গ্রামীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের রূপকার কামরুল ইসলাম সিদ্দিক

সাইফ বাপ্পী

মাসেই পূর্ণ হচ্ছে স্বাধীনতার ৫০ বছর। মুক্তির সুবর্ণজয়ন্তীর কালে এসে দেশের নানা সফলতা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি চ্যালেঞ্জ নিয়ে নিয়মিত আয়োজন থাকছে বণিক বার্তায়। আজকের উপস্থাপনাটি আয়োজনেরই অংশ

একসময় গ্রামীণ সড়ক বলতে বোঝাত শুধু মেঠোপথ আর কাঁচা মাটির রাস্তাকে। কালের বিবর্তনে সে চেহারা এখন বদলেছে। পিচঢালা সড়কের ওপর এখন আর শহরের একচেটিয়া অধিকার নেই। গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ সড়কই এখন পাকা হয়েছে। সড়ক ধরে গ্রামীণ কৃষকের উত্পন্ন শস্য কৃষিপণ্য দ্রুততম সময়ের মধ্যে শহরাঞ্চলের বাজারে পৌঁছে যাচ্ছে। গত কয়েক দশকে গ্রামীণ যোগাযোগ ব্যবস্থার চেহারা বদলেছে আমূল। এর  ধারাবাহিকতায় আমূল পরিবর্তন এসেছে গ্রামাঞ্চলের স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সার্বিক অর্থনীতিতে।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের (এলজিইডি) হাত ধরে গ্রামীণ যোগাযোগ ব্যবস্থায় পরিবর্তন এসেছে। সংস্থাটিকে গড়ে তোলার বড় কৃতিত্ব দেয়া হয় এলজিইডির সূচনালগ্নের প্রধান প্রকৌশলী প্রয়াত কামরুল ইসলাম সিদ্দিককে। তাকে বলা হয় দেশের গ্রামীণ সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের অন্যতম প্রধান রূপকার।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু দেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু তার মৃত্যুর পর এসব উদ্যোগের বাস্তবায়ন থমকে দাঁড়ায়। আশির দশকে পরিস্থিতিতে পরিবর্তন আসতে থাকে। পরিবর্তনের সূচনা হয় এলজিইডির (তত্কালীন ওয়ার্কস প্রোগ্রাম উইং) হাত ধরে।

প্রকৌশলী কামরুল ইসলাম সিদ্দিকের কর্মজীবনের শুরু ১৯৬৭ সালে। ওই সময় কুষ্টিয়া জেলা পরিষদে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দেন তিনি। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে এপ্রিলে তিনি যুদ্ধে যোগ দেন। সময় যুদ্ধ করার পাশাপাশি বিভিন্ন রাস্তা সেতুর নকশা প্রণয়ন করে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন অপারেশনে প্রকৌশলী হিসেবেও তার ভূমিকা রাখেন।

স্বাধীনতার পর পল্লী কর্মসূচির উপপ্রধান প্রকৌশলী পরে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন সমবায় মন্ত্রণালয়ের অধীন নগর নির্মাণ কর্মসূচির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। মন্ত্রণালয়ের ওয়ার্কস প্রোগ্রাম উইংকে ১৯৮৪ সালে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল ব্যুরোয় (এলজিইবি) রূপ দেয়া হয়। কামরুল ইসলাম সিদ্দিক ব্যুরোর কার্যক্রমে ব্যাপক সংস্কার আনেন। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৯২ সালের আগস্টে এলজিইবি রূপ নেয় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরে (এলজিইডি) সে সময় সংস্থাটির প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন কামরুল ইসলাম সিদ্দিক। তার হাত ধরে দেশের গ্রামীণ যোগাযোগ ব্যবস্থার রূপান্তরে চালকের ভূমিকা নেয় এলজিইডি। ১৯৯৯ পর্যন্ত সংস্থাটির দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।

আর দুই-তিন বছরের মধ্যে অবসরে যাচ্ছেন এলজিইডির ডিজাইন বিভাগের মো. ফেরদৌস আলী। কামরুল ইসলাম সিদ্দিকের সঙ্গে সরাসরি দীর্ঘদিন কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, কামরুল ইসলাম সিদ্দিক বিশ্বাস করতেন, দেশের সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে গ্রামীণ অবকাঠামোর উন্নয়ন করতে হবে। ১৯৮০ সালে পল্লী পূর্ত কর্মসূচি উইংয়ে যোগ দেয়ার পর সে চিন্তা থেকেই তিনি কাজ করে গিয়েছেন। তার ভাবনা ছিল, শহরের সঙ্গে গ্রামের অবকাঠামোগত যোগাযোগ যদি তৈরি করা যায়, তাহলে প্রান্তিক জনগণের জীবনযাত্রায় পরিবর্তনের সুযোগ তৈরি হবে। এবং কৃষকও তার উৎপাদিত পণ্য দ্রুত শহরে নিতে পারবে। পণ্যের সঠিক মূল্যও পাবে। পল্লী পূর্ত কর্মসূচি এলজিইবিতে রূপ নেয়ার ক্ষেত্রেও তিনি ভূমিকা রেখেছিলেন। সে সময় সরকারের কাছে উপজেলা পর্যায়ে ব্যুরোর কার্যক্রম চালানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন তিনি। এর ভিত্তিতে সব উপজেলায় ব্যুরোর কার্যক্রম বিস্তৃত হয়। ফলে উপজেলা পরিষদের মধ্যে এলজিইবিরও কার্যালয় প্রতিষ্ঠা হলো। এর পর থেকেই গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর চাহিদা অনুযায়ী কার্যক্রম গ্রহণ বাস্তবায়ন সহজ হয়ে এল। জনগণও খুব দ্রুত এর সুফল পেল। ওই সময়ে তিনি যেখানে যে ধরনের প্রয়োজন, সে অনুযায়ী রাস্তাঘাট, কালভার্টসহ যোগাযোগ অবকাঠামো স্থাপন করা শুরু হলো। প্রান্তিক মানুষও খুব দ্রুত এর সুফল পেতে শুরু করল। উদ্যোগের সফলতার পর গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগের জন্য দাতাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করলেন তিনি। ওই সময় বিভিন্ন দাতা সংস্থার কাছ থেকে নেয়া অনুদান-ঋণের অর্থ কাজে লাগিয়ে প্রচুর উন্নয়ন কার্যক্রম হাতে নিয়েছেন তিনি। জনগণের মধ্যেও এলজিইবি অনেক জনপ্রিয়তা পেল। তখন তিনি আবার উদ্বুদ্ধ হলেন ব্যুরোকে অধিদপ্তরে রূপ দেয়ার বিষয়ে উদ্যোগ নিতে। নিয়ে আগেও সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন তিনি। এরপর ১৯৯২ সালে এলজিইবি রূপ নিল এলজিইডিতে। সে সময় প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে তার দেখানো পথ ধরেই উন্নয়ন কার্যক্রম চালিয়েছে এলজিইডি। বলা যায়, অনেকটা তার দেখানো পথ ধরেই বাংলাদেশের গ্রামীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা আজকের পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে।

কামরুল ইসলাম সিদ্দিকের সময়ে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে চালকের আসনে উঠে আসে এলজিইডি। তার সময়ে সংস্থাটি সরকারি বৈদেশিক অর্থায়নে অসংখ্য প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। পরস্পর সহযোগিতার মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এলজিইডির মধ্যে সমঝোতাও সই হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, এনজিও, স্থানীয় বাসিন্দা সুবিধাভোগীদের সমন্বয়ের ছাপ পড়ে এলজিইডির কার্যক্রমে। ভৌত অবকাঠামো নির্মাণের ফলে কেউ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে বিষয়েও সজাগ হয়ে ওঠে এলজিইডি। গ্রামীণ ভৌত অবকাঠামোর রক্ষণাবেক্ষণে যুক্ত করা হয় স্থানীয় জনগণকে। উন্নয়নকাজে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় স্থানীয়দেরই। অগ্রাধিকার পায় হতদরিদ্র নিঃস্ব নারীরা। অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি অনেকটা জনকল্যাণমূলক ভূমিকাও নিতে থাকে এলজিইডি।

উন্নয়ন গবেষক কিউআর ইসলাম মনে করেন, কামরুল ইসলাম সিদ্দিক বাংলাদেশের গ্রামীণ সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপ্লব এনে দিয়েছেন। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে সড়ক নির্মাণ নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ যে দরকার, সে বিষয়ও সরকারকে বোঝাতে পেরেছেন তিনি। একটা সময় ছিল যখন উন্নয়ন কার্যক্রমের পরিকল্পনা করা হতো শুধু উচ্চপর্যায়ে। কিন্তু তিনি একেবারে স্থানীয় পর্যায়ে প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে পরিকল্পনা করে প্রকল্প নিয়েছেন। এছাড়া এলজিইডিতে দক্ষ মানবসম্পদও তিনিই তৈরি করে দিয়েছেন। দক্ষ কর্মীদের বাছাই করে তাদের বাইরে পাঠানো, সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের উদ্যোগও তিনি নিয়েছেন।

এলজিইডিকে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে দায়বদ্ধ আধুনিক একটি সংস্থা হিসেবে গড়ে তোলার পেছনে কামরুল ইসলাম সিদ্দিকের অবদানকে এখনো স্মরণ করা হয়। তার সময়ে এলজিইডিতে ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমে (এমআইএস) গুরুত্ব দেয়া হয়। এতে করে কোথাও কোনো সমস্যা দেখা দিলে তাত্ক্ষণিকভাবে পরামর্শ প্রদান প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণও সহজ হয়। এর ফলে দ্রুত প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে বেশ সুনাম অর্জন করে এলজিইডি।

সহকর্মী প্রত্যক্ষদর্শীরা জানাচ্ছেন, কামরুল ইসলাম সিদ্দিক দায়িত্ব বণ্টন করতেন যোগ্যতা দক্ষতার ভিত্তিতে। তাদের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য যোগ্যতার ভিত্তিতে দেশ-বিদেশে প্রশিক্ষণ উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠানো হতো।

কামরুল ইসলাম সিদ্দিককে সামনে থেকে যারা দেখেছেন তারা জানাচ্ছেন, নতুন প্রযুক্তির ওপর তার বেশ আকর্ষণ ছিল। এলজিইডিতে জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেমের ব্যবহারও তার সময়েই শুরু হয়েছিল।

দেশে গ্রামীণ যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নে কামরুল ইসলাম সিদ্দিকের ভূমিকা অনস্বীকার্য বলে মনে করছেন তার সহকর্মীরা। তাদের মতে, সে সময় তিনি যে ভূমিকা রেখেছিলেন, তার সুবাদেই এলজিইডি গ্রামীণ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে চালকের আসনে উঠে আসতে পেরেছিল। তিনি ছিলেন এলজিইডিকে সফল একটি সরকারি অধিদপ্তর হিসেবে গড়ে তোলার অন্যতম কারিগর।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন