সুশাসন নিয়ে ব্যবসায়ী সমাজের মানসিকতা আগের মতো নেই

আগামী এপ্রিল অনুষ্ঠিত হবে পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর নির্বাচন। ২০২১-২৩ মেয়াদের ওই নির্বাচনে অংশ নেবে নির্বাচনী জোট সম্মিলিত পরিষদ। জোটটির প্যানেল লিডার হিসেবে লড়ছেন বিজিএমইএ সাবেক সহসভাপতি জায়ান্ট গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক হাসান সম্প্রতি তিনি আসন্ন নির্বাচন কভিডজনিত পরিবর্তিত বিশ্বে পোশাক শিল্পের অগ্রযাত্রা নিয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে একান্ত আলোচনায় অংশ নেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বদরুল আলম

কভিডজনিত পরিবর্তিত বিশ্বে পোশাক খাত কীভাবে এগোবে?

কভিডের প্রভাব সারা বিশ্বে পড়েছে। আমাদের মূল বাজার ইউরোপ-আমেরিকার প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক, ওখানে ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। ফলে ক্রয় কম হচ্ছে। বাজারগুলোতে আমাদের রফতানিতেও এরই মধ্যে পতন ঘটেছে। সেখান থেকে বের হয়ে আসার জন্য, ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য নিরাপদ টেকসই সরবরাহ উৎস হিসেবে আমাদের দেশের ব্র্যান্ডিং করতে হবে। এজন্য রফতানি বাজারে বাংলাদেশের ইমেজ ফুটিয়ে তুলতে জনসংযোগ কার্যক্রমও গ্রহণ করার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি। ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার জন্য যুদ্ধ শেষ হলে যেমনটা হয়, ধ্বংসাবস্থা থেকে বের হয়ে আসার জন্য আমাদের সেই পুরনো গন্তব্যগুলোতে প্রচার কার্যক্রম শুরু করতে হবে। বাংলাদেশের পরিবেশবান্ধব কারখানা, কর্মপরিবেশ নিরাপত্তার দিক থেকে টেকসই কারখানাগুলো সম্পর্কে প্রধান রফতানি গন্তব্যগুলোতে প্রচার করতে হবে। ব্র্যান্ডিং করাটা আমাদের একটা বড় কাজ হবে। এছাড়া নতুন বাজার সম্ভাবনা উন্মোচনে পোশাক পণ্য প্রদর্শনীর আয়োজন করতে হবে। উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধির কর্মসূচিও গ্রহণ করা হবে। প্রচলিত পণ্য উৎপাদন থেকে ধীরে এবং পর্যায়ক্রমে আমরা উচ্চমূল্যের হাই-এন্ড পণ্য উৎপাদনের দিকে যাচ্ছি। আর সেই সক্ষমতা তৈরি হওয়ার জন্য আমাদের উদ্যোগ নিতে হবে। কীভাবে ক্রয়াদেশ সমঝোতা করতে হবে? কীভাবে ক্রেতাদের কাছে যেতে হবে? কীভাবে উপকরণ সংগ্রহ করতে হবে? বিষয়গুলো শেখাতে উদ্যোগ গ্রহণ করতে চাই আমরা।

হাই-এন্ড পণ্যে যাওয়ার জন্য আমাদের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প প্রস্তুত আছে?

আমি মনে করি হাই-এন্ড পণ্যে যাওয়ার জন্য আমাদের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প পুরোপুরি প্রস্তুত নয়। আমরা মিশ্র পদ্ধতিতে এগোব। কিছু পণ্য দেশের বাইরে থেকে আনব, কিছু পণ্য স্থানীয় পর্যায় থেকে সংগ্রহ করা হবে। এটাও বাস্তবতা যে কখনো শতভাগ কাঁচামাল দেশে তৈরি হবে না। এটা ধরে নিতেই হবে। কারণ আমাদের দেশে কৃত্রিম সুতা-কাপড় তৈরিতে প্রয়োজনীয় পেট্রোকেমিক্যাল উৎপাদন হয় না। আমাদের তুলার চাহিদার মাত্র শতাংশ দেশে উৎপাদন হয়, বাকি ৯৮ শতাংশই আমদানি করা হয়। কাঁচামাল তৈরির জন্য যে অবকাঠামো দরকার, যে বিনিয়োগ দরকার, সেটা আমাদের এখানে সম্ভব না। পর্যায়ক্রমে আমরা ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পও গড়ে তুলতে থাকব। এত বছরের জার্নিতে আমরা খারাপ করিনি, ভালোই করেছি। কারণ তুলা উৎপাদন না হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ অন্যতম বড় পোশাক রফতানিকারক দেশ।

এখন থেকে ৩০ বছর আগে পোশাকের মোট চাহিদার মাত্র ২৫ শতাংশ জুড়ে ছিল ম্যান মেড ফাইবার, ৭৫ শতাংশই কটনভিত্তিক পোশাক। গত ৩০ বছরে প্রবৃদ্ধি ছিল ম্যান মেড ফাইবারে, কটনের প্রবৃদ্ধি তেমন ছিল না। এখন বৈশ্বিক চাহিদার ৭৪ শতাংশ কিন্তু ম্যান মেড ফাইবারের, কটন নেমে এসেছে ২৬ শতাংশে। আমরা এখনো বেশির ভাগই কটন গার্মেন্টস করি। সব দিক থেকেই বর্তমানে বাংলাদেশ উইন উইন সিচুয়েশনে আছে। একদিকে ২৫ শতাংশ পণ্যের বাজারে আমাদের উৎপাদন সক্ষমতা বিশেষায়িত। ৭৫ শতাংশে এখনো বড় ধরনের সম্ভাবনা উন্মোচনের বাকি। ম্যান মেড ফাইবারের উৎপাদন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ হয় অনেক বড়। ধরনের বড় বিনিয়োগ প্রকল্প রাতারাতি হয় না। পর্যায়ক্রমে আমাদেরও হবে।

 

শিল্পের ৪০ বছরেও হাই-এন্ড পণ্যের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প গড়ে না ওঠার দায় কার?

এখানে উদ্যোক্তাদের দায়ী করা ঠিক হবে না। কটনভিত্তিক পোশাকের চাহিদার সঙ্গে আমরা দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছি। কৃত্রিম সুতা কাপড়ের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ভিন্ন উচ্চমাত্রার কারিগরি ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন পড়ে। যেমন পলিস্টারে রঙ টেকসই করতে উচ্চ তাপমাত্রার প্রয়োজন হয়। ধরনের কারিগরি ব্যবস্থা দ্রুত প্রণয়ন করা যায় না। সার্বিক প্রেক্ষাপট হাই-এন্ড পণ্যের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ অবকাঠামো দ্রুততার সঙ্গে উন্নয়ন করা যায়নি, যতটা গেছে কটনভিত্তিক মৌলিক পণ্যের ক্ষেত্রে। তবে শিল্পোদ্যোক্তা সরকারের দায়বদ্ধতা আছে, সে জায়গা থেকেই পর্যায়ক্রমে হাই-এন্ড পণ্যের প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ গড়ে তোলা হবে।

 

বিদ্যমান শিল্প কেন্দ্রীভবন পরিস্থিতিতে দেশের পরবর্তী ধাপের উন্নয়ন যাত্রা কেমন হতে পারে?

পোশাক খাতে অত্যধিক নির্ভরশীলতা আমাদের আছে এটা সত্য। কোনো অর্থনীতির জন্যই একক পণ্য নির্ভরশীলতা ভালো নয়। আমাদের ম্যান মেড ফাইবারভিত্তিক পোশাক উৎপাদনে সম্ভাবনা আছে। আবার পোশাকের মধ্যেই অনেক বৈচিত্র্যময় পণ্য উৎপাদন সম্ভাবনাও আছে। পোশাক এমন একটি খাত, যেটাকে ঘিরে অনেক ধরনের বিনিয়োগ সম্ভাবনা আছে। শ্রমঘন শিল্পের পাশাপাশি সেবাভিত্তিক খাত উন্নয়নেরও অনেক সুযোগ আছে। পোশাক খাতের সেবা নিশ্চিত করার প্রেক্ষাপটেই অনেক শিল্প উন্নয়ন করা সম্ভব। গুটিকয়েক পণ্যের মধ্যে উৎপাদন সীমিত রাখা থেকে আমরা এরই মধ্যে সরে এসেছি। আমি মনে করি, একদিকে আমাদের মৌলিক বৈচিত্র্যময় পণ্য উৎপাদনে মনোযোগী হতে হবে, সমান্তরালভাবে পোশাক পণ্যের বৈচিত্র্য বৃদ্ধিতেও মনোনিবেশ করতে হবে।

 

প্রতিযোগী দেশগুলো যতটা গতিশীল, তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমরা কী সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সক্ষম হব?

আমি মনে করি, সম্ভাবনা কাজে লাগানোর সুযোগ এখনো আমাদের আছে। অনেক কিছুই আমরা হয়তো দ্রুততার সঙ্গে করতে পারছি না, কিন্তু পথের মধ্যেই আছি। বন্দর থেকে শুরু করে সার্বিক অবকাঠামো সক্ষমতার বিচারে আমাদের যে গতি তা আরো বৃদ্ধি করতে সরকারের নীতি সহায়তা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। এটা নিশ্চিত হলে আমরা আরো দ্রুত এগোতে পারব।

 

পোশাক খাত এবং ব্যবসায়ী সমাজে সুশাসন পরিস্থিতি নিয়ে আপনার মত জানতে চাই

সুশাসন প্রেক্ষাপটে শিল্পোদ্যোক্তাদের মানসিকতা আগের চেয়ে অনেক বাস্তবসম্পন্ন। উদ্যোক্তারা ব্যবসার স্বার্থের পাশাপাশি দেশের স্বার্থ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বিষয়েও এখন সচেতন। আগে এক ধরনের ছিল, কিন্তু এখন শিল্পোদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ীদের মানসিকতা আগের মতো নেই। গোটা ব্যবসায়ী সমাজের মধ্যে বিশেষ করে পোশাক শিল্পে উদ্যোক্তাদের সুশাসন-সংক্রান্ত মানসিকতায় অনেক পরিবর্তন এসেছে।

 

ক্রয়াদেশ ধরতে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে পোশাক শিল্পোদ্যোক্তাদের ব্যবসায় নীতি চর্চায় সুশাসনের প্রতিফলন দেখতে পান?

বিষয়ে এখনো ঘাটতি থেকে গেছে উদ্যোক্তাদের। দরকষাকষির ক্ষমতা, সমঝোতার মতো বিষয়গুলোর সক্ষমতায় এখনো উদ্যোক্তাদের ঘাটতি আছে। অনেক বছর হয়ে গেলেও সার্বিকভাবে -সংক্রান্ত দক্ষতা প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় এখন উন্নত পর্যায়ের নয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ইমেজের দিক বিবেচনায় নিয়ে ক্রেতারা অনেক সময় সুবিধা আদায়ের সুযোগ নেন। বর্তমানে আমরা যে অবস্থানে আছি, আমাদের ক্রয়াদেশ সমঝোতা আরো অনেক শক্তিশালী থাকা দরকার। আগামীতে বিষয়গুলোয় আরো সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারব বলে আমরা মনে করি। বিষয়ে নীতি প্রণয়ন করতে চাই, যাতে করে সব দিক বিবেচনায় নিয়ে ক্রয়াদেশ গ্রহণ করতে পারে কারখানা কর্তৃপক্ষ। তাদের অনুধাবন করতে হবে, প্রাইস আন্ডার কাট করে টেকসই হওয়া যাবে না।

 

আসন্ন নির্বাচনে জয়ী হলে ক্ষুদ্র মাঝারি পোশাক শিল্পের উন্নয়ন নিয়ে নতুন কী ভাবছেন?

সর্বোচ্চ রফতানির পরিমাণ পুনরায় নির্ধারণ করতে চাই, যার মাধ্যমে অধিক প্রতিষ্ঠানকে প্রণোদনা সুবিধার আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হবে। আছে রিফাইন্যান্সিং স্কিমের আওতায় ঋণ সুবিধার ব্যবস্থা প্রণয়ন পরিকল্পনা। ব্যাংক থেকে কম সুদে ঋণের ব্যবস্থার পাশাপাশি মিরসরাই গার্মেন্টস ভিলেজ ইকোনমিক জোনগুলোতে জমি বরাদ্দের মাধ্যমে তা নিশ্চিত করাও আমাদের পরিকল্পনায় আছে।

 

শ্রমিকদের জন্য কী ভাবছেন?

অধিকাংশ ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্প-কারখানার নিজস্ব কোনো প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নেই। তাই শ্রমিকদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে জোনভিত্তিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন এবং চলমান বিজিএমইএর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোর আধুনিকায়ন করে শিল্পের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন মেয়াদের সময়োপযোগী প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করার পরিকল্পনা আছে।

 

শিল্প বিকাশে বিজিএমইএর ভূমিকা আরো সক্রিয় করার বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা আছে কি?

বিজিএমইএ অফিসে সদস্যদের সরব উপস্থিতি নিশ্চিত করে প্রতিষ্ঠানটির প্রাণচাঞ্চল্য যাতে ফিরিয়ে আনা যায়, সে বিষয়ে কাজ করব আমরা। জোনভিত্তিক নিয়মিত মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হবে। আগে গৃহীত ফলপ্রসূ উদ্যোগগুলোর ধারাবাহিকতা রক্ষার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। ওয়ান স্টপ বিজিএমইএ হটলাইন সেবা চালু করার পরিকল্পনা আছে। মেট্রোরেলের পরিকল্পনার সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে বিজিএমইএর উত্তরা ভবনের সঙ্গে ঢাকা, মিরপুর গাজীপুরের গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক স্থানগুলোর দ্রুততম যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হবে। বিজিএমইএর আরবিট্রেশন সেবাকে ডিজিটাল করা এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে সব বিচারাধীন কেসগুলোর নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা হবে।

 

আন্তর্জাতিক বাজারে শুল্ক সুবিধা ধরে রাখা আরো কার্যকর সুবিধা আদায় নিয়ে নতুন পদক্ষেপ দেখা যাবে?

সরকার ইইউর সঙ্গে কার্যকর আলোচনার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। যেন এলডিসি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হলেও পরবর্তী সাত থেকে আট বছরে শুল্কমুক্ত পণ্য রফতানি সুবিধা অর্জন করা সম্ভব হয়। এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পর ইইউতে আমাদের পোশাকের শুল্কমুক্ত রফতানি সুবিধা অব্যাহত রাখতে বিজিএমইএ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে যৌথ টাস্কফোর্স গঠন করার উদ্যোগ নেয়া হবে। টাস্কফোর্স প্রয়োজনীয় ধাপগুলো সম্পাদনের পাশাপাশি অ্যাপারেল ডিপ্লোম্যাসির মাধ্যমে জিএসপি প্লাস সুবিধা নিশ্চিত করবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন