নোয়াখালী অঞ্চলের শিল্পোদ্যোক্তাদের উপকর্তা ছিলেন মওদুদ আহমদ

হাছান আদনান

আশির দশকের শুরুতেও উদ্যোক্তা এমএ হাশেমের ব্যবসা ছিল ট্রেডিং নির্ভর। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী আমদানি বিপণন ছিল তার মূল ব্যবসা। সরকারি প্রতিষ্ঠান পারটেক্স কিনে নেয়ার মাধ্যমে পরবর্তী সময়ে শিল্প উৎপাদনে যুক্ত হন তিনি। পারটেক্স কিনতে সহায়তার পাশাপাশি এমএ হাশেমকে শিল্পোদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়ক ভূমিকায় ছিলেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ।

পারটেক্সের স্বপ্নদ্রষ্টা এমএ হাশেম শুধু নন, বরং মওদুদ আহমদ ছিলেন বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলের শিল্পোদ্যোক্তাদের বেড়ে ওঠার সাথী। দেশের বস্ত্র পোশাক শিল্প, ইস্পাত, সিমেন্ট, নির্মাণ, সেবাসহ প্রায় সব খাতের বিস্তৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন নোয়াখালী, ফেনী লক্ষ্মীপুরের উদ্যোক্তারা। বেসরকারি ব্যাংক, বীমাসহ দেশের আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও অঞ্চলটির শিল্পোদ্যোক্তাদের ভূমিকা ছিল সামনের সারিতে। আর এসব শিল্পোদ্যোক্তার সংকট বিপদের বন্ধু ছিলেন নোয়াখালীর সন্তান মওদুদ আহমদ।

নোয়াখালী অঞ্চলের শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, দেশের রাজনীতিতে মওদুদ আহমদ কখনো নন্দিত, কখনো নিন্দিত ছিলেন। কিন্তু কর্মসংস্থান সৃষ্টি শিল্প প্রতিষ্ঠায় তার ভূমিকা ছিল দলমতের ঊর্ধ্বে। নোয়াখালী অঞ্চল ছাড়াও দেশের যেকোনো শিল্পোদ্যোক্তার বিপদ-আপদে মওদুদ আহমদ ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন। কোনো একটি সূত্র ধরে তার কাছে উপস্থিত হতে পারলেই শিল্পোদ্যোক্তারা তড়িৎ গতিতে সেটির সমাধান পেয়েছেন।

দেশের বড় করপোরেটগুলোর মধ্যে আবুল খায়ের গ্রুপ, পারটেক্স, বেঙ্গল, গ্লোব, দুলাল ব্রাদার্স, মাল্টিমোড, আরএসআরএম, জেকে গ্রুপ, মিউচুয়াল গ্রুপ, বেস্ট হোল্ডিংস, এজি গ্রুপ, ম্যাক্স গ্রুপ, তমা গ্রুপ, নিউ জেনারেশন কনস্ট্রাকশন, সজীব গ্রুপ, এমকেআর গ্রুপ, আনোয়ার খান, ইলেক্ট্রোমার্ট, রেজা গ্রুপ, এভিন্স গ্রুপ, সানম্যান গ্রুপ, নূরজাহান, এফএআরএস গ্রুপের উদ্যোক্তাদের জন্মস্থান বৃহত্তর নোয়াখালীর তিন জেলায়। দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এসব শিল্প গ্রুপ। উদ্যোক্তাদের অনেকেই বণিক বার্তাকে জানিয়েছেন, ব্যবসা শিল্প বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ে তারা মওদুদ আহমদের সহযোগিতা পেয়েছেন। যেকোনো বিষয়ে সহযোগিতা চাইলে দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে তিনি সমাধান দেয়ার চেষ্টা করেছেন।

বাংলাদেশে রাজনীতির কেন্দ্রে দীর্ঘ সময় ধরে প্রভাবশালী ছিলেন মওদুদ আহমদ। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আস্থাভাজনদের একজন। পরে তিনি জিয়াউর রহমান, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ খালেদা জিয়া সরকারে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। সময়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, উপপ্রধানমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন মওদুদ আহমদ।

দেশের ব্যক্তি খাতের বিকাশের লক্ষ্যে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বেসরকারীকরণের উদ্যোগ নেয়া হয় আশির দশকের শুরুতে। সময় শিল্প মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন মওদুদ আহমদ। শিল্প বিকাশের প্রতিবন্ধকতা সংকট নিয়ে উদ্যোক্তারা তার পরামর্শ সহযোগিতার জন্য যেতেন। ধৈর্যের সঙ্গে উদ্যোক্তাদের কথা শুনতেন তিনি। এরপর তাদের সমস্যার তাত্ক্ষণিক সমাধান দেয়ার চেষ্টা করতেন তিনি। মওদুদ আহমদ সম্পর্কে দেশের শীর্ষস্থানীয় একাধিক শিল্পোদ্যোক্তার অভিমত এমনই।

দেশের উজ্জ্বলতম শিল্পোদ্যোক্তাদের একজন মাল্টিমোড গ্রুপের কর্ণধার আবদুল আউয়াল মিন্টু। বস্ত্র পোশাক শিল্প, কৃষি, ভোগ্যপণ্য, সিমেন্টসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ রয়েছে শিল্পোদ্যোক্তার। দেশে বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক, প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্স, প্রগতি ইন্স্যুরেন্স, ইউনাইটেড হাসপাতালের মতো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন ফেনীর সন্তান আবদুল আউয়াল মিন্টু। বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে শিল্প বিস্তারে মওদুদ আহমদের ভূমিকা উল্লেখ করতে গিয়ে আবদুল আউয়াল মিন্টু বণিক বার্তাকে বলেন, মওদুদ আহমদের জোরাজুরিতেই আমি যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে বাংলাদেশে ফিরেছি এবং উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে যুক্ত করেছিলাম। তিনি বলতেন আলো, বাতাস, পানি থেকে শুরু করে প্রতিটি বিষয়ে দেশের কাছে তোমাদের ঋণ রয়েছে। মেধাবীরা বিদেশ থেকে ফিরে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে উঠলে দেশের বেসরকারি খাত সমৃদ্ধ হবে।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সময়ে সরকারের অন্য গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের পাশাপাশি শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন মওদুদ আহমদ। ওই সময় তার প্রচেষ্টাতেই দেশের বেসরকারি খাতের বিকাশ হয়েছিল। মওদুদ আহমদ অসীম ধৈর্যের অধিকারী ছিলেন। তার চিন্তাভাবনা জ্ঞানের গভীরতা ছিল অতুলনীয়। মওদুদ আহমদের মৃত্যু গোটা বাংলাদেশের জন্যই দুঃসংবাদ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করে মওদুদ আহমদ লন্ডনের লিঙ্কনস ইন থেকে ব্যারিস্টার-অ্যাট- ডিগ্রি নিয়ে ১৯৬৬ সালে দেশে ফেরেন। ঢাকার উচ্চ আদালতে আইন পেশা শুরু করে দৃষ্টি আকৃষ্ট করতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধুর। বঙ্গবন্ধুর আইনজীবী হিসেবে ১৯৬৮ সালে লড়েছিলেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায়। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর আগ মুহূর্তে ১৯৭১ সালে ইয়াহিয়া খানের ডাকা গোলটেবিল বৈঠকে তিনি অংশ নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধের সময় মওদুদ আহমদকে পোস্টমাস্টার জেনারেল নিয়োগ করেছিল মুজিবনগর সরকার। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে সরকারে যোগ না দিয়ে পুরোদমে আইন পেশায় যুক্ত হন তিনি।

জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর ১৯৭৭ সালে মওদুদ আহমদকে উপদেষ্টা নিয়োগ করেছিলেন। এরপর রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারে ১৯৭৯ সালে উপপ্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছিলেন তিনি। পরে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সরকারে মওদুদ আহমদ প্রথমে মন্ত্রী, এরপর পর্যায়ক্রমে উপপ্রধানমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৯ সালে ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর এরশাদ সরকারের পতনের সময় পর্যন্ত তিনি ওই পদে বহাল ছিলেন। ২০০১ সালে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আইনমন্ত্রী ছিলেন তিনি। মওদুদ আহমদ বিএনপির প্রার্থী হিসেবে ১৯৭৯ সালে তার জন্মস্থান নোয়াখালী- (কোম্পানীগঞ্জ) আসন থেকে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরপর পাঁচবার তিনি আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

রাজনীতি আইন পেশার বাইরেও লেখক হিসেবে সমাদৃত ছিলেন মওদুদ আহমদ। বাংলাদেশের রাজনীতির নানা ঘটনাপ্রবাহের বয়ান নিজের বিভিন্ন বইয়ে তিনি প্রাঞ্জল ভাষায় তুলে ধরেছেন। শিক্ষকতা পেশায়ও যুক্ত ছিলেন মওদুদ আহমদ। তিনি ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলেন। জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক হিসেবে যুক্ত থেকেছেন তিনি।

দেশের প্রথম প্রজন্মের শিল্পোদ্যোক্তাদের একজন সাউথইস্ট ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান এম কাশেম। দেশের প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থসাউথের উদ্যোক্তাদের অন্যতম তিনি। ছিলেন এফবিসিসিআই সভাপতির দায়িত্বেও। শিল্পোদ্যোক্তা বণিক বার্তাকে বলেন, একসময় আমি বাণিজ্য সংগঠনগুলোতে সক্রিয় ছিলাম। মওদুদ আহমদ তখন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। দেশে বেসরকারি খাতের সম্প্রসারণ বিদেশী বিনিয়োগকারী নিয়ে আসার ক্ষেত্রে তিনি আমাদের সঙ্গে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেছেন। সহায়তার ক্ষেত্রে তিনি নিজ এলাকাকে প্রাধান্য দেননি। নোয়াখালীর মতোই দেশের সব অঞ্চলের উদ্যোক্তাকেও তিনি উদার মানসিকতায় সহযোগিতা করেছেন।

মওদুদ আহমদ শিল্পবান্ধব নেতা ছিলেন বলে মনে করেন ইস্পাত শিল্পের প্রতিষ্ঠান আরএসআরএমের চেয়ারম্যান মাকসুদুর রহমান। তিনি বলেন, দলমতের ঊর্ধ্বে মওদুদ আহমদের কাছ থেকে সহযোগিতা পেয়েছেন উদ্যোক্তারা। তিনি শিল্পবান্ধব নেতা ছিলেন। সব সময় তিনি কর্মসংস্থান সৃষ্টির তাড়না দিতেন।

প্রায় একই অভিব্যক্তি জানিয়েছেন মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান রেজা গ্রুপের কর্ণধার একেএম সাহিদ রেজা শিমুল। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, উদ্যোক্তা হিসেবে শুরুর দিকে কোনো একটি কাজে মওদুদ আহমদের কাছে গিয়েছিলাম। তখন পর্যন্ত তার সঙ্গে আমার কোনো পরিচয় ছিল না। বড় কোনো পরিচয় দেয়ার মতো কোনো পদবিও আমার ছিল না। কিন্তু তিনি নিঃস্বার্থভাবে আমাকে সহযোগিতা করেছিলেন।

প্রসঙ্গত, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ১৯৪০ সালের ২৪ মে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার মানিকপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মরহুম মাওলানা মমতাজ উদ্দিন আহমদ ছিলেন একজন শিক্ষক মাতা বেগম আম্বিয়া খাতুন ছিলেন গৃহিণী। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে মওদুদ আহমদ ছিলেন চতুর্থ। তিনি পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের জামাতা। তার স্ত্রী হাসনা জসীমউদ্দীন মওদুদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক। দম্পতির দুই ছেলে এক মেয়ে। বড় ছেলে আসিফ মওদুদ অল্প বয়সে মারা যান। আর ছোট ছেলে আমান মওদুদ ২০১৫ সালে মারা গিয়েছেন। মেয়ে আনা আসপিয়া মওদুদ স্বামীসহ নরওয়েতে থাকেন। ১৬ মার্চ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মওদুদ আহমদ মারা যান।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন