প্রকৃতির ক্ষতি না করে হাওরের উন্নয়ন করতে হবে

এএলআরডি বণিক বার্তার যৌথ উদ্যোগে হাওরের ফসল, পরিবেশ কৃষকের অধিকার সুরক্ষা: রাষ্ট্র নাগরিক ভূমিকা শীর্ষক একটি অনলাইন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আলোচকদের বক্তব্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিয়ে ক্রোড়পত্র





দেওয়ান হানিফ মাহমুদ
সম্পাদক
বণিক বার্তা

খবরের মানুষ হিসেবে বছরের একটা সময় হাওরের দিকে আমাদের নজর রাখতে হয়। বর্ষা মৌসুমের আগে বন্যা হয়ে থাকেফ্ল্যাশ ফ্লাড যেটাকে বলে, এটি হাওর এলাকাকে ক্ষতিগ্রস্থ করে। আমাদের সাতটি জেলা হাওর অঞ্চলের অধীন এবং বন্যার সময় জেলাগুলোর মানুষ শস্যের ক্ষতি হয়ে থাকে। সে সময়ে অঞ্চলের মানুষ খাদ্যের অনিরাপত্তার মধ্যে থাকে। আমরা এখন উন্নয়নশীল দেশের পথে আছি। কিছুদিন আগে কৃষিমন্ত্রীকে আমরা বলতে শুনেছি, আমাদের হাতে অর্থ থাকলেও ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে শস্য কিনতে সমস্যা হতে পারে। হাওর অঞ্চলে আমরা কীভাবে ফসলের উৎপাদন বাড়াতে পারি বা মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারি, সে বিষয়ে আজকের আলোচনা।

হাওর অঞ্চল বাংলাদেশের বাস্তুসংস্থানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে উন্নয়নের সুযোগ আছে, কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাড়ানোর সুযোগ আছে। এখানকার মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য বৈষম্য সবকিছু নিয়েই আলোচকরা আলোচনা করবেন বলে আশা করি। হাওরেরই সন্তান আমাদের পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান, এমপি আমাদের মাঝে আছেন। তিনি অনেক দিন ধরেই হাওরের উন্নয়নে কাজ করে চলেছেন। তাকে আমাদের মধ্যে পেয়ে আমরা আনন্দিত। আমি আর বক্তব্য দীর্ঘ না করে আজকের আলোচনার সভাপতি খুশী কবিরকে তার প্রারম্ভিক বক্তব্য রাখতে অনুরোধ করছি।


খুশী কবির
চেয়ারপারসন, এএলআরডি
সমন্বয়কারী, নিজেরা করি

আমার জীবনে উন্নয়ন সম্পর্কিত কাজ শেখা এবং কাজ বোঝা হাওর অঞ্চলেই হয়েছে। শাল্লা থানার আনন্দপুর গ্রামে আমি একটানা বেশ কয়েক বছর ছিলাম। মারকুলি বাজারে থেকে আমি পুরো প্রোগ্রামটা পরিচালনা করতাম। সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে হাওর থেকে অনেক কিছুই শিখেছি। এর মাঝে দেখেছি প্রকৃতি, মানুষ হাওরের মধ্যে একটা সুন্দর সম্পর্ক আছে। হাওরের জমি এক ফসলি হলেও যখন ফসল হয়, তখন প্রচুর হয়। কেবল নিজেদের সারা বছরের প্রয়োজন মেটানোই নয়, ফসল তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় পাঠাতে পারে। সমস্যাটা হয় যখন ধান পাকার আগে বন্যা চলে আসে, তখন পুরো বছরের ফসলটা নষ্ট হয়ে যায়। এখানে যেহেতু হাওরবাসী আছেন, হাওর নিয়ে কাজ করছেন এমন মানুষও আছেন, সরকারের ভেতরের বাইরের; আশা করি সবাই মিলে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করবেন। আমরা এখন প্রকৃতি প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে বজায় রাখার প্রয়োজন বুঝি, এখন প্রশ্ন আসে সামঞ্জস্য বজায় রেখে উন্নয়নটা আমরা কীভাবে করব?

আমার মনে আছে শীতের শুরুতে হাওরে অনেক পাখি আসত! বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে আমি ঘুরেছি, কিন্তু হাওরের মতো সৌন্দর্য পাইনি। এখানে আমিও দেখেছি মানুষ প্রকৃতি মিলেমিশে কীভাবে কাজ করে। নারী কী করবে, পুরুষ কী করবে সেসব কিছু নির্ধারিত ছিল। চাষ থেকে শুরু করে ধান কেটে ঘরে তোলা, মাড়াই কীভাবে হবে তারা সবই নির্ধারিত নিয়মে করত। ধান ঘরে তোলার পর পানি উঠে গেলে মাছের চাষ হতো। এখানেই প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, সামঞ্জস্য।

আমার এটাও মনে হয় হাওর অঞ্চলে এমন কিছু যেন না হয়, যা ওখানকার মানুষ বা প্রকৃতিকে উলোটপালোট করে দেয়, যাতে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে আরো ক্ষতি হয়। পরিকল্পনা এমন হওয়া উচিত, যাতে মানুষের উপকার হয়, আমাদের ফসল রক্ষা করা যায়। ওখানে থেকে আমি পূর্ণ ফসল তোলার আনন্দ দেখেছি, আবার ফসল তলিয়ে যাওয়ার হাহাকারও দেখছি।


কাসমির রেজা
সভাপতি, পরিবেশ হাওর
উন্নয়ন সংস্থা

আমার উপস্থাপনার নাম দিয়েছি হাওরের ফসল রক্ষাবাঁধ পরিবেশ সুরক্ষা হাওরের ফসল রক্ষাবাঁধের ইতিহাস সংক্ষেপে বলতে চাই। একসময় একদম শুরুতে, বাঁধের প্রয়োজনই ছিল না, কেননা তখন ফসল ডুবে যেত না। নদীর নাব্যতা ছিল। পরবর্তী সময় এর প্রয়োজন দেখা দেয়। আমরা শুনেছি একসময় হাতি দ্বারা বাঁধ দেয়া হতো। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময় থেকে সরকারিভাবে বাঁধ দেয়ার ব্যবস্থা শুরু হয়। এরপর আমরা ঠিকাদারি, পিআইসি প্রথা দেখেছি। ঠিকাদারি প্রথার অনেক সমালোচনা ছিল। বিশেষত ২০১৭ সালের অকাল বন্যায় যে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় সুনামগঞ্জে, সে সময় ঠিকাদারি প্রথার সমালোচনা হয় এবং আমরা যারা হাওর রক্ষাকর্মী আছি বা বিভিন্ন লেভেলে যারা আছেন, ঠিকাদারি প্রথা বাতিল করতে বলার পরিপ্রেক্ষিতে প্রথা বাতিল হয়। ২০১৭ সালে পরিপ্রেক্ষিতে কাবিটা নীতি সংস্কার করে বর্তমানের পিআইসি প্রথা শুরু হয়।

আমি একটু সংক্ষেপে বছরের পরিস্থিতি বলছি। বছরে এখনো সব স্লিপ চূড়ান্ত হয়নি। ১০ জানুয়ারি জেলা কমিটির মিটিং ছিল। সেখানে কথা হচ্ছিল অনেক অপ্রয়োজনীয় বাঁধ সম্পর্কে। এগুলো রাখা প্রয়োজন কিনা ইত্যাদি। আবার বলা হয়েছিল সময় নেই, আর পেছানো যাবে না। সব প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি গঠিত হয়নি। পিআইসিগুলো এখনো শতভাগ গঠিত হয়নি। ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রকল্পগুলো গঠিত হওয়ার কথা ছিল। ৩০ নভেম্বরের মধ্যে পিআইসি হওয়ার কথা ছিল। ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শুরু হওয়ার কথা। অর্থাৎ আমরা এরই মধ্যে অনেক বিলম্ব করে ফেলেছি। ফসল কাটতে বিলম্ব হতে পারে, বাড়তে পারে ঝুঁকি। বছর দেরিতে পানি নামার কারণে ফসল দেরিতে রোপণ করা হয়েছে। ফলে ফসল কাটতেও দেরি এবং ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে।

অন্যদিকে দেখতে পাচ্ছি অকাল বন্যা দিন দিন এগিয়ে আসছে। আগে এপ্রিলে বন্যা হতো, ২০১৭ সালে মার্চের শেষ দিকে হয়েছিল। একদিকে বন্যার সময় এগিয়ে আসছে, অন্যদিকে আমরা ফসল দেরিতে রোপণ করছি। আবার নীতিমালা অনুসারে সব পিআইসি হয়নি। পিআইসি গঠনে নানা সমস্যা রয়েছে। নিয়ম মেনে গণশুনানি হয়নি। কমিটির চার-পাঁচজনের প্রভাব এখানে খাটে। এর বাইরে অর্থের বিনিময়ে কমিটিতে ঢুকতে চাওয়ার অভিযোগ আছে। গতবারও পেয়েছি, এবারো পাচ্ছি।

সময়মতো কোনো বছরই কাজ হয় না। কাজ হলেও নিয়মমতো ঢাল বজায় রাখা হয় না।

বাঁধের সঙ্গে পরিবেশের একটি সম্পর্ক আছে, কেননা যেখানে-সেখানে বাঁধ দিলে পানিপ্রবাহ বাধা পায়। বাঁধের উচ্চতাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এমনকি বাঁধের মাটি ক্ষয়ে গিয়ে নদীতেই পড়ে নদীর নাব্যতা কমে যায়। পানিপ্রবাহ বাধা পেলে জীববৈচিত্র্য নষ্ট হয়। অনেক জায়গায় বাঁধের জন্য মাটি পাওয়া যায় না। ভবিষ্যতে সংকট আরো গভীর হবে। তাই আমাদের বাঁধের বিকল্প চিন্তা করা প্রয়োজন। যেমন বলা হচ্ছে নদীখনন হলো বাঁধের বিকল্প।

আমি এবার সরাসরি সুপারিশে যাচ্ছি। সরকারিভাবে উজান ভাটিতে ব্যাপকভাবে নদীখনন করা যেতে পারে। নদী শুধু হাওরে খনন করলে হবে না। বিশেষত ভৈরবের এখানে অনেক ব্রিজ থাকার কারণে নাব্যতা সংকট হচ্ছে। কিছু জায়গায় স্লুইসগেট, কালভার্ট তৈরি করা যেতে পারে। যেসব অনিয়ম দুর্নীতি হয় তা নিরসন প্রয়োজন। সময়মতো এবং সঠিকভাবে বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারও প্রয়োজন।

বাঁধের কাজ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখলে এবং জবাবদিহিতা থাকলে ভালো হবে। ফসল সংরক্ষণের উপায়ও চিন্তা করতে হবে। আমরা জানি কৃষক ন্যায্যমূল্য পায় না। আবার সরকার নানা পদক্ষেপ নিলেও কৃষক জানে না তার অধিকার কতখানি। কৃষকদের অধিকার সচেতন করার ক্ষেত্রে বেসরকারি সংগঠন পদক্ষেপ নিতে পারে। পাশাপাশি তারা বাঁধ নির্মাণ মনিটরিং টিম গঠন করে সামাজিকভাবে সরকারের সহায়তায় কাজ করতে পারে। স্থানীয় সামাজিক, যুব সংগঠন সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে পারে। একটা নেটওয়ার্ক তৈরির মাধ্যমে কাজ আরো ভালোভাবে করা সম্ভব।


রওশন জাহান মনি
উপনির্বাহী পরিচালক
এএলআরডি

আমাদের সংসদীয় আসনের ৩৬টি আসন হাওরের সাতটি জেলার অধীন, যার মধ্যে ১৭টি সুনামগঞ্জে। এটা অভ্যন্তরীণ বিষয়, কিন্তু এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক সীমারও একটি বিষয় রয়েছে। যেমন এটি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মেঘালয়ের পাদদেশে অবস্থিত এবং সেখানকার কেবল পানি বণ্টন চুক্তি না, পুরো ব্যবস্থার একটি সামগ্রিক আলোচনা হওয়া প্রয়োজন।

হাওরের সম্পদ সম্পর্কে বলতে গেলে জলজ সম্পদ এবং ফসলের কথাই মনে হয়, কিন্তু এর বাইরে আরো যে প্রাণিসম্পদ আছে তা- কম নয়। হাওরে যেমন আয় হয়, তেমনি দুর্যোগও হয়। ২০১৭ সালে সেটা সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে। প্রথমত আগাম বন্যা এর কারণ, যেটা এখন প্রাকৃতিক কারণে ঘন ঘন হচ্ছে এবং বাঁধের অব্যবস্থাপনার কারণে তা মারাত্মক আকার ধারণ করছে। যেমন আমরা দেখেছি, যখন বাঁধ নিয়ে কথা হচ্ছে তখন হাওর থেকে কৃষকের ফোন আসছে ভাঙা বাঁধ কীভাবে মেরামত করা যাবে? পরবর্তী সময় সরকারের সময়েই তাদের সদিচ্ছার কারণে বাঁধ নির্মাণে নীতিমালা প্রণয়ন ইত্যাদির মাধ্যমে পিআইসি দ্বারা সংকটটি এড়ানো গেছে।

এখানে আমরা ক্ষয়ক্ষতির একটি পরিসংখ্যানের সঙ্গে নানা আর্থসামাজিক পরিবর্তন লক্ষ করছি। গ্রাম থেকে শহরে আসার পরিমাণ বেড়ে গিয়েছিল। নারী কিশোরীরা গার্মেন্টসে কাজ করার জন্য চলে এসেছিল। সে সময়ে যাতায়াতের জন্য অনেক নাইট কোচ পর্যন্ত চালু হয়েছিল এবং বলা হচ্ছিল হাওরে বেঁচে থাকার শেষ উপায়টুকুও তাদের আর নেই। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে তার প্রভাব শিক্ষার ওপর পড়েছে। ছেলে শিশুরা শিক্ষার বদলে কাজের দিকে বেশি চলে যায়। সেখানকার শিক্ষকরা বলেছেন, এখানে ৭০ ভাগ নারীরা স্কুলে যায় আর ছেলেরা ৩০ ভাগ।

হাওরের ফসল আমাদের দেশের খাদ্য চাহিদার জোগান দেয়। হাওরের আয় আমাদের জিডিপির অংশ। কিন্তু সময়ে এসে অঞ্চলটা সরকারের ওপর চাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যার কারণে ব্যাপক ত্রাণ কাজ হয়েছে। সেখানেও দুর্নীতি বা অব্যবস্থাপনা হয়নি এমন নয়। পুরো কাঠামোতেই একটা পরিবর্তন চলে এসেছিল এবং পুরোপুরি একটা নির্ভরতা চলে এল। এখন বাঁধ ফসল উৎপাদনকে আমরা যদি একটু ভিন্নভাবে দেখতে পারি, তাহলে হয়তো দুরবস্থা বার বার ঘুরে-ফিরে আসবে না।

হাওরের জলাশয় এবং মত্স্য সম্পদ রক্ষার ক্ষেত্রে কিছু নীতিমালা প্রয়োজন। যেমন এখানে লিজ নেয়ার জন্য যে অর্থ প্রয়োজন অনেক জেলে সংগঠন তা দিতে পারে না। এটা ভিন্নভাবে লোন আকারে তাদের দেয়া যেতে পারে। অনেক প্রভাবশালী লোক এখানে সংগঠন তৈরি করে ইজারা নিচ্ছেন। ফলে একটা দুষ্টচক্র এখানে চলতে থাকে, যা থেকে দরিদ্র জনগোষ্ঠী বেরোতে পারে না। তাই নীতিমালা সংশোধন বা লিজ প্রদানের ক্ষেত্রে প্রকৃত জেলেদের সহায়তা করার বিষয়ে মনোযোগ দেয়া যেতে পারে।

প্রকৃত জেলের কাছে না গেলে আরেকটি যে সমস্যা হয়, যারা ইজারা নেন তারা হাওর সেচে ফেলে অনেক প্রজাতি নষ্ট করে ফেলেন। প্রতি বছর এমন হচ্ছে। প্রকৃত মত্স্যজীবীরা একটি নির্দিষ্ট গভীরতা পর্যন্ত মাছ আহরণ করেন, যেন পরের বছরও মাছ পাওয়া যায়। কিন্তু যারা কেবল ব্যবসার চিন্তা করেন, তারা মাছের বীজ রেখে মাছ আহরণের কথা চিন্তা করেন না। বিষয়ে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। বালি উত্তোলন এবং শ্যালো মেশিন ব্যবহারের কারণে পাড় ভেঙে যাচ্ছে। তা বন্ধ করতে হবে।

আরেকটি ভিন্ন বিষয় আমি এখানে আনববজ্রপাত। এখানে বজ্রপাতে অনেক কৃষক মারা যান। সাধারণ সমাধান হিসেবে গাছ লাগানোর কথা বলা হয়। জয়নাল আবেদিন নামে যে চেয়ারম্যানের কথা বলা হয়, তিনি কড়চ এবং শিমুলের যে বন তৈরি করেছিলেন তা এখনো ঢেউ বজ্রপাতের মোকাবেলা করে যাচ্ছে। এরপর তালগাছ লাগানোর কথা ছিল কিন্তু সেটা হচ্ছে না। এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের বিভিন্ন আলোচনায় বলা হয়েছে এটি সহজ উপায়। সামনে বজ্রপাতের সময় আসছে। আমি মাননীয় মন্ত্রীর কাছে বিষয়টি উত্থাপন করে রাখলাম।


মো. সিরাজুল ইসলাম
নির্বাহী পরিচালক, ইরা

দুজন বক্তার বক্তব্যই শুনলাম, তারা অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা বললেন। হাওরে মাটি কাটা হচ্ছে, টাকা ঢালা হচ্ছে, কিন্তু গবেষণা খুব বেশি হয়েছে বলে আমার মনে পড়ে না। যেমন বাঁধ, হাওরের জীববৈচিত্র্য। শুধু ধান না এখন অনেক কিছুই আছে হাওরে, যা থেকে রোজগার হয়, যেমন পশুসম্পদ। মাছের কথা সবাই জানেন। এখন প্রচুর পর্যটক যাচ্ছেন। মানুষের গমনাগমন অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। কিন্তু তাদের জন্য এখানে কোনো অবকাঠামো নেই। তারা বেশ কষ্ট করে যাচ্ছেন, সারা দিন থেকে আবার ফিরছেন। মাননীয় মন্ত্রী আমার চেয়ে অবশ্যই বেশি জানেন। তিনি জানেন পর্যটন সম্পর্কে কী ধরনের পদক্ষেপ নেবেন। ফসলের ক্ষেত্রে শুধু ধানের কথা না ভেবে ফসল বহুমুখীকরণের কথা চিন্তা করা যায়। শুধু মাটি কেটে আর বাঁধ দিয়ে হাওরের সমস্যা সমাধান করা যাবে বলে আমার মনে হয় না। যে ফসল এখানকার পরিবেশের উপযোগী তা নিয়ে আসা প্রয়োজন।

 




জান্নাত মরিয়ম
নির্বাহী পরিচালক বিআরটিএ, সুনামগঞ্জ

একটি বিষয় আমি তুলে ধরতে চাই যে হাওর অঞ্চলে পুরুষরা যেমন কৃষক, নারীরা তেমনি কৃষাণী। দেখা যায় বর্ষাকালে পুরুষদের কার্যক্রম কমে যায় আর নারীদের কাজও তেমনি কমে যায়। নারীদের কর্মসংস্থান করা প্রয়োজন। ধান সংরক্ষণের সময় আসে, তখন প্রকৃত কৃষকরা সে সুযোগ পান না। ধান কাটার সময় থেকে উৎপাদন খরচের পর তারা ন্যায্যমূল্যও পান না। এক্ষেত্রে প্রকৃত কৃষকরা যেন সুযোগ-সুবিধা পান, সেজন্য মাননীয় পরিকল্পনামন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

মত্স্যজীবীদের সম্পর্কে এরই মধ্যে বলা হয়েছে। জলমহালগুলো প্রকৃত মত্স্যজীবীরা পাচ্ছেন না। নেতৃস্থানীয়রা তা নিয়ে যাচ্ছেন। বাঁধগুলো যদি সময়মতো তৈরি করা হয় এবং বাঁধের কাছ থেকে মাটি না নেয়া হয়, তাহলে বাঁধ মজবুত হবে। পিআইসি সম্পর্কে একটু বলব যে তালিকা ডিসেম্বরে না করে জুন-জুলাইয়ে করে দেয়া হয়, তাহলে কাজের অগ্রগতি হওয়া সম্ভব। স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বাদে কাজের মানুষদের সেক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেয়া প্রয়োজন।

 



. ইনামুল হক
সাবেক মহাপরিচালক
পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা

সুনামগঞ্জে বন্যার যে সীমা, ওটা পরিবর্তন করা হয়েছে, তবে তা উপযুক্ত কিনা সেটা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। হাওরে আমার যে অভিজ্ঞতা, সেখান থেকে আমরা হাওর-পঞ্জিকা তৈরি করেছিলাম। পঞ্জিকায় উল্লেখ করা হয়েছে মাছ এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মাছের যে বাসস্থান, সেটা নানা কাজের জন্য নষ্ট হয়। মাছের অভয়াশ্রম প্রয়োজন। দেশে একসময় ব্রিটিশরা এটা করেছিল। আমাদের এখানে এখন দেখা যায় মানুষ বিল, জলাভূমি একদম শুকিয়ে ফেলে মাছের বাসস্থান নষ্ট করে। কিন্তু হওয়ার কথা খাস জমিতে। লিজের ক্ষেত্রে সব বিষয় বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন।

হাওর-পঞ্জিকা অনুসরণ করে যদি সঠিক সময়ে পিআইসি করা হয়, তাহলে বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এমনকি ধানের উৎপাদন সম্পর্কেও এখানে বলা আছে। কোন সময়ে কোন ধানের বীজ রোপণ করলে ভালো ফসল পাওয়া সম্ভবএমনকি স্থানীয় অনেক উচ্চফলনশীল জাতের কথা আছে। কিন্তু এখানে এখন হাইব্রিড জাতের অনেক ধান ফলাতে গিয়ে সেদিকে নজর দেয়া হচ্ছে না। এসব ধান চাষের কারণে দেখা যায় এপ্রিলের দিকে পাহাড়ি ঢলে তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মাছেরা তখন উজানে গিয়ে ডিম ছাড়ে। এর সঙ্গে বাঁধ কাটা, পরিযায়ী পাখির আগমন সবকিছু সমন্বয় করে কাজ করতে হবে।

আমরা হাওরের উন্নয়ন না বলে এখানকার মানুষের উন্নয়নের কথা বরং বলি। কেননা উন্নয়নের নামে অনেক কিছুই করা হয়, যাতে মানুষের ক্ষতি হয়। অবকাঠামোগত উন্নয়নের বাইরে মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্যের উন্নয়ন অবহেলিত। ধান ফসল উৎপাদনও ব্যাহত হবে। এগুলো দুশ্চিন্তার বিষয়। এসব নিয়ে ভাবনাচিন্তা করে আমরা উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যেতে পারি।


. নজরুল ইসলাম
অধ্যাপক
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

এখন পর্যন্ত আলোচনা দেখে মনে হচ্ছে সুনামগঞ্জ এবং ধান চাষবিশেষত বোরো ধান সম্পর্কেই বেশি মনোযোগ দেয়া হয়েছে। আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি ফ্ল্যাশ ফ্লাড কিংবা বোরোই কেবল সমস্যা নয় বরং আমন ধানের ক্ষেত্রেও সমস্যা হয়েছে। যেমন একজন কৃষকের জমিতে ২২ ধরনের ধান চাষ করা হয়েছিল, কিন্তু তা সংরক্ষণ সম্ভব হয়নি। সুতরাং কেবল বোরো নয়, আমনের ক্ষেত্রেও সমস্যা হচ্ছে। আসলে হাওর প্রকৃতির সৃষ্টি, কিন্তু আমরা সেই প্রাকৃতিক গতি নষ্ট করেছিকখনো ইচ্ছাকৃতভাবে, কখনো অনিচ্ছাকৃত। আমাদের নদী বা হাওরের এলাকাগুলো পলি পড়ে এত অগভীর হয়েছে যে পাহাড়ি ঢল ধারণ করার সক্ষমতা তার নেই। উন্নয়নশীল দেশের উন্নয়ন কর্মের ফলে সেখান থেকে যে পানি আসে তা আসবেই, যেমন নেপাল থেকে আগে পানি আসতে সময় লাগত পাঁচদিন এখন তা তিনদিনে চলে আসে। পরিপ্রেক্ষিতে আমার প্রস্তাব হলো সিলেট অঞ্চলের যে নদীগুলো পানিপ্রবাহের জন্য ব্যবহূত হয়, সেগুলো যদি ঠিক করতে পারি, তাহলে বিদ্যমান সমস্যার অনেকাংশে সমাধান হবে। পাশাপাশি খাল ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখলে সমস্যার সমাধান করা যায়।

২০১৭ সালের বন্যার পর বিশ্বব্যাংকের রিপোর্টেও পলি পড়ে নাব্যতা কমে যাওয়াকে দায়ী করেছে। সমস্যা দূর করার জন্য পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত না হওয়ার ব্যবস্থা কীভাবে করা যায় তা যদি ভাবা হয়, তাহলে সম্ভবত সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। প্রতি তিন বছর পর একটা বড় বন্যা হয়ে থাকে। এসব বন্যা দেখে একটা প্যাটার্ন দেখা গিয়েছিল যে ১৫ এপ্রিলের মধ্যে ধান তোলার চেষ্টা করলে ফসল তোলা যেত। কিন্তু এখন বন্যা এগিয়ে আসছে। এখন জমির কিছু অংশে যদি দেশী জাতের ধান চাষ করা যায়, তাহলে উপকৃত হওয়া সম্ভব।


সালেহীন চৌধুরী 
নির্বাহী পরিচালক, হাউস

হাওর মূলত কৃষক মত্স্যজীবীদের বাসস্থান। বাঁধ নির্মাণ এবং ব্যবস্থাপনা কৃষকদের হাতে দিতে হবে। বিদ্যমান ব্যবস্থায় অনেক ত্রুটি আছে, এসব ত্রুটি সংশোধন করে বাঁধ নির্মাণে কৃষকের কর্তৃত্ব রাখতে হবে। কৃষক যে ফসল ফলান, তা লাভজনক মূল্যে বিক্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। বিদ্যমান জলমহাল ব্যবস্থা অনুসারে জেলেদের প্রবেশাধিকার নেই। নীতিমালা সংশোধনের সময় এসেছে। স্বাধীনতার পর পাঁচবার তা সংশোধিত হয়েছে, এখন আবার তা প্রয়োজন। জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। এছাড়া হাওরের জন্য আলাদাভাবে হাওর উন্নয়ন ব্যাংক করা যেতে পারে।

 





শামসুল হুদা 
নির্বাহী পরিচালক
এএলআরডি

আলোচনায় যে সুপারিশগুলো এসেছে সেগুলো সম্পর্কে আমি একমত। পাশাপাশি বলব, হাওর, ফসল, বাঁধ নিয়ে আমাদের আলোচনা ঘুরে-ফিরে এর মধ্যে আসছে। এখানে জীববৈচিত্র্য আছে। হাওর কেবল হাওর অঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, সারা দেশই এর সঙ্গে যুক্ত। এখানকার জীববৈচিত্র্য নানাভাবে নষ্ট হয়েছে। সেটি রক্ষা করা প্রয়োজন।

আমাদের সরকার বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়েছে, তবে আমার মনে হয় জাতীয় পরিকল্পনার মধ্যে হাওর নিয়ে আলাদা করে একটি পরিকল্পনা প্রয়োজন। এখানে সবাই মোটামুটি বলেছেন হাওরের মানুষের অংশগ্রহণে এটা করা প্রয়োজন। আমার মনে হয় মাননীয় মন্ত্রী যদি এদিকে দৃষ্টি দেন, তার নেতৃত্বে পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন সম্ভব। মানুষের অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাদের অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, বঞ্চনা সবকিছু এখানে প্রতিফলিত হবে। হাওরের খাস জমির সঠিক বণ্টন প্রয়োজন। এছাড়া হাওরের মাছের চাহিদা কেবল দেশের ভেতরে না, বাইরেও আছে। হাওরের মাছের উৎপাদন কমে যাওয়া নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার। সীমান্তের ওপারের পানির দূষণ সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক গবেষণা দরকার। এরপর সরকার ওই দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা করবেন অবশ্যই।

হাওর একটি বিশেষ অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত হোক। হাওরের একটা আলাদা মন্ত্রণালয় করা যদি সম্ভব না- হয়, হাওর উন্নয়ন বোর্ড বা অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে নতুন করে সাজানো যেতে পারে। হাওরের মূল সমস্যাগুলো নিয়ে বিস্তৃত গবেষণার মাধ্যমে সেখানকার মানুষ, বিশেষত নারীদের সামনে আনা প্রয়োজন। এছাড়া প্রান্তিক মানুষদের কথা শুনতে হবে এবং তাদের সামনে নিয়ে আসতে হবে। ইজারা প্রথাকে সংশোধন করতে হবে, ইজারাদারদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করার ব্যবস্থাও প্রয়োজন। অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রয়োজন, যেমন রাস্তাঘাট হচ্ছে। অনেক পর্যটক আসছেন, তাদের জন্যও এটি প্রয়োজন। কিন্তু অবকাঠামো এমন না হোক, যাতে হাওর দূষিত হয়। দর্শনার্থীদের জন্যও কিছু নীতিমালা হওয়া প্রয়োজন।


এস এম শহিদুল ইসলাম
অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী
উত্তর-পূর্বাঞ্চল
পানি উন্নয়ন বোর্ড, সিলেট

হাওরের বাঁধ নির্মাণের জন্য এর মধ্যেই গণশুনানি করা এবং স্কিম নেয়া হয়েছে। পিআইসি হচ্ছে। সুনামগঞ্জে ৭৮৭টি পিআইসি হয়েছে এবং খরচ এসেছে ১২৬ কোটি টাকার মতো। এবার হাওরের পানি নামছে দেরিতে, কয়েকবার বন্যা হয়েছে। অক্টোবরে বন্যা হওয়ার কারণে এটা হচ্ছে। পানি দ্রুত নামাতে ড্রেজিং করতে হবে। প্রায় ৯০টি কজওয়ে রয়েছে। এগুলোর কাজ হয়ে গেলে দ্রুত পানি নেমে যাবে।

আমাদের ডিজাইনে আরএলের দশমিক মিটার বাঁধ নির্মাণ হচ্ছে। কিন্তু ২০১৭ সালের মতো বন্যা হলে তা ঠেকানো যাবে না। কারণ বাঁধে তা সম্ভব না। আমাদের কাজের অগ্রগতি হচ্ছে। পিআইসিগুলো সংসদ সদস্য উপজেলা চেয়ারম্যানদের সহায়তায় করা হচ্ছে। স্কিমগুলো আসতে দেরি হওয়ায় কাজে দেরি হচ্ছে। এদিকে পানি নামতে দেরি হওয়ার কারণে কাজ পিছিয়ে গেছে, কেননা বাঁধ বেরিয়ে না এলে, সার্ভে না করে স্কিম তৈরি করা যায় না। এজন্য জুলাইয়ে আসলে পিআইসি করা সম্ভব হয় না। আর পিআইসিতে যারা অংশগ্রহণ করেন তা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের হাত দিয়েই হয়, এখানে আমাদের করণীয় কিছু নেই। তবে বলব অবশ্যই এখানে স্বচ্ছতা আসা প্রয়োজন। অপ্রয়োজনীয় কোনো বাঁধ আমরা তৈরি করছি না। কারণ এগুলো জলাবদ্ধতা সৃষ্টির সঙ্গে খরচও বাড়ায়। এখন আপাতত কজওয়েগুলো হয়ে গেলে পানি দ্রুত নেমে যাবে।

হাওরে আসলে বাঁধের বিকল্প কিছুই নেই। পাশাপাশি এখানে ঢালাই করে বা অন্য উপায়ে বাঁধ দেয়াও সম্ভব না। মাটির বাঁধই দিতে হবে। তবে ফসল বাঁচানোর জন্য আর্লি হারভেস্ট করা যায় এমন জাতের ধানের কথা চিন্তা করা যায়। আর আমরা আমাদের এখানকার কাজ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শেষ করার চেষ্টা করব।


এমএ মান্নান, এমপি
মন্ত্রী
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়

প্রথমেই বাঁধের প্রসঙ্গে আসি, আমাদের ধারণা আগে তো বাঁধ ছিল না। ২০০, ৩০০ বছর আগে তো এসব ছিল না। ছেলেবেলায় আমিও দেখেছি মাঝরাতে চিত্কার-চেঁচামেচি হতো যে পানি ঢুকে যাচ্ছে। তখন কোদাল-টুকরি নিয়ে সেসব বন্ধ করা হতো। আসলে বাঁধের প্রয়োজন ছিল না এমন না। আমাদের সুযোগ ছিল না। সময়ের সঙ্গে তো অনেক কিছুই বদলে গেছে। আমাদের জীবনযাত্রা থেকে অবকাঠামো পর্যন্ত। এখন বাঁধ একটি প্রয়োজনীয় বিষয়। সেটা কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি করা যায় আমরা সেটা ভাবব। বার্ষিক, দ্বিবার্ষিক কিংবা তিন বছরের প্রকল্প নিয়ে কাজ করা উচিত।

স্লুইসগেট সম্পর্কে কথা হলো, এটা নিয়ে আমাদের মধ্যে একটা উত্তেজনা কাজ করে। মনে হয় যে এটা খুব কার্যকর। কিন্তু আসলে তা নয়। বরিশালে আমি পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে কাজ করে দেখছি স্লুইসগেট কার্যকর হয় না। আমাদের পলিমাটির দেশে উপযুক্ত গবেষণা ছাড়া যেখানে-সেখানে স্লুইসগেট তৈরি কেবলই অর্থের অপচয়। এগুলো চালনা, নিয়ন্ত্রণ সঠিকরূপে হয় না।

পর্যটনের কথা এসেছে। এটি নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হচ্ছে। আমার মনে হয় এটা বেসরকারি পর্যায়ে গড়ে উঠবেস্টিমার, হোটেল বা যা- হোক। তবে সরকারের পক্ষ থেকে কিছু মৌলিক অবকাঠামো তৈরি করা হবেরাতারগুল, বিছনাকান্দি, টাঙ্গুয়ার হাওর আমরা পর্যটকদের টার্গেট করেই কাজ করব যেন ন্যূনতম একটা সভ্য ব্যবস্থা তৈরি করা যায়।

তবে যে বিষয়টা নিয়ে আমি গর্ববোধ করি, আমরা বিদ্যুতের ব্যবস্থা করেছি। এখন এখানে কাজ করা সহজ হয়েছে। এনজিও কাজ করুক, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কাজ করুক বা চিন্তকরা গবেষণা করুক, বিদ্যুতের সুবিধা তো প্রয়োজন হবে। সেটা আমরা নিশ্চিত করেছি। জলমহাল নিয়ে কথা এসেছে। ইজারাদারি প্রথাটা ভীষণ অন্যায় একটা প্রথা। কিন্তু জলমহাল ইজারা সরকারের নীতি এবং সরকারের অধীনে আমাকেও তা মানতে হয়। কিন্তু এখানে দেখা যায় বর্ষাকালে বিলের সীমানা থাকে না, কিন্তু পুরো বিলকে ইজারাদার নিজের বিল ঘোষণা করে দেয় এবং কোনো গরিব মানুষকে এখানে মাছ ধরতে দেয় না। লিজ নেয়া এলাকার তুলনায় কয়েক গুণ বিস্তৃত এলাকায় গায়ের জোরে কবজা করে। প্রথার বিরুদ্ধে আমি সক্রিয়ভাবেই আপনাদের সঙ্গে আছি। নদীখনন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। তার বিভিন্ন বক্তব্যেও এসেছে। আমাদের মূল নদীগুলোকে খনন করা, গভীর করা। সম্পর্কে বিশাল পরিকল্পনা আছে। ড্রেজিং সম্পর্কে আমরা অবগত এবং বিষয়ে কাজ হবে।

কৃষি বিষয়ে বেশি বলার সুযোগ নেই। মেকানাইজেশন সম্পর্কে একজন বলেছেন। বছর আমরা বিষয়ে কাজে নেমেছি। নীতি সহায়তা, ক্রেডিট সহায়তা ভর্তুকি সহায়তা নিয়ে এসেছি। ভর্তুকির নামে বাংলাদেশে এমন সব ভর্তুকি দেয়া হয়, সেসবের তুলনায় এখানে ভর্তুকি বেশি জরুরি। আমাদের সনাতন যে পদ্ধতি, সে পদ্ধতির সর্বোচ্চ ব্যবহার হয়েছে। এখন যন্ত্রের সহায়তা নেয়া হবে। সেখানে সম্ভাবনা আছে। আমাদের সরকার পুরোদমে নেমেছে। সামনের বছর আরো কাজ হবে।

আমাদের বাংলাদেশে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে উন্নয়ন মানেই নির্মাণ। কিন্তু উন্নয়ন আসলে নির্মাণ না। আর হাওর এলাকায় নির্মাণের ক্ষেত্রে আমাদের অত্যন্ত মনোযোগী হতে হবে। এখানে ধাতব বা কংক্রিট ব্যবহার করে পানিপ্রবাহ, জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করা যাবে না। জীববৈচিত্র্য ঠিক রেখে, পানিপ্রবাহ ঠিক রেখে, রাস্তা কোনমুখী হবে, সেসব নির্ধারণ করে কাজগুলো করতে হবে। এগুলো মাথায় রেখে কাজগুলো করলে হাওরের উন্নতি করা সম্ভব।

মো. মাশুক মিয়া

মহাপরিচালক, বাংলাদেশ হাওর জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তর

হাওরে প্রায় দুই কোটি মানুষের বসবাস। আমাদের মত্স্য সম্পদের ২০ ভাগ আসে হাওর থেকে। প্রেক্ষাপটে আমাদের মন্ত্রী মহোদয়ের তত্ত্বাবধানে ২০১২ সালে হাওর সম্পর্কিত সমন্বিত বিষয়ে একটি মাস্টারপ্ল্যান নেয়া হয়। সেই প্ল্যান অনুসরণ করে হাওরের অনেক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। প্ল্যানে ১৭টি সেক্টরের অধীনে ১৫৪টি উপসেক্টর চিহ্নিত করা হয়, যার মধ্যে ১১০টিতে বর্তমানে কাজ চলমান।

তবে আমাদের কিছু অভাব রয়েছে, যেমন জনবল, বিধিমালায় কিছু সমস্যা রয়েছে। দৈনিক মজুরিতে এবং ডেপুটেশনে কিছু কাজ করানো হচ্ছে। তবে সীমাবদ্ধতার মধ্যেও হাওর উন্নয়ন অধিদপ্তর বেশকিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। সারা দেশের ওয়েট ল্যান্ডের ইনভেন্টরি ক্ল্যাসিফিকেশন করা হয়েছে। সিলেট বেসিনের হাইড্রোমটোলজির স্টাডি হয়েছে এবং এর মাধ্যমে এখানকার নদীগুলোর গতি-প্রকৃতি আমরা জেনেছি। অবকাঠামো তৈরি কারণে হাওরের জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে এগুলো যেন না হয়, সেজন্য আমরা আমাদের গবেষণার আলোকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিষয়গুলো অবগত করেছি। যেমন হাওর এলাকায় পূর্ব-পশ্চিমে রাস্তা করা যায় না। এতে পানির মাছের গতিপথ বিঘ্নিত হয়। এখানে কিছু করতে হলে কজওয়ে বা উড়াল সেতু করতে হবে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ব্যতীত ছয়টি জেলায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিয়ে গবেষণা হয়েছে, যেন কোনো কাজের কারণে স্তর আরো নিচে নেমে না যায়। এক্ষেত্রে বৃষ্টির পানি ধরে রেখে ব্যবহার করা বা এমন কিছু করা যায়, যেন ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা কমে। আমরা স্যাটেলাইট ইমেজের সাহায্যে পুকুর এমনকি টাঙ্গুয়ার হাওরে সমীক্ষা চালিয়েছি।

আমাদের সুনামগঞ্জের ৫৪টি নদীর উৎস উজানে এবং পানির সঙ্গে পলি আসবেই। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ব্যাপারে সতর্ক। নদী খাল খননের জন্য প্রকল্প নেয়া হচ্ছে এবং কাজ চলমান।

অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় আমরা ১০টা নির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়েছিলাম। যেখানে সমন্বিত গবেষণার জন্য ট্রেনিং ইনস্টিটিউট করার কথা বলা হয়েছিল। আমার গ্রাম, আমার শহর অনুসারে একটা পরিকল্পনা নেয়া যায়, যেটা সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারেও ছিল। পরিকল্পনা অনুসারে একেকটি গ্রামের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন ইত্যাদি সমন্বিতভাবে কাজ করলে তা অনেক বেশি কার্যকরী হবে। এটি আসলে হাওর উন্নয়ন অধিদপ্তরের দ্বারা সম্ভব না। কেননা এতটা আমাদের এখতিয়ারে নেই। এলজিইডির পক্ষেই সম্ভব এবং তারা এটা মাথায় রেখে পরিকল্পনা নেয়ার কথা ভাবতে পারে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন