এম নুরুল ইসলাম ও শেগুফ্তা বখ্ত চৌধুরী

তারা গড়ে দিয়েছেন

হাছান আদনান

স্বাধীনতার পর দেশের ব্যাংক খাত শুরু হয়েছিল দায়ক্লিষ্ট, সম্পদবিহীন জরাজীর্ণ ব্যবস্থার উত্তরাধিকার নিয়ে। এমন একটি বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে টেনে তোলার চ্যালেঞ্জ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক গঠন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। স্বাধীনতার আগমুহূর্তে ১৯৭১ সালের মার্চে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাংকগুলোয় জমা ছিল মাত্র ২৭৫ কোটি টাকার আমানত। কালপরিক্রমায় স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে প্রায় ১৫ লাখ কোটি টাকার একটি ব্যাংকিং খাত তৈরি হয়েছে বাংলাদেশে। দেশের ব্যাংক ব্যবস্থার অভিভাবক হিসেবে অগ্রযাত্রায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

৫০ বছরের পথপরিক্রমায় নানা চড়াই-উতরাই পেরোতে হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বিভিন্ন সময়ে গভর্নররা নানা ধরনের ভূমিকা রেখেছেন। তবে এক্ষেত্রে দুজনকে বিশেষভাবে স্মরণ করে থাকেন খাতসংশ্লিষ্টরা। তারা হলেন এম নুরুল ইসলাম শেগুফ্তা বখ্ত চৌধুরী। তাদের অবদান প্রত্যক্ষকারীরা বলছেন, পেশাগত সততার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপনের মাধ্যমে তারা দেশের ব্যাংক ব্যবস্থার উন্নয়নে স্মরণীয় ভূমিকা রেখেছেন।

এম নুরুল ইসলাম গভর্নর পদে দায়িত্ব পালন করেছেন ১৯৭৬ সালের ১৩ জুলাই থেকে ১৯৮৭ সালের ১২ এপ্রিল পর্যন্ত। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালনের রেকর্ডটি তার। আর্থিক খাতের নীতিনির্ধারক হিসেবে দেশে পোশাক শিল্পের বিকাশেও বড় ভূমিকা রেখেছেন তিনি।

অন্যদিকে শেগুফ্তা বখ্ত চৌধুরী গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ১৯৮৭ সালের ১২ এপ্রিল থেকে ১৯৯২ সালের ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা নির্ধারণ, -সংক্রান্ত নীতি প্রণয়ন, সঞ্চিতি সংরক্ষণ এবং ঋণ আমানতে উদার সুদনীতি প্রণয়নের মাধ্যমে বাজার অর্থনীতির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তিনি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে হোক বা সরকারের আমলা হিসেবেআর্থিক খাতে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন দুজনেই। তাদের একেবারে কাছে থেকে দেখা মানুষগুলো বলছেন, দুজনেই ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই পেশাগত সততার মাধ্যমে দেশের আর্থিক খাতের রূপান্তরে বড় ভূমিকা রেখেছেন। তাদের মধ্যে শেগুফ্তা বখ্ত চৌধুরী জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।

গত ৫০ বছরে দেশের আর্থিক খাতের নীতিনির্ধারণী ভূমিকা পালন করে আসা ব্যক্তিরা বলছেন, একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের ব্যাংক খাতকে গড়ে তুলতে প্রয়োজন ছিল যোগ্য নেতৃত্বের। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে এম নুরুল ইসলাম শেগুফ্তা বখ্ত চৌধুরী সে দায়িত্ব ভালোভাবেই পালন করেছেন। ব্যাংক খাতের নীতি প্রণয়ন, বাস্তবায়ন, সংস্কারসহ সব মৌলিক বিষয়ের ভিত তৈরি হয়েছে দুই গভর্নরের হাতে। গভর্নর হিসেবে দায়িত্বের ১৬ বছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যে ভিত তারা তৈরি করেছেন, পরে তার ওপর ভর করেই বিকাশ ঘটেছে ব্যাংক খাতের।

এম নুরুল ইসলাম শেগুফ্তা বখ্ত চৌধুরীকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিয়োগ দেয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইদুজ্জামান। সে সময়ের স্মৃতিচারণ করে বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, এম নুরুল ইসলাম আমার থেকে পাঁচ বছরের জ্যেষ্ঠ ছিলেন। ১৯৭৬ সালে আমি অর্থসচিব ছিলাম। ওই সময় গভর্নর পদে তার নাম আমিই প্রস্তাব করেছিলাম। এর পর ১৯৮৭ সালে শেগুফ্তা বখ্ত চৌধুরীকে গভর্নর পদে নিয়োগ দেয়ার সময় আমি অর্থমন্ত্রী। দুজন গভর্নরের নিয়োগের ক্ষেত্রে আমার ভূমিকা ছিল।

গভর্নর পদে যোগদানের আগে দুজনেই সচিব হিসেবে দেশের আর্থিক খাতের নীতিনির্ধারণী বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাদের কর্মতত্পরতার মূল্যায়ন করে এম সাইদুজ্জামান বলেন, দুজনেই খুব সৎ, কর্মঠ ভালো কর্মকর্তা ছিলেন। এর মধ্যে এম নুরুল ইসলাম সবচেয়ে বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন। নিজ যোগ্যতার স্বীকৃতি হিসেবেই তিনি গভর্নর পদে এত দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৮৭ সালে গভর্নর পদ থেকে বিদায় নেয়ার সময়ও আমি তাকে আরো কিছুদিন দায়িত্ব পালনের অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু তিনি শারীরিক অসুস্থতার কথা বলে পদত্যাগ করেছিলেন। এম নুরুল ইসলাম বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তার উদ্যোগের ফসল হিসেবে দেশের ব্যাংক খাতে ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি পোশাক খাতে বন্ডেড ওয়্যারহাউজ চালু হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পদ থেকে অবসরে যাওয়ার পর শেগুফ্তা বখ্ত চৌধুরী ১৯৯৬ সালে দেশের প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারে উপদেষ্টা ছিলেন। সে হিসেবে আমি বলতে পারি, গভর্নর হিসেবে আমার পছন্দ খারাপ ছিল না।

বর্তমানে দেশের রফতানি খাতে পোশাক শিল্পের অবদান সবচেয়ে বেশি। শিল্পটিকে আজকের পর্যায়ে এনে দিয়েছে নানা ধরনের নীতিসহায়তা। যদিও শিল্পটির যাত্রাকালে বাণিজ্যিক প্রতিবন্ধকতা ছিল সবচেয়ে বেশি। বৈদেশিক মুদ্রার পর্যাপ্ত সংরক্ষণও (রিজার্ভ) ছিল না। অবস্থায় মোহাম্মদ নুরুল কাদের নামে এক উদ্যোক্তা একদিন সাক্ষাৎ করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তত্কালীন গভর্নর এম নুরুল ইসলামের সঙ্গে। সাবেক আমলা হিসেবে দুজনের মধ্যে পরিচয় ছিল আগে থেকেই। দুজনের মধ্যকার আলোচনার ধারাবাহিকতাতেই পোশাক শিল্পে চালু হয় ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি বন্ডেড ওয়্যারহাউজ পদ্ধতির প্রয়োগ।

আশির দশকের শুরুতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পাশাপাশি বেসরকারি ব্যাংক পরিচালনার অনুমতি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ১৯৮১ সালের ৩১ ডিসেম্বর দেশের প্রথম বেসরকারি ব্যাংক হিসেবে আরব-বাংলাদেশ ব্যাংক লিমিটেড যাত্রা করে। এরপর থেকে ব্যাংক খাতে যুক্ত হতে থাকে নতুন নতুন বেসরকারি বিদেশী ব্যাংক। একই সঙ্গে অর্থনীতিতে যুক্ত হতে থাকে ইসলামী ধারার ব্যাংকও। ওই সময়ে দেশের ব্যাংক খাতের নীতি উদারীকরণে নেতৃত্ব দিয়েছেন গভর্নর এম নুরুল ইসলাম।

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অর্থসচিব ছিলেন মো. মতিউল ইসলাম। সাবেক গভর্নর এম নুরুল ইসলামের সহোদর তিনি। নিজের বড় ভাইয়ের স্মৃতিচারণ করে মতিউল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, এম নুরুল ইসলাম ১৯৫০ সালে সিএসপি ক্যাডার হিসেবে যোগদান করেছিলেন। তিনি পাকিস্তান আমলেই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন। পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশে আর্থিক খাতের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। নিজের ভাই হিসেবে বলছি না, একজন সাবেক আমলা হিসেবে আমার প্রত্যয়ন হলো, এম নুরুল ইসলাম বাংলাদেশ ব্যাংকের সেরা গভর্নর ছিলেন।

মুদ্রাবাজারের নিয়ন্ত্রক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংককে গড়ে তুলতে এম নুরুল ইসলাম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের আর্থিক খাতের কাঠামো তৈরি করা সবসময়ই চ্যালেঞ্জের। এম নুরুল ইসলাম সে চ্যালেঞ্জে জয়ী হয়েছিলেন। সৎ দক্ষ কর্মকর্তা হিসেবে সচিবালয়ে তার সুখ্যাতি ছিল। পরবর্তী সময়ে গভর্নর হিসেবেও দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালন করে তিনি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন।

স্বাধীনতার প্রথম দশক শেষে ব্যাংকঋণের সুদহার দুই অংকের ঘর ছাড়িয়ে যায়। ঋণের সুদহার নিয়ন্ত্রণে রাখতে আশির দশকের শুরুতে সুদহারে নিয়ন্ত্রণ আনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আমানত ঋণের সুদহার বেঁধে দেয়ার রেওয়াজ চলমান ছিল ১৯৯০ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত। ওই বছর থেকে আর্থিক খাত সংস্কার কর্মসূচির আওতায় বাজারমুখী সুদনীতি চালু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ১৯৯০ সালে একাধিক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ঋণ আমানতের সুদহার নির্ধারণের ক্ষমতা ব্যাংকগুলোর হাতে ছেড়ে দেয়া হয়। বাজার নীতি সংস্কারের সিদ্ধান্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন গভর্নর শেগুফ্তা বখ্ত চৌধুরী।

আশির দশকের শেষ পর্যন্ত দেশের ব্যাংক খাতে ঋণ শ্রেণীকরণ, সঞ্চিতি সংরক্ষণসহ ঋণের গুণগত মানের বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশনা ছিল না। নীতির অস্পষ্টতার সুযোগ নিয়ে দেশের ব্যাংকগুলোকে খাদের কিনারে নিয়ে দাঁড় করিয়েছিলেন শিল্প-উদ্যোক্তারা। ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে ফেরত দিতে হয় নাএমন একটি মনোভাব শিল্প-উদ্যোক্তাদের মনে জায়গা করে নিয়েছিল। পরিস্থিতি থেকে ব্যাংক খাতকে টেনে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ১৯৮৯ সালের ১৬ নভেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তত্কালীন ব্যাংকিং কন্ট্রোল বিভাগ থেকে প্রথমবারের মতো ঋণ শ্রেণীকরণ সঞ্চিতি সংরক্ষণ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। ওই প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ঋণশৃঙ্খলা জোরদার এবং ব্যাংক কর্তৃক প্রদত্ত ঋণ আদায় পরিস্থিতি উন্নয়নের লক্ষ্যে ঋণ শ্রেণীকরণ, সুদ স্থগিতকরণ ঋণ অনাদায়ের কারণে সম্ভাব্য ক্ষতির প্রতিবিধান সংবলিত একটি নতুন পদ্ধতি প্রবর্তনের সিদ্ধান্তের কথা জানায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। জারীকৃত ওই প্রজ্ঞাপনটি এখনো দেশের ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ চিহ্নিত করার প্রথম নির্দেশনা হিসেবে বিবেচিত হয়।

গভর্নর হিসেবে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ না পেলেও এনবিআরের চেয়ারম্যান হিসেবে শেগুফ্তা বখ্ত চৌধুরীকে কাছ থেকে দেখেছেন সাবেক সচিব অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, সরকারের আমলাদের মধ্যে যে কয়টি মৌলিক গুণের সন্নিবেশ থাকার দরকার, শেগুফ্তা বখ্ত চৌধুরীর মধ্যে তার সবকটিই বিদ্যমান ছিল। তিনি ছিলেন পেশাগত জীবনে ধীর, স্থির, মেধা, দক্ষতা মননশীলতায় অনন্য এক ব্যক্তিত্ব। এনবিআরের চেয়ারম্যান হিসেবে আমি তাকে অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে পেয়েছি। তার সততা নিরপেক্ষতা ছিল প্রশ্নাতীত। দেশের রাজস্ব খাতে শেগুফ্তা বখ্ত চৌধুরীর সংস্কারগুলো এখনো কার্যকর ভূমিকা রাখছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন