশলী কোম্পানিদের বিশেষ আগ্রহের জায়গা রয়েছে। তারাই এদেশের বেশির ভাগ বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করছে।

পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মাদ হুসাইন বলেন, বিদ্যুৎ জ্বালানি মহাপরিকল্পনার যে ধরনের চ্যালেঞ্জগুলো মূল প্রবন্ধে উপস্থাপন করা হয়েছে সেটি আমরা অস্বীকার করছি না। তবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে যে কাজ করছি না সেটি বলা ভুল হবে। এছাড়া বিদ্যুতের চাহিদা অনুযায়ী সক্ষমতায় যে চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে সেটিও এখন দৃশ্যমান। কীভাবে এটা চাহিদার সঙ্গে সমন্বয় করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় তা বিবেচনায় নিয়ে কাজ করছে সরকার।

বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (আইপিপি) অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ইমরান করিম বলেন, বিদ্যুৎ জ্বালানি নিয়ে সরকারের মহাপরিকল্পনাকে আমরা সাধুবাদ জানাই। তবে বিদ্যুৎ খাতে বেসরকারি উৎপাদন কমিয়ে মহাপরিকল্পনায় জীবাশ্ম জ্বালানি এবং এলএনজির ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে, সেখানেও কিন্তু চ্যালেঞ্জ কম নয়। চলতি বছরের শুরুতে এলএনজি এবং কয়লার যে বাজার, তাতে ধরনের অনিশ্চিত জ্বালানি নিয়ে পরিকল্পনার চাইতে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালু রাখার বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে।

ওয়েবিনারে মূল প্রবন্ধে বিদ্যুৎ জ্বালানির মহাপরিকল্পনায় চারটি প্রধান মৌলকে কাজে লাগানোর সুপারিশ করা হয়। প্রথমত, একটি প্রাগগ্রসর পদ্ধতি ব্যবহার করা। দ্বিতীয়ত, আগের পরিকল্পনায় যে সীমাবদ্ধতা রয়েছে সেগুলো দূর করা। তৃতীয়ত, অতিরিক্ত যে বিদ্যুৎ সক্ষমতা রয়েছে সেগুলো কীভাবে কমিয়ে আনা যায়, তার একটি দিকনির্দেশনা থাকা দরকার। চতুর্থত, কীভাবে আমরা ক্লিন এনার্জি বা পাওয়ারের দিকে যেতে পারি, সেটির জন্য কাজ করা।

অনুষ্ঠানে সঞ্চালনা করেন সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান। স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন