প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন ঢাকার চার নদী

এক যুগেও বন্ধ হয়নি আইনে নিষিদ্ধ দূষণ কার্যক্রম

আল ফাতাহ মামুন

ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত বুড়িগঙ্গা নদী দখলে-দূষণে এখন মৃতপ্রায়। প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন নদী নগরের বর্জ্য ছাড়াও গৃহস্থালি শিল্পবর্জ্যে মারাত্মকভাবে দূষিত। বিশেষ করে সদরঘাট এলাকা থেকে শুরু করে পাগলা পর্যন্ত দূষণ দখলের উৎসব চলে সারা বছরই। রাজধানীর অন্যতম বড় পাইকারি বাজার শ্যামবাজার এবং সদরঘাট বুড়িগঙ্গার তীরে হওয়ার কারণে এখানে নদীর দূষণ বেশি হয়। লঞ্চের আবর্জনা নদীতে ফেলার নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। একইভাবে শ্যামবাজারের ব্যবসায়ীদের পরিত্যক্ত আবর্জনাও বুড়িগঙ্গায় ফেলা হচ্ছে। পোস্তগোলার পর থেকে পাগলা পর্যন্ত বিশাল এলাকাজুড়ে ইট-বালি ব্যবসায়ীরা অবৈধভাবে নদী দখল করে ব্যবসা করে যাচ্ছেন।

টঙ্গীবাজার থেকে কয়েক মিনিট হাঁটলে গরুহাটা মোড়। সেখানে তুরাগপারে ফেলে রাখা হয়েছে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের বর্জ্যের স্তূপ। নদীটিকে রক্ষায় কিছুদিন আগে উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছিল বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) সে উচ্ছেদ অভিযানের বর্জ্য আবার ফেলে রাখা হয়েছে নদীর দুই পাশে। আশপাশের বস্তিগুলোর গৃহস্থালি বর্জ্যও নদীতেই পড়ছে।

পূর্বাচল সেক্টর--এর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বালু নদীর পাশে দেখা গিয়েছে সিমেন্ট কারখানা, পরিত্যক্ত ইটভাটা বসতবাড়ি। নদীর অন্য পাশে তীর দখল করে গড়ে উঠেছে খানেক অবৈধ খাবারের দোকান। এখানেও দোকান এবং বসতবাড়ির আবর্জনা নদীতেই ফেলতে দেখা গেছে।

শীতলক্ষ্যা নদীও বসতবাড়ির বর্জ্যে মরতে বসেছে। তবে পাথর বালি ব্যবসায়ীদের কারণে শীতলক্ষ্যা বেশি দূষিত হচ্ছে। নদীর পাশেই পাথর ভাঙার কারখানা। পাথর ভাঙার ময়লা পানি নদীতে পড়ছে। অব্যবহূত পাথরও নদীতে ফেলতে দেখা গেছে ব্যবসায়ীদের।

ঢাকাকে বেষ্টন করে রাখা চার নদীকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয় ২০০৯ সালে। পরিবেশ আইনে ধরনের এলাকায় দূষণ বৃদ্ধিকারী নয় ধরনের কার্যক্রমের ওপর স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। নদী চারটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে সংকটাপন্ন ঘোষণার পর পেরিয়েছে প্রায় এক যুগ। যদিও এখনো আইনে নিষিদ্ধ ঘোষিত কাজগুলো বন্ধ করা যায়নি এখনো। এখনো অবাধ দূষণ দখলের শিকার হচ্ছে নদীগুলো। দূষণের ফলে সব নদীই পানির স্বাভাবিক রঙ হারিয়ে ফেলেছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫- (সর্বশেষ সংশোধিত ২০১০) প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকায় মাটি, পানি, বায়ু শব্দ দূষণকারী শিল্প বা প্রতিষ্ঠান স্থাপন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নিষিদ্ধ করা হয়েছে মাছ বা অন্যান্য জলজ প্রাণীর জন্য ক্ষতিকারক যেকোনো ধরনের কার্যাবলি। এছাড়া নদী-জলাশয়-লেক-জলাভূমিতে বসতবাড়ি এবং শিল্প অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পয়ঃপ্রণালিসৃষ্ট এবং তরল কঠিন যেকোনো ধরনের বর্জ্য নির্গমন অপসারণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একই সঙ্গে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে পাথরসহ যেকোনো ধরনের খনিজ সম্পদ আহরণের ওপরও।

ঢাকার প্রধান চার নদী ঘুরে দেখা গেছে, আইনে নিষিদ্ধ কার্যক্রমগুলোর সবই এখন চার নদীতে অবাধে চলছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কঠোর নজরদারি রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত উদ্যোগের অভাবে সংকটাপন্ন চার নদীর দূষণ রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক (প্রশাসন অর্থ) কাজী রেজাউল করিম বলেন, ঢাকার নদীগুলো নিয়ে এক গবেষণায় দেখা গেছে, সিটি করপোরেশন কল-কারখানার বর্জ্যে এগুলো মারাত্মকভাবে দূষিত। চার নদীর দূষণের ফলে মেঘনা নদীও দূষিত হতে শুরু করেছে। যদি এখনই নদীগুলো দূষণমুক্ত করা না যায়, তবে মেঘনা নদীও একদিন প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকায় পরিণত হবে।

পরিবেশ অধিদপ্তর ২০১৬ সালে তুরাগ, বুড়িগঙ্গা শীতলক্ষ্যার পানির গুণগত মান পরীক্ষা করে জানিয়েছে, ঢাকার চার নদীর পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ প্রায় শূন্য। ফলে এসব নদী জলজ প্রাণী বসবাসের অযোগ্য। কভিড-১৯-এর কারণে নদীর পানি কিছুটা ইতিবাচক পরিবর্তন হলে এখানে মাছের আনাগোনা শুরু হয়। সম্প্রতি সদরঘাটের পাশে বুড়িগঙ্গায় এক জেলেকে মাছ ধরতে দেখা যায়। তিনি বলেন, কয়েকদিন আগে ভালো মাছ পেয়েছিলাম। এখন আর তেমন পাওয়া যায় না।

শীতলক্ষ্যা নদীতে দূষণের অন্যতম বড় কারণ নদীতীরের পাথর বালি ব্যবসায়ীরা। নদীর পাশেই গড়ে তোলা হয়েছে পাথর ভাঙার কারখানা। বিষয়ে জানতে চাইলে শীতলক্ষ্যার শিমরাইল নং ঘাটের ইজারাদার (নারায়ণগঞ্জ অংশের) মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, নদীর জমিতে বালি-পাথর রাখা সম্পূর্ণ বেআইনি। জায়গা খালি পড়ে আছে, এজন্য ব্যবসায়ীরা অস্থায়ীভাবে এখানে পণ্য রাখছেন।

নদীটির ঢাকা অংশের ইজারাদার মাহমুদুল হাসান পলিন। তিনি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৬৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলরও। ব্যবসায়ীদের অবৈধভাবে বালি পাথর রাখার ব্যাপারটি স্বীকার করে তিনি বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে কঠোরভাবে বলা আছে, নদীর তীরে কোনো ধরনের মালামাল এবং ট্রাক রাখা যাবে না এবং নদীর ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ করা যাবে না। বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও ব্যবসায়ীরা আমাদের কথা শুনছেন না।

সরেজমিনে দেখা গেছে, নারায়ণগঞ্জ অংশে নদীর জায়গাতেই অবৈধভাবে অনেক ব্যবসায়ী অস্থায়ী কার্যালয় বানিয়ে অফিস করছেন। একজন ব্যবসায়ীর কাছে বিআইডব্লিউটিএ অভিযান চালায় কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, কর্মকর্তারা এলে তাদের টাকা-পয়সা দিয়ে ম্যানেজ করা হয়। এখন আর আগের মতো কড়াকড়ি নেই।

পরিবেশ অধিদপ্তরের দাবি, সিটি করপোরেশন, ওয়াসাসহ সরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নদীদূষণ বেশি হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রমেও সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। ফলে দূষণ বন্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। দূষণ রোধে মাঝেমধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তর অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।

বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক বণিক বার্তাকে বলেন, ঢাকার চারটি নদীর প্রবাহ বজায় আছে। প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয় এমন যেকোনো কাজ আমরা কঠোর হাতে প্রতিহত করে থাকি। চার নদী দূষণে সিটি করপোরেশন শিল্প-কারখানার বর্জ্য বেশি দায়ী। বিষয়ে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। আমরা বলেছি, সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ডাম্পিং স্টেশনে ফেলার জন্য।

পরিবেশ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (পরিবেশগত ছাড়পত্র) মাসুদ ইকবাল মো. শামীম বণিক বার্তাকে বলেন, নদীদূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তর যথেষ্ট সচেতন। কিন্তু ওয়াসা, সিটি করপোরেশনের বর্জ্যের কারণে নদী বেশি দূষণ হচ্ছে। নদী দূষণকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলমান আছে। যারা নদী দূষণ করছে আমরা তাদের মোটা অংকের জরিমানা করছি। অনেক প্রতিষ্ঠান আমরা বন্ধ করে দিয়েছি।

অভিযোগ রয়েছে, নদীগুলোয় দূষণের সবচেয়ে বড় কারণ সিটি করপোরেশনের বর্জ্য। বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমডোর মো. বদরুল আমিন বণিক বার্তাকে বলেন, সিটি করপোরেশন নদীতে বর্জ্য ফেলে না। আমাদের নির্দিষ্ট ডাম্পিং আছে। আমরা সেখানে বর্জ্য ফেলে আসি। সাধারণ মানুষ ময়লা ফেলে খালের প্রবাহ বন্ধ করে ফেলছে, নদীতে ময়লা ফেলছে। আমরা অভিযান চালাই। জরিমানাও করি। এত বিশালসংখ্যক মানুষকে আইনের আওতায় আনা চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার। তবু আমরা অভিযান চালাচ্ছি, ব্যবস্থা নিচ্ছি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন