আন্তর্জাতিক নারী দিবস

নারীদের সমান অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে হবে

আন্তর্জাতিক নারী দিবসের এবারের প্রতিপাদ্যকরোনাকালে নারী নেতৃত্ব গড়বে নতুন সমতার বিশ্ব। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া, বিশেষত নীতিনির্ধারণে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীরাও সমান অংশীদার হতে পারেন, সেটাই প্রতিপাদ্যের মাধ্যমে প্রকাশ্যে আনা হয়েছে। পরিস্থিতির চাহিদা অনুযায়ী মহামারী থেকে পুনরুদ্ধারের জন্য তাদের চেষ্টাকে সবার সামনে তুলে ধরাও এর অন্যতম উদ্দেশ্য। সারা বিশ্বে নারীরা একটি উপলক্ষ হিসেবে দিবস উদযাপন করেন। বিশ্বের একেক প্রান্তে নারী দিবস উদযাপনের প্রধান লক্ষ্য একেক ধরনের হয়। কোথাও নারীর প্রতি সাধারণ সম্মান শ্রদ্ধা উদযাপনের মুখ্য বিষয় আবার কোথাও নারীদের আর্থিক, রাজনৈতিক সামাজিক প্রতিষ্ঠা বেশি গুরুত্ব পায়। কভিড মহামারী দেখিয়েছে নারী নেতৃত্ব প্রদানের ইতিবাচক ফল। করোনাভাইরাস মহামারীর সময় সফল দক্ষ নেতৃত্ব প্রদান করেছেন নারীরা। মহামারীর সঙ্গে মানবসভ্যতার যুদ্ধে তারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। চিকিৎসা ক্ষেত্রের সঙ্গে জড়িত হোক বা বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, সেবিকাসব ক্ষেত্রেই তাদের উপস্থিতি পরিস্থিতিকে উন্নত করেছে। তবে জাতিসংঘ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী নিজের পুরুষ সহকর্মীদের তুলনায় ১১ শতাংশ হারে কম বেতন পাচ্ছেন প্রথম সারির করোনা নারী যোদ্ধারা; যা বেতন কাঠামোর বৈষম্যকেই প্রকাশ করে।

কৃষি সভ্যতার দেশে গ্রামীণ নারীরা পুরুষের কর্মক্ষেত্রের নিত্য অনুষঙ্গী। তারাই মাঠে বর্ষাকালীন শস্য থেকে রবিশস্য উৎপাদনের সময় পর্যন্ত নিরলস সহায়তা করে যান নিজ নিজ পরিবারে। পশুপালন থেকে শুরু করে চাষাবাদ এবং দ্রব্যের বাজারীকরণসর্বত্রই নারীর প্রত্যক্ষ পরোক্ষ যোগদান গ্রামীণ জনজীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। গ্রামীণ ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের সিংহভাগই নারীকেন্দ্রিক। তবে অর্থনৈতিক সংস্কারকদের একটি ব্যাপারে সচেতন হতে হবেকৃষি, কৃষিভিত্তিক শিল্প, ক্ষুদ্র যোগদান আনুপাতিক হারে সর্বাধিক হলেও মধ্যবিত্ত তদূর্ধ্ব স্তরের নারীরা এক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নারীদের যোগদানের সুযোগ থাকলেও তাদের সিংহভাগই কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলোয় নিযুক্ত নন। এক কথায় গ্রামীণ অর্থনীতিনির্ভর দেশীয় অর্থনীতিতে এবং সমাজজীবনে নারীর অবদান ভূমিকা অপরিমেয়। এক্ষেত্রে ক্ষুদ্র কুটির শিল্পে মেয়েদের অবাধ নির্ভয়ে যোগদান আমাদের অর্থনীতিকে শুধু চাঙ্গা করবে না, বরং এক মজবুত আর্থসামাজিক পরিবেশের সূচনাও ঘটাবে। ফলে নারীরা সমাজের অর্ধাংশের যোগদানে আর্থসামাজিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে এবং সুস্থ সমাজ গঠন সুনিশ্চিত করবে। এক কথায়, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীদের যোগদান ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের স্থায়িত্ব দীর্ঘায়িত করবে। গ্রামীণ নারী কেবল গ্রামীণ শিল্প কিংবা সেবা খাতে অবদান রাখছেন তা কিন্তু নয়, শহরাঞ্চলে গড়ে ওঠা নানা শিল্পে বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে শ্রমের জোগান দিচ্ছেন গ্রাম থেকে আসা নারীরাই। দেশের অর্থনীতিতে গ্রামীণ নারীদের অবদান ব্যাপক হলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছর পূর্ণ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে লক্ষ করব, নারী তার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নিজের ইচ্ছায় পূর্ণাঙ্গভাবে করতে পারেন না।

প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের বাইরে নারীদের স্বনিয়োজনের ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য তাদের জ্ঞান, প্রশিক্ষণ এবং সর্বোপরি পুঁজির প্রয়োজন। নারীরা যাতে স্ব-উদ্যোগী হয়ে উপার্জন করতে পারেন, সেজন্য ব্যাংকঋণের সহজলভ্যতা বাড়াতে হবে। আগামীতে যে ক্ষেত্রগুলোয় কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, সেটি নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় নারী কর্মীরা ঝরে পড়ছেন। যেমন রফতানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পে নারীদের অংশগ্রহণ আগের চেয়ে কমে আসছে। যেহেতু সেখানে নারীরা কম দক্ষতার কাজগুলো করে থাকেন এবং যেহেতু তারা প্রযুক্তি ব্যবহারে পিছিয়ে রয়েছেন। আগামীর কর্মজগৎ হবে বর্তমান থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ছোঁয়া দেরিতে হলেও বাংলাদেশে লাগতে শুরু করেছে। অনেক চাকরির প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে। অনেক নতুন কাজ সৃষ্টি হবে। শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য তাদের যুগোপযোগী শিক্ষা প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করতে হবে। সরকারি বেসরকারি খাতের যুগপৎ উদ্যোগ ছাড়া আধুনিক শ্রমবাজারে নারীদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা যাবে না।

মানবসম্পদ উন্নয়নে গ্রামীণ নারীরা অবদান রাখছেন শিশুদের শিক্ষা স্বাস্থ্যে বিনিয়োগের মাধ্যমে। গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণে তারা সরাসরি কাজে অংশ নিয়ে সার্বিক উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করছেন। দেশের প্রধান রফতানি পণ্যসহ অন্যান্য শিল্পের প্রয়োজনে শ্রমের জোগান দিয়েছেন গ্রামীণ নারীরা। তাতে শিল্পোৎপাদন বেড়েছে, কর্মসংস্থান মাথাপিছু আয় বেড়েছে। ক্ষুদ্র ঋণ প্রোগ্রামের আওতায় গ্রামের নারীরা ঋণ নিয়ে নানা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সংযুক্ত হয়েছেন, আবার এসব কর্মসূচির আওতায় সঞ্চয় করে দেশের মোট সঞ্চয় বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছেন।

গ্রামাঞ্চলের সাধারণ নারীর মধ্যেও যেসব নারী আরো অবহেলিত, বিপর্যয়ের শিকার, তাদের জন্য নারী দিবসের বাণী আরো জরুরি। সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের বিস্ময়কর সাফল্যের পেছনে নারীর বিরাট ভূমিকা রয়েছে। সামাজিক-সাংস্কৃতিক-মনস্তাত্ত্বিক বৈষম্য নিরাপত্তাহীনতা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য পুষ্টির ক্ষেত্রে নারীর অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। লিঙ্গসমতা সূচকে দেশের নারীদের অবস্থান এখন পার্শ্ববর্তী ভারত, পাকিস্তান আফগানিস্তানের নারীদের তুলনায় উন্নত হয়েছে। কিন্তু অধিকারের সম্পূর্ণ সমতা আসেনি। চাকরির ক্ষেত্রে নারী সমান সুযোগ থেকে বঞ্চিত; নিম্ন আয়ের শ্রমজীবীদের মধ্যে নারী-পুরুষের চেয়ে কম মজুরি পান। স্থানীয় সরকার পর্যায়ে নারীর ক্ষমতায়নের চেষ্টা খুব ফলপ্রসূ হচ্ছে না। নারী জিডিপিতে বিরাট অবদান রাখছেন কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ নারী ভূমিজ এবং আর্থিক সম্পদবঞ্চিত। অন্যদিকে নারীর ক্ষমতা অর্জনের মাধ্যমে ক্ষমতায়িত আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আদায়ের সুযোগ সংকুচিত। এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে নারীদের জন্য উপযুক্ত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।  

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন