তিনটে কথা প্রথমেই বলে নিই। প্রথমত, আমি শিবরাম চক্রবর্তীর পরম ভক্ত; তার শব্দের খেলা আমার ভারি ভালো লাগে। ওই যে ‘ধার করি আমরা উদ্ধার পাওয়ার জন্য’ কিংবা ‘স্বামী মাত্রই আসামি’। এবার ভাবলাম আমিও সে রকমটা একটু চেষ্টা করে দেখি না! বেশ ধস্তাধস্তির পরে বোঝা গেল ও আমার কম্মো নয়, এমন যেমন ‘লেজে গোবরে’ অবস্থা আমার, তখন আমাকে বাঁচিয়ে দিল আমাদের শামীম—সতীর্থ, বন্ধু শামীম আজাদ।
সেটাই আমার দ্বিতীয় কথা। তার একটা লেখার শিরোনাম দেখেছিলাম—‘নারী মানেই আনাড়ি নয়’। সেটাই চেয়েচিন্তে নিলাম তার কাছ থেকে, অনেকটা ধার করলাম উদ্ধার পাওয়ার জন্য। ‘বাহ্, দোষের কী হলো? বন্ধুকে বন্ধু না দেখিলে আর কে দেখিবে।’ ওই আবারো শিবরাম—‘চক্কোত্তিকে চক্কোত্তি না দেখিলে আর কে দেখিবে।’
আর তৃতীয়ত, হাসি-ঠাট্টা ছেড়ে দিয়ে গুরুগম্ভীরতার সঙ্গে বিষয়টির গুরুত্ব বোঝা প্রয়োজন। পুত্রবধূর নির্বাচনী পরীক্ষা নিচ্ছেন এক ভদ্রলোক—‘রান্না জানো?’ ‘সামান্য’—মেয়েটির শান্ত উত্তর। ‘বড়ি দিয়ে কুমড়ো শাক কী করে রাঁধতে হয়?’ কিছু একটা বলল মেয়েটি, কিন্তু নিঃসন্দেহে সেটি সঠিক উত্তর নয়। ‘সেলাই করতে পারো?’ প্রশ্নের রেলগাড়ি চলতেই থাকে। ‘না’—চোখ ভরা জল মেয়েটির। ‘তুমি তো দেখছি একেবারেই আনাড়ি’—রায় ঘোষিত হয়ে গেল।
বড় মায়া হয় মেয়েটির জন্য আমার—আমারই তো এক ভ্রাতুষ্পুত্রী সে। ‘আপনি আবৃত্তি করতে পারেন?’ জানতে চাই আমি ভদ্রলোকটির কাছে। সারা ঘরের সব কথা থেমে যায়। ভদ্রলোক হতবাক! ‘না,’ অবাক গলায় বলেন তিনি। ‘পিরিচে একটুকুও চা না ফেলে ভরা কাপ চা নিয়ে পারেন আসতে?’ আমার ভাবীর রক্তচক্ষু সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে প্রশ্নবাণ ছুড়ে দিই আমি ওই ভদ্রজনের প্রতি। ‘চেষ্টা করিনি কখনো।’ তার কণ্ঠের কাঠিন্য টের পাই আমি। ‘ছোট্ট একটি হাতুড়ি দিয়ে দেয়ালে একটুও ক্ষত না করে এক বাড়িতে পেরেক লাগাতে পারেন?’ ভদ্রলোক কথা পর্যন্ত বললেন না। এবার শক্ত গলায় বলি আমি, ‘আপনি তো ওর চেয়েও আনাড়ি। ও তো এ সবকিছু পারে অনায়াসে।’
ওই পক্ষ চলে গেলে তিরস্কারের বন্যা বয়ে যায় আমার ওপর দিয়ে। ভাই-ভাবী আমার সঙ্গে এক মাস কথা বলেননি। আমার বাচালতায় বিরক্ত হয়েছিলেন আমার খালা। শুধু যখন চলে আসি, তখন মেয়েটি আমার কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলেছিল, ‘চাচা আজ একমাত্র তুমিই আমার সম্মান রক্ষা করলে।’ ওর চিবুকে আলতো করে আদর করে বেরিয়ে আসি।
এ আখ্যানটির এখন একটি পাদটীকা আছে। সেদিনের সে তরুণীটি পশ্চিমের এক নামি বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণ অধ্যাপক স্থাপত্য বিভাগে। সেখানে বিভাগীয় প্রধানও সে। যে দক্ষতায় সে বিভাগীয় প্রশাসন চালায়, সেই একই দক্ষতায় সে অনেক সুরম্য ভবনের নকশা করেছে। দুর্দান্ত রাঁধুনি সে, সূচিকর্মেও তার জুড়ি নেই। বাড়ির পাঁচ রকমের রান্না সে আমাকে খাইয়েছে। সে নারী নিঃসন্দেহে, কিন্তু আনাড়ি নয় কোনোমতেই।
নারী যে আনাড়ি নন, তার প্রচুর প্রমাণ ইতিহাসে আছে, আছে গল্পগাথায়, আছে আমাদের চোখের সামনে নিত্যদিন। নারী শুধু রাজ্য শাসন করেননি, রাজারে শাসিয়েছেন নারী। ঘরে-বাইরে জীবনের সব ক্ষেত্রে নারীর ধ্যান-ধারণা, দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তা-চেতনা কর্মধারা প্রতিনিয়তই প্রমাণ করেছে যে তারা আনাড়ি নন। রাষ্ট্র পরিচালনার মতো সামষ্টিক ব্যানারেই শুধু নয়, জীবন ও জগতের নানা ক্ষেত্রে নারীর দক্ষতা ও অর্জন সুবিদিত।
কি না করছেন নারী? তথাকথিত পুরুষের কাজের ক্ষেত্রেও তারা প্রমাণ করেছেন যে কোনো অংশেই তারা আনাড়ি নন। তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করলে এবং তাদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি হলে তারা যে আনাড়ি নন, তা তারা প্রমাণ করতে পারেন। নারী আনাড়ি—এ-জাতীয় একটি বায়বীয় ধারণা সৃষ্টি করার জন্য পুরুষ কতগুলো কল্পকথা সৃষ্টি করেছেন।
এক. নারী দুর্বল, তাই বহু কাজ তাদের সাধ্যের বা আয়ত্তের বাইরে। দুই. তথাকথিত পুরুষের কাজগুলো নারী করতে পারবেন না। তিন. নারী আবেগপ্রবণ। অতএব শান্ত ও জটিল চিন্তার কাজগুলো তাদের জন্য নয়। চার. ঘরের ভেতরের কাজগুলো নারীদের উপযোগী। সুতরাং সেখানেই তাদের অবস্থান কাম্য। পাঁচ. নারীর বুদ্ধি কম, সুতরাং বিজ্ঞান বা প্রকৌশলীর মতো ব্যাপারগুলো তাদের আয়ত্তের বাইরে।
এ পাঁচটি যুক্তি যে খোঁড়া তা-ই নয়, নারীর প্রতি এগুলো অত্যন্ত অবমাননাকরও বটে। প্রথমত, নারী-পুরুষের শারীরিক গঠন ও মনোজগতে নানা পার্থক্য আছে। সে কারণে নানা কাজ করার আয়াসসাধ্যতারও হেরফের আছে। কিন্তু তার মানে এই নয়, নারী আনাড়ি। পুরুষের আনাড়িপনার তালিকা যদি প্রস্তুত করা হয়, তাহলে এক ইতিহাস লেখা যাবে। নারীকে দুর্বল বলে তার মনে এক ধরনের হীনম্মন্যতা সৃষ্টি করাই এ বক্তব্যের মূল লক্ষ্য।
দ্বিতীয়ত, তথাকথিত পুরুষের কাজগুলো নারীরা করছেন শুধু দক্ষতার সঙ্গে নয়, বিমান চালনা থেকে শুরু করে সেনাবাহিনীতে ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ, মহাকাশ যাত্রা, শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজ থেকে রাষ্ট্র পরিচালনা—সর্বক্ষেত্রেই নারী প্রমাণ করেছেন যে তথাকথিত পুরুষের কাজগুলো তারা সুষ্ঠুভাবেই সম্পন্ন করতে পারেন; চাই শুধু সুযোগ, সক্ষমতা বৃদ্ধি ও কর্মের বিস্তার। সর্বত্র নারী প্রমাণ করেছেন যে নারীর কাজ পুরুষের কাজ বলে কোনো বিভাজন নেই। ওটা পুরুষের সৃষ্টি তার তথাকথিত শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য। একটা কথা বলি, পুরুষের কাজ বলে যেগুলো পুরুষ সনাতন কাল ধরে চিহ্নিত করেছেন, সেগুলোর দেয়াল নারী একেক করে ভেঙে দিচ্ছেন। কিন্তু নারীর কাজ বলে পুরুষ যে কাজগুলো চিহ্নিত করেছেন, তার কতটুকু করার দক্ষতা পুরুষ অর্জন করেছেন? তার একটি কাজ তো পুরুষ কখনই করতে পারবেন না।
তৃতীয়ত, আবেগ ও সংবেদনশীলতা এক বস্তু নয়। নারীর সংবেদনশীলতাকে ভুল করে আবেগ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। নারী সংবেদনশীল, কিন্তু অতি আবেগপ্রবণ নন নিঃসন্দেহে। আসলে সত্যিকারের আবেগপ্রবণ হচ্ছেন পুরুষরা এবং তাদের আবেগ বড়ই তীব্র। তাদের অতি আবেগপ্রবণতার ভার নারীদেরই বহন করতে হয়। নারীর আবেগের প্রমাণ হিসেবে তাদের কান্নাকে চিহ্নিত করা হয়। ওটা তাদের সংবেদনশীতার প্রমাণ। অতি আবেগপ্রবণ পুরুষের আবেগের জলকে যদি ধরে রাখা হয়, তাহলে তা দিয়ে আরেকটি গঙ্গা বইয়ে দেয়া যাবে।
চতুর্থত, ঘরের কাজগুলো নারীর উপযোগী—এ ব্যাপারটিও পুরুষের সৃষ্টি। নারীকে গৃহাভ্যন্তরে আটকে রাখার এক চমকপ্রদ ফন্দি। ঘরের কাজগুলো যে পুরুষ করতে পারেন অতি সুন্দরভাবে, তার প্রমাণ বহু পুরুষ দিয়েছেন। আসলে ঘরের ভেতরের কাজগুলোর বিরাট ভার যদি পুরুষ সহভাগ করে নেন, তাহলে নারীর পক্ষে বহু উৎপাদনশীল ও সৃজনশীল কাজ করা সম্ভব। গৃহাভ্যন্তরের কাজগুলোয় পুরুষের সহভাগ নারীমুক্তির আবশ্যিক শর্ত, পর্যাপ্ত শর্ত নয় অবশ্যই।
পঞ্চমত, নারীর বুদ্ধি কম, সুতরাং বিজ্ঞান তাদের আয়ত্তের বাইরে—এমন একটি অকল্পনীয় কথা বলেছিলেন একদা হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান, বিশ্বব্যাংকের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী লরেন্স সামার্স। আমার পরিচিত এক অর্থনীতিবিদের এমন একটি অশোভন উক্তিতে লজ্জায় মুখ লুকাই। তবে এমন নির্বোধ অবমাননাকর উক্তির জবাব দেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। এমন উক্তি উত্তরের যোগ্য নয়।
এখন মোক্ষম প্রশ্ন হচ্ছে, এত সব যুক্তি ও সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকা সত্ত্বেও নারীকে আনাড়ি হিসেবে চিহ্নিত করার এবং সেটাই প্রতিষ্ঠিত করার ক্রমাগত প্রয়াসের কারণটি কী? আমার মনে হয়, সে কারণের একটি মনস্তাত্ত্বিক দিক আছে এবং সেসঙ্গে একটি বাস্তবতার দিকও আছে। মনে রাখা দরকার যে নারী মানেই আনাড়ি—এমন কথা কিন্তু নারীরা বলছেন না। বলবেনও না। এ কথাটি উচ্চারিত হচ্ছে প্রবলভাবে পুরুষের দ্বারা এবং এ পর্যবেক্ষণটির মধ্যে উত্থাপিত প্রশ্নটির উত্তর লুকিয়ে আছে।
আমাদের সমাজটি পুরুষতান্ত্রিক। এ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে অবদমন করাটা জরুরি পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য। সে অবদমনের একটি সূক্ষ্ম মনস্তাত্ত্বিক মাত্রিকতা আছে। নারীকে যদি জীবনের বহু ক্ষেত্রে ক্রমাগতভাবে আনাড়ি বলে পরিহাস করা হয়, তিরস্কার করা হয়, তাহলে তার মধ্যে একটি হীনম্মন্যতাবোধের জন্ম হবে। একটা সময়ে তার মনে হবে তিনি বোধহয় অযোগ্য, অদক্ষ ও আনাড়ি। তার প্রত্যয়ের ভিতে ফাটল ধরবে এবং তার ক্ষমতায় তিনি আর আস্থা রাখতে পারবেন না। নারীর এই সংশয়িত অবস্থানটি তাকে অবদমনের জন্য পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ক্ষেত্রে বড় প্রয়োজন।
কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি ভিন্নও ‘নারী মানেই আনাড়ি’—এ বক্তব্যের একটি বাস্তবভিত্তিক প্রায়োগিক দিক আছে। একটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে অবদমনের জন্য গৃহের বাইরের বহু কাজেই নারী যোগ্য নন—এ কথাটির ধুয়ো তুলেই বলা হয়, নারীর প্রকৃত অবস্থান গৃহাভ্যন্তরে। গৃহকাজই তার যোগ্য কাজ। এ বক্তব্যের দুটো দিক আছে। এক. এমন একটি কথা বলে আমরা নারীকে ঘরের মধ্যে আটকে ফেলি, বাইরের বিশাল পৃথিবীতে তার সক্ষমতার প্রয়োগ এবং তা থেকে প্রাপ্তব্য সুফলের ক্ষেত্রটি আমরা সীমিত করে ফেলি। দুই. নারী গৃহকর্মই সবচেয়ে ভালো করতে পারবেন—এমন কথা বলে গৃহাভ্যন্তরে সব রকমের মজুরিবিহীন কাজ আমরা নারীকেই দিয়েই করিয়ে নিই। বিনা মূল্যে শ্রমের এমন নজির খুব বেশি নেই। প্রায়োগিক দিক থেকে পুরুষের গৃহবহির্ভূত কাজের জন্য এ-জাতীয় শ্রম একান্ত প্রয়োজনীয়। নারী ঘরের ভেতরে সেবামূলক কাজে ব্যাপৃত থাকেন বলেই পুরুষ ঘরের বাইরের কাজ করতে পারেন। নিজেদের কাজের গুরুত্ব প্রতিষ্ঠিত করার জন্য পুরুষ তার ঘরের বাইরের কাজকে সংজ্ঞায়িত করেছেন উৎপাদনশীল কাজ হিসেবে, যেন ঘরের ভেতরে নারীর কাজটি অনুৎপাদনশীল!
নারীকে আনাড়ি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে তাকে অবদমনের জন্য পুরুষতান্ত্রিক সমাজে চেষ্টার অন্ত নেই। নারীর সক্ষমতা বাড়াতে দিয়ো না। সুযোগ গ্রহণের আগেই তাকে আটকে ফেলো। তাই ১৮ বছর হওয়ার আগেই সারা বিশ্বে ১ কোটি ৫০ লাখ মেয়েকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। প্রতি ২ মিনিটে একটি বালিকা বধূ। নারীর বাইরে কাজ করার সুযোগকে আটকাও—যে কারণে বিশ্বের ১৮টি দেশে ঘরের বাইরে কাজের জন্য নারীকে স্বামীর অনুমতি নিতে হয়। নারীর বহির্বিশ্ব পরিভ্রমণের সুযোগ নিয়ন্ত্রণ করো—৩২টি দেশে পাসপোর্ট প্রাপ্তির জন্য তাই নারীর ক্ষেত্রে বিধিবিধান ও প্রক্রিয়া ভিন্ন। নারীকে সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করো—যার জন্য উন্নয়নশীল বিশ্বে মাত্র ১০ শতাংশ নারীর ভূমির মালিকানা রয়েছে। নারীকে আনাড়ি প্রমাণের লক্ষ্যে অবদমন পন্থার আরো তো অস্ত্র আছে। সহিংসতা তেমনই একটি অস্ত্র। সেই অস্ত্র ব্যবহূত হয় নানাভাবে। বিশ্বে প্রতি তিনজন নারীর একজন জীবনের কোনো না কোনো সময়ে গৃহাভ্যন্তরে সহিংসতার শিকার হয়েছেন। প্রতি বছর ২০ কোটি নারী শিকার হন যৌনাঙ্গচ্ছেদের মতো ক্ষতিকর প্রক্রিয়ার। পরিবারের তথাকথিত সম্মান রক্ষার জন্য প্রতি বছর পাঁচ হাজার নারীকে আত্মাহুতি দিতে হয় বিভিন্ন দেশে।
নারীর প্রতি পুরুষের সহিংসতার একটি অন্যতম কারণ যুক্তি ও বাস্তব বিচার-বুদ্ধি হচ্ছে নারীর অস্ত্র, আর পেশিশক্তি হচ্ছে পুরুষের অস্ত্র। ‘যার যা অস্ত্র পিতঃ তা তার সম্বল’—এটা পুরুষ খুব ভালো করেই জানে। তাই নারীর বুদ্ধিবৃত্তি, যুক্তি আর বাস্তব চিন্তার সঙ্গে পুরুষ যখন পেরে ওঠেন না, তখনই হিংস্র হয়ে ওঠেন, পেশিশক্তি প্রয়োগ করেন এবং সহিংসতার আশ্রয় নেন।
নারীর প্রতি সহিংসতার একটি চরম রূপ হচ্ছে ধর্ষণ। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে দেখা হয় পুরুষের উপভোগের পণ্য হিসেবে। নারী মহলে থাকবেন, তাই তিনি মহিলা। নারী রমণযোগ্য, তাই তিনি রমণী। নারী যেহেতু উপভোগের সামগ্রী ও পণ্য, তাই তাকে উপভোগ করা যেতে পারে। সে প্রক্রিয়াটি স্বেচ্ছাকৃতই হোক কিংবা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমেই হোক—এ ধারণাটি বহু পুরুষের চিন্তাচেতনায় বিদ্যমান। ধর্ষণের মনস্তত্ত্বের একটি কেন্দ্রবিন্দু সেখানেই।
‘নারী যে আনাড়ি নয়’—এ সত্যটি প্রমাণ করার জন্য কী করা যেতে পারে? এর মূল কাজটি নারীরাই করছেন তাদের অতুলনীয় কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। জীবন ও জগতের প্রতিটি অঙ্গনে তাদের দৃপ্ত পদক্ষেপ। ‘শার্সি উপতল’ তারা এখনো ভাঙতে পারেননি তা ঠিক, কিন্তু ফাটল তো ধরিয়েছেন ধীরে ধীরে। জানি বিশ্বের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের উচ্চতম পদগুলোয় দুই-তৃতীয়াংশ এখনো পুরুষের দখলে, কিন্তু সেখানেও ধীরে ধীরে নারীদের আরো আগমন ঘটছে।
দ্বিতীয়ত, সন্দেহ নেই, যখন আমরা নারীকে জায়া-জননী-আত্মজা হিসেবে চিহ্নিত করি, তখন আমরা তাদের মহিমান্বিত করি। কিন্তু এর কোনোটাই নারীর সবচেয়ে বড় পরিচয় নয়। নারীর সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি মানুষ, নারীর মানুষ পরিচয়কে পেছনে রেখে আমরা যদি তার জায়া-জননী-আত্মজা পরিচয়কেই তাদের একমাত্র আত্মসত্তা হিসেবে চিহ্নিত করি, তখন কিন্তু মানুষ হিসেবে তাদের সক্ষমতা, সম্ভাবনা ও আত্মপরিচয়কে আমরা সীমাবদ্ধ করে ফেলি। সে অবস্থায় জীবনের বৃহত্তর ক্ষেত্রে ও মানবিকতার বিভিন্ন মাত্রিকতায় নারীর ঘাটতিকে বড় করে দেখানো সহজ, তাদের আনাড়িপনার প্রমাণ দেয়া কষ্টকর নয়। সুতরাং নারীকে মানুষ হিসেবে দেখার মতো দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে হবে।
তৃতীয়ত, একটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর জীবনের বহু বাস্তবতা নির্ধারিত হয় পুরুষের কর্মকাণ্ডের দ্বারা—কখনো ইতিবাচকভাবে, কখনো নেতিবাচকভাবে। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের কথাই ধরা যাক না, তাকে লিখতে-পড়তে শিখিয়েছিলেন তার অগ্রজ—একজন। সুতরাং তার জীবনের ইতিবাচক বাস্তবতার শুরু একজন পুরুষের হাত ধরেই। আবার অন্যদিকে একজন পুরুষের নেতিবাচক কর্মকাণ্ড একজন নারীকে ‘আমি আনাড়ি’ নামক হীনম্মন্যতার সৃষ্টি করতে পারে, নারীর প্রতি পুরুষের মনোভাব, দৃষ্টিভঙ্গি, কর্মকাণ্ডের পরিবর্তন একান্তই আবশ্যক।
চতুর্থত, একজন পুরুষকে বুঝতে হবে যে তার পৌরুষের উৎস তার পেশিশক্তি নয়, তার সংবেদনশীলতা, তার বিবেচনাবোধ, তার বিবেক। ক্রোধ নয়, সমতা; ঔদাসীন্য নয়, বিবেচনা; স্পর্শকাতরতা নয়, সংবেদনশীলতা; সন্দেহ নয়, আস্থা একজন পুরুষকে সত্যিকারের পুরুষ হিসেবে গড়ে তোলে। তাই আমি বলি, একজন পুরুষের মধ্যে কিছুটা নারীসত্তা থাকা একান্ত প্রয়োজন; একজন নারীর যেমন কিছুটা পুরুষালি হওয়া ভালো তার শক্তি প্রকাশের জন্য।
নারী আনাড়ি নন, তাকে আনাড়ি বলে ভাবা বা উপস্থাপনের চেষ্টাও অনভিপ্রেত। পুরুষের বুঝতে হবে এ লক্ষ্যে নারীকে অবদমন তার যাত্রাকেও ব্যাহত করবে। সমাজের অর্ধেক অংশকে অবদমিত করে সমাজ এগোবে না। নারীকে তার আপন শক্তিতে জাগতে দিতে হবে, আর সে ক্ষেত্রটি তৈরি করার দায়িত্ব পুুরুষেরও। পুরুষের মনমানসিকতা আর দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এখানে অত্যাবশ্যক। ‘নারী মানেই আনাড়ি নয়’—এ কথাটির সঙ্গে আড়ি দেয়াই কাম্য।
[২০২০ সালের আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেন্ডার স্টাডিজ ও জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, বাংলাদেশ আয়োজিত লোকবক্তৃতা]
ড. সেলিম জাহান: অর্থনীতিবিদ; ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র