মোবাইল ইন্টারনেট

ব্যান্ডউইডথের দাম কমলেও সেবার মান বাড়েনি

নিজস্ব প্রতিবেদক

সরকার গত এক দশকে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইডথের দাম কমিয়েছে প্রায় শতভাগ। তার পরেও সেলফোন অপারেটরদের কাছ থেকে এ সেবা সুলভ মূল্যে পাচ্ছেন না গ্রাহকরা। বিস্তর অভিযোগ রয়েছে মোবাইল ইন্টারনেটের গতি নিয়েও। খাতসংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার পরিসংখ্যানেও বিষয়টি উঠে এসেছে।


চাহিদা বাড়ায় সরকার গত এক দশকে ব্যান্ডউইডথের দাম ব্যাপক হারে কমিয়েছে। ২০০৮ সালে দেশে প্রতি এমবিপিএস ব্যান্ডউইডথের দাম ছিল ৭২ হাজার টাকা, যা এখন ২৮৫ টাকায় নেমে এসেছে। কিন্তু এখনো বাংলাদেশে এ সেবার মূল্য প্রতিবেশী অনেক দেশের চেয়ে বেশি। 


খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডাটাভিত্তিক সেবার মূল অনুষঙ্গ ইন্টারনেট ব্যান্ডউইডথ। তরঙ্গ বরাদ্দ নিয়ে নিজেদের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে এটি গ্রাহক পর্যায়ে পৌঁছে দিচ্ছে তারা। তবে সরকার ব্যান্ডউইডথের মূল্য যেভাবে কমিয়েছে, সে অনুযায়ী গ্রাহকের কাছে সুলভ হয়নি সেবাটি। যদিও অপারেটরদের দাবি, ডাটা সেবার মূল্য আগের তুলনায় কমিয়েছে তারা। তবে উচ্চ মূল্যে তরঙ্গ কিনতে হওয়ায় ব্যান্ডউইডথের মূল্য কমানোর প্রভাব সেভাবে পড়ছে না। ডাটা সেবাদানের ক্ষেত্রে ৯৫ শতাংশের বেশি চলে যায় পরিচালন ব্যয়ে। আর বাকিটুকু ব্যান্ডউইডথের ব্যয় বলে জানিয়েছে তারা।


বড় বিনিয়োগে তরঙ্গ কেনার কথা বলা হলেও গ্রাহকসংখ্যার বিপরীতে বরাদ্দ নেয়া তরঙ্গও বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় কম শীর্ষ তিন অপারেটরের। প্রতি মেগাহার্টজ তরঙ্গের গ্রামীণফোনের বিপরীতে সাড়ে ২০ লাখ, রবির সাড়ে ১৩ লাখ ও বাংলালিংকের সাড়ে ১১ লাখ গ্রাহককে সেবা দিতে হচ্ছে। তবে সম্প্রতি নিলামে তিন অপারেটর তরঙ্গ কিনেছে। যদিও এখনো গ্রাহকসংখ্যার বিবেচনায় এ তরঙ্গ অপ্রতুল বলছেন বিশেষজ্ঞরা।


ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বণিক বার্তাকে বলেন, ব্যান্ডউইডথের দাম যেভাবে কমানো হয়েছে, গ্রাহক পর্যায়ে সেভাবে তার সুফল পৌঁছেনি। অপারেটরররা ট্রান্সমিশনসহ পরিচালন ব্যয়ের কারণে সেবাটির দাম কমানো যাচ্ছে না বলে জানিয়েছে। তবে তাদের এ দাবি পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য নয়। সেবার মান নিয়ে অপারেটররা কখনই সেভাবে গুরুত্ব দেয়নি। এ বিষয়ে ন্যূনতম প্রস্তুতিও ছিল না তাদের। থাকলে এখন এ অবস্থা তৈরি হতো না। সম্প্রতি তরঙ্গ কিনেছে তারা। এতে সেবার মান বাড়বে বলে মনে করছেন মন্ত্রী।


বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ডাটাভিত্তিক সেবার মূল্যসম্পর্কিত তথ্য বিশ্লেষণ করে যুক্তরাজ্যের প্রতিষ্ঠান কেবল ডট কো ডট ইউকে। প্রতিষ্ঠানটির তথ্য মতে, বাংলাদেশে ৩০ দিন মেয়াদি ১ গিগাবাইট ইন্টারনেট ডাটার মূল্য গড়ে ৭০ সেন্ট (ডলারপ্রতি ৮৪ দশমিক ৮ টাকা হিসেবে বাংলাদেশী মুদ্রায় ৫৯ টাকা ৩৬ পয়সা)। অন্যদিকে প্রতিবেশী ভারত ডাটা সেবা দিচ্ছে বিশ্বে সবচেয়ে সুলভে। দেশটিতে একই পরিমাণের ডাটার গড় মূল্য মাত্র ৯ সেন্ট। 


দামে বেশি হলেও বাংলাদেশে মোবাইল ইন্টারনেট সেবার গতি ও মান এখনো বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে অনেক পিছিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ডাটা সেবার গতি পরিমাপক সংস্থা ওকলার তথ্যমতে, বিশ্বের ১৪০টি দেশের মধ্যে গতি বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৬তম। গত বছরের জানুয়ারিতে ১৩১তম অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে শুধু আফগানিস্তান। মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলংকায় মোবাইল ইন্টারনেটের গতি বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে অনেক বেশি। ভারতে সেবাটির গতি বৈশ্বিক গড়ের কাছাকাছি।


ওকলার তথ্য বলছে, জানুয়ারিতে দেশে মোবাইল ইন্টারনেটের গড় গতি ছিল ১০ দশমিক ৫৭ মেগাবিটস পার সেকেন্ড (এমবিপিএস)। এ সময় সেবাটির বৈশ্বিক গড় গতি ১২ দশমিক ৪৯ এমবিপিএস ছিল। প্রতিষ্ঠানটির বিশ্লেষণ অনুযায়ী, গত এক বছরে দেশে ডাটা সেবার গড় ডাউনলোড গতি কমেছে। গত বছরের জানুয়ারিতে গড় ডাউনলোড গতি যেখানে ১১ দশমিক শূন্য ৬ এমবিপিএস ছিল, তা চলতি বছরের জানুয়ারিতে কমে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৫৭ এমবিপিএসে।


তবে অপারেটররা বলছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্ধারিত মানদণ্ডের চেয়ে বেশি গতিতেই সেবা দিচ্ছে তারা। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) নির্ধারিত মানদণ্ড অনুযায়ী, ফোরজির ক্ষেত্রে ন্যূনতম ডাউনলোড গতি ৭ এমবিপিএস, থ্রিজির ২ এমবিপিএস ও টুজির ন্যূনতম ডাউনলোড গতি ১৬০ কিলোবিটস পার সেকেন্ড (কেবিপিএস)।


এদিকে, সেলফোন অপারেটরদের সেবার মান নিয়ে সাতটি মানদণ্ডে গ্রাহকসেবার বিষয়টি তুলে ধরেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক পর্যবেক্ষণ প্রতিষ্ঠান ওপেন সিগন্যাল। ভিডিও, গেমস, ভয়েস অ্যাপ, ডাউনলোড গতি, আপলোড গতি, ফোরজি সেবার প্রাপ্যতা ও ফোরজি নেটওয়ার্ক এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট অপারেটরের সেবা ব্যবহারে গ্রাহকের অভিজ্ঞতা পরিমাপ করা হয়েছে। ভিডিও সেবার দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে বাংলালিংক। অপারেটরটির স্কোর ৫৯ দশমিক ৪। এরপর গ্রামীণফোন, এয়ারটেল ও রবি। রবি আজিয়াটার ব্র্যান্ড হলেও এয়ারটেলকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করেছে ওপেন সিগন্যাল। 


ফোরজি সেবার প্রাপ্যতার দিক থেকে সর্বোচ্চ স্কোর এয়ারটেলের। এর পরের স্থানে রয়েছে রবি, গ্রামীণফোন ও বাংলালিংক। আর ফোরজি নেটওয়ার্কের ক্ষেত্রে এগিয়ে গ্রামীণফোন। রবি ও এয়ারটেল যৌথভাবে দ্বিতীয় স্থানে। বাংলালিংক এক্ষেত্রে সবার শেষে। তবে গেমস অভিজ্ঞতায় শীর্ষে রয়েছে অপারেটরটি। বাংলালিংকের স্কোর ১০০-এর মধ্যে ৪৮ দশমিক ৬। এক্ষেত্রে দ্বিতীয় অবস্থানে এয়ারটেল। সামগ্রিকভাবে গেমস এক্সপেরিয়েন্স ক্যাটাগরিতে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অপারেটরগুলোর অবস্থান অনেকখানিই পিছিয়ে। 


ওপেন সিগন্যালের তথ্য বলছে, ডাউনলোড গতি অভিজ্ঞতা ক্যাটাগরিতে এ সময়ে শীর্ষে থাকা বাংলালিংকের ডাউনলোড গতি ছিল ৯ দশমিক ১ এমবিপিএস। এছাড়া গ্রামীণফোনের ডাউনলোড গতি ছিল ৭ দশমিক ৮ এমবিপিএস, এয়ারটেলের ৭ দশমিক ৫ ও রবির ৭ দশমিক ৪ এমবিপিএস। 


বাংলালিংকের হেড অব করপোরেট কমিউনিকেশনস অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি আংকিত সুরেকা বলেন, ওকলার সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলালিংকের গড় ডাউনলোড ও আপলোড স্পিড ছিল যথাক্রমে ১২ দশমিক ১৮ এমবিপিএস ও ৬ দশমিক ৫১ এমবিপিএস। সার্বিকভাবে ইন্টারনেটের গতিতে এগিয়ে থাকায় ওই বছরের প্রথমার্ধে বাংলালিংককে দেশের সবচেয়ে দ্রুতগতির মোবাইল নেটওয়ার্কের স্বীকৃতি দেয় ওকলা। নতুন তরঙ্গ বরাদ্দ নিয়ে বাংলালিংক ভবিষ্যতে আরো দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা দিতে পারবে।


তিনি জানান, বাংলালিংকের গ্রাহকরা এখন আগের তুলনায় সাশ্রয়ী মূল্যে ডাটা প্যাক কিনতে পারছেন। চাহিদার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আমরা স্বল্প মূল্যে বেশি ডাটা ব্যবহারের সুযোগ দেয়ার চেষ্টা করছি।


অন্যদিকে ডাউনলোড গতি ভালো হলেও আপলোডের গতি নিয়ে অভিযোগ রয়েছে গ্রাহকদের। তারা বলছেন, ডাউনলোডে তুলনামূলক উচ্চগতি পাওয়া যায়। তবে আপলোডের গতি কম পাওয়া যায় বেশির ভাগ অপারেটরেরই। এতে যাদের আপলোডের প্রয়োজন হয়, তারা মানসম্পন্ন সেবা পান না। 


গ্রামীণফোনের হেড অব এক্সটার্নাল কমিউনিকেশন মুহাম্মদ হাসান জানান, আপলোড ও ডাউনলোড গতির সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় সংশ্লিষ্ট। এর মধ্যে ডিভাইস, সিম, গ্রাহকের অবস্থান ও ওই এলাকায় গ্রাহকসংখ্যাসহ অন্যান্য বিষয় যুক্ত রয়েছে। নেটওয়ার্ক আপলোড ও ডাউনলোডের গতি সীমিত করে না। ফোরজি চালুর পর থেকে গ্রামীণফোন ডাটাভিত্তিক সেবার মূল্য ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়েছে বলে জানান তিনি।


সেলফোন সেবার গ্রাহক শাকিল আল আজাদ সম্প্রতি ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগে সেবার মান নিয়ে অভিযোগ জানিয়েছেন। তিনি বলেন, নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণে কলড্রপ ছাড়াও ইন্টারনেট সেবা বিঘ্নিত হচ্ছে। এজন্য অনলাইন ক্লাস করা সম্ভব হয়নি। অপারেটরকে জানানো হলেও বিষয়টির সমাধান পাওয়া যায়নি।


গ্রাহকের অভিযোগের বিষয়ে বিটিআরসি চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদার বলেন, সেবার মান নিয়ে গ্রাহকের বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। গত বছরের মার্চ থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত ১১ মাসে সাড়ে ৫ লাখের বেশি অভিযোগ জমা পড়ে কমিশনে।


দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সিংহভাগই মূলত সেলফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। বিটিআরসির তথ্যানুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে ইন্টারনেট সেবার সংযোগ ১১ কোটি ১৮ লাখ ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে সেলফোন অপারেটরের ইন্টারনেট সংযোগ ১০ কোটি ২৩ লাখের বেশি। আর ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (আইএসপি) ও পাবলিক সুইচড টেলিফোন নেটওয়ার্ক (পিএসটিএন) অপারেটরদের ৯৫ লাখ ২২ হাজার।


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন