পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়ম প্রমাণের পরও পার পাচ্ছেন উপাচার্যরা

দোষী সাব্যস্ত হলে আচার্য তাদের শাস্তি দিন

উপাচার্য পদে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাজ্ঞ জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের নিয়োগ দেয়া হয়। উদ্দেশ্য থাকে তারা তাদের প্রাজ্ঞতা অভিজ্ঞতা দিয়ে প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। অথচ উদ্বেগের বিষয়, দায়িত্ব গ্রহণের পর দেশের বেশকিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে আইন উপেক্ষা করে স্বেচ্ছাচারী খামখেয়ালিভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার অভিযোগ উঠেছে। প্রায় প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ, পদোন্নতি থেকে শুরু করে নির্মাণ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অর্থ লোপাটের অভিযোগ রীতিমতো শিউরে ওঠার মতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের মতো মহৎ পেশায় কীভাবে এমন দুর্নীতিগ্রস্তরা অগ্রাধিকার পাচ্ছেন, তা প্রশ্ন বটে। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেভাবে অনিয়ম-দুর্নীতি স্বজনপ্রীতির অদৃশ্য ঘূর্ণিতে পাক খাচ্ছে, তা যথেষ্ট উদ্বেগের বিষয়। পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধিপূর্বক বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অবশ্যই যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয় শুধু কাঠামোগত পরিসর নয়, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মেধাবী, পরিশীলিত শিক্ষিত মানুষ তৈরির পীঠস্থানও। তাই এমন বিদ্যাপীঠগুলোর গুরুদায়িত্ব অবশ্যই সৎ, যোগ্য আদর্শ নেতৃত্বের হাতে হস্তান্তর করা জরুরি। যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়নে পরিকল্পিতভাবে বিভাগ খোলা, শিক্ষক নিয়োগ দেয়া, শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন নতুন উদ্ভাবন গবেষণার পরিবেশ নিশ্চিত করার মধ্য দিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক পূর্ণতা দানে সমর্থ। বাইরের দেশগুলোয় বিশেষজ্ঞ প্যানেলের মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগ করা হয়। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কনভোকেশন বোর্ডের ৫০ সদস্যের সমর্থন পেলে তিনি চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্ব পেতে পারেন। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় উপাচার্য নিয়োগে যে পদ্ধতি, সেখানে কোনো সিনেট নেই। সুতরাং ভোটের বিষয় নেই। নিয়োগ পদ্ধতি পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন। যারা শিক্ষা-গবেষণায় অন্যদের চেয়ে উচ্চস্থানে রয়েছেন, যারা পড়াশোনায় প্রশাসনিক দক্ষতা-সামাজিক অবস্থানে ভালো, তাদের পাশাপাশি পণ্ডিত অভিজ্ঞ শিক্ষকদের নিয়ে একটি বিশেষজ্ঞ প্যানেল তৈরি করা যেতে পারে। সে প্যানেলের মাধ্যমে যদি বাছাইকৃতদের নাম সরকারের মাধ্যমে আচার্যের (রাষ্ট্রপতি) কাছে প্রস্তাব করা হয়, তাহলে পদ্ধতিটা আরো গ্রহণযোগ্য হবে বলে অনুমেয়। এর সঙ্গে ইউজিসিকে আরো কার্যকর করা দরকার। ভারতে যেমন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের আইনি সক্ষমতা, জনবল কার্যক্ষমতা অনেক বেশি। আমাদের ইউজিসির সক্ষমতা বাড়িয়ে একে কমিশনে রূপ দেয়া এখন সময়ের দাবি।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় কেবল যে আর্থিক অনিয়ম-দুর্নীতি জেঁকে বসেছে তা- নয়, পছন্দের শিক্ষার্থীকে নম্বর বাড়িয়ে দেয়া, ভিন্ন মতের শিক্ষার্থীকে নম্বর কমিয়ে দেয়া, ফার্স্ট-সেকেন্ড বানানোর লোভ দেখিয়ে শিক্ষার্থীদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারসহ বিভিন্ন হয়রানির মতো ন্যক্কারজনক বিষয়ও মহামারী আকার ধারণ করেছে। অবস্থায় জাতীয় স্বার্থে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম-দুর্নীতি রোধে বিশেষ পদক্ষেপ নেয়ার বিকল্প নেই। আমরা দেখি, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ভিসি বড় ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতি বা অপকর্ম করলেও তাদের ফৌজদারি মামলা বা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মুখোমুখি হতে হয় না। কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। অভিযোগ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে তাকে উপাচার্য পদ থেকে অপসারণের সুপারিশ করা হয়। তবে বেশির ভাগ সময়ই ইউজিসির সুপারিশ আমলে নেয় না শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ফলে ভিসিরা বহাল তবিয়তেই থেকে যান। অনেক সময় অভিযোগ এলে তদন্তও হয় না। ভিসিদের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে গিয়ে ইউজিসির কমিটিও বেশির ভাগ সময়ই বিব্রত হয়। ফলে অনিয়ম করার পরও মেয়াদ পূর্ণ করতে সমর্থ হন অনেক উপাচার্য। এভাবে দিনের পর দিন দুর্নীতি করেও নির্বিঘ্নে পার পেয়ে যাচ্ছেন তারা। এটা যেন বিচারহীনতার স্থায়ী সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। ফলে দুর্নীতিগ্রস্তদের শাস্তির আওতায় আনা যাচ্ছে না।

দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তার মধ্যে অনুসরণীয়। তাই এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা যখন সমাজের সম্মানীয় ব্যক্তি হয়েও অনিয়ম দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন, তা সমাজে মূল্যবোধের অভাবকে স্পষ্ট করে। মুহূর্তে বর্তমান সাবেক বেশ কয়েকজন উপাচার্য এবং প্রায় ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে ইউজিসি। তবে আমরা দেখছি রাজনৈতিক পরিচয়ে উপাচার্য হওয়া শিক্ষকরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে গুরুত্ব দেন না। এমনকি তদন্ত করতে গিয়ে উপাচার্যের চাপে ইউজিসির তদন্ত দলকে ফিরে আসারও উদাহরণ রয়েছে। অবস্থায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় ইউজিসিকে সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হতে হবে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দ্রুত তদন্ত শেষ করে উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে। এভাবে বিচারের সংস্কৃতি তৈরি করতে পারলে অন্যরা দুর্নীতি করার সুযোগ পাবেন না। বিশ্বের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই। গবেষণা দক্ষতা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার অভিজ্ঞদের উপাচার্য হিসেবে নিযুক্ত করে থাকে উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। আর আমাদের এখানে জ্ঞান গবেষণার চেয়ে দলীয় বিবেচনাকে প্রাধান্য দেয়া হয়। ফলে উপাচার্যরা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় দক্ষতার পরিচয় দিতে পারছেন না এবং দলীয় আনুগত্যের কারণে নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়ছেন। এক্ষেত্রে দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। যেভাবে রোগ সংক্রমিত হচ্ছে, তাতে অদূরভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের চরিত্র হারাবে।

উচ্চশিক্ষার বৈশ্বিক প্রবণতার উল্টো পথে হাঁটছে বাংলাদেশ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গবেষণা খাতে বরাদ্দ থাকে না, গুরুত্ব দেয়া হয় না মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিতের বিষয়গুলোয়। উপাচার্য নিয়োগ হয় রাজনৈতিক ক্ষমতার জের ধরে। অনিয়মের চক্র থেকে বেরিয়ে আসার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কেননা যোগ্য প্রার্থীরা উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ না পেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাই মানহীন হয়ে পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়। তাই যোগ্য উপাচার্যের কাঁধে বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব হস্তান্তরে প্রশাসনকে বিশেষভাবে উদ্যোগী হতে হবে। খবর মিলছে, দেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের বিভিন্ন অনিয়ম নিয়ে ইউজিসি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্ত চলমান। আমরা আশা করব, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ইউজিসি তদন্ত করেই দায়িত্ব শেষ করবে না। তদন্ত প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ নেবে। যেসব উপাচার্য নিয়মবহির্ভূতভাবে বিভিন্ন পদে লোক নিয়োগ করে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় করেছেন, তাদের কাছ থেকে সেই অর্থ ফেরত নেয়ারও ব্যবস্থা করতে হবে। ভবিষ্যতে ধরনের ব্যক্তিরা যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদে না আসতে পারেন, সে বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে সরকারকে। প্রকল্প থেকে অর্থ লুটপাটের জন্য দায়ীদের বিচারের আওতায় আনা প্রয়োজন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিদের বুঝতে হবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অনিয়ম দুর্নীতি বহু বছর ধরেই চলে আসছে। বহু তদন্ত কমিটি বসেছে, কমিটি প্রতিবেদন দিয়েছে কিন্তু ব্যতিক্রম ছাড়া কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এর পুনরাবৃত্তি কোনোভাবে কাম্য হতে পারে না।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন