আইডিআরএ চেয়ারম্যানের ঘুষের অভিযোগ প্রত্যাহার

দুদককে বিবেচনায় না নেয়ার নির্দেশ উচ্চ আদালতের

নিজস্ব প্রতিবেদক

বীমা উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) চেয়ারম্যান . এম মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে ঘুষ দাবির অভিযোগ প্রত্যাহারের আবেদন বিবেচনায় না নিতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) নির্দেশ দিয়েছেন উচ্চ আদালত। কোম্পানিটির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া মো. কামরুল হোসেন মোল্লাহর বেঞ্চ সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দিয়েছেন।

আদেশের প্রত্যায়িত কপি পর্যালোচনায় দেখা যায়, ডেল্টা লাইফে আইডিআরএ কর্তৃক নিয়োগকৃত প্রশাসক তার নির্ধারিত দায়িত্বের বাইরে গিয়ে আইডিআরএ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে দায়ের করা ঘুষের অভিযোগ প্রত্যাহারের উদ্যোগ নিয়েছেন। ধরনের কর্মকাণ্ড তার কার্যপরিধির মধ্যে পড়ে না। ফলে আদালত প্রশাসককে দৈনন্দিন ব্যবসাসংক্রান্ত কার্যক্রমের বাইরে তার কার্যপরিধির আওতাবহির্ভূত সিদ্ধান্ত নেয়া থেকে নিবৃত থাকার আদেশ দিয়েছেন। তাছাড়া দুদকের কাছে আইডিআরএ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে দায়ের করা অভিযোগটি আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। অবস্থায় দুদককে অভিযোগ প্রত্যাহারের আবেদনটি বিবেচনায় না নেয়ার জন্যও নির্দেশনা দিয়েছেন উচ্চ আদালত।

দুদকের কাছে ডেল্টা লাইফের পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠানটির যুগ্ম নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট (জেইভিপি) পল্লব ভৌমিক আইডিআরএর চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে উেকাচ দাবির অভিযোগ করেছিলেন। আইডিআরএ কর্তৃক বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি ডেল্টা লাইফে প্রশাসক নিয়োগ করা হয় এবং তিনি সেদিন বিকালেই প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দায়িত্ব নেয়ার পর তিনি আইডিআরএ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ঘুষের অভিযোগ দায়েরের বিষয়টি খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নেন। এজন্য ডেল্টা লাইফের নির্বাহী পরিচালক চৌধুরী কামরুল আহসানকে আহ্বায়ক করে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটি বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি জেইভিপি পল্লব ভৌমিকের সাক্ষাত্কার নেয়। কমিটির কাছে তিনি জানান, ডেল্টা লাইফের অডিট কমিটির ৭৮তম সভার বিবিধ এজেন্ডার সিদ্ধান্ত অনুসারে তাকে আইডিআরএ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ দায়েরের দায়িত্ব দেয়া হয় এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে অভিযোগপত্রে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হয়। তিনি ভীত চাকরিচ্যুত হওয়ার ভয়ে দুদকে অভিযোগটি দায়ের করেন। বিষয়টি তিনি স্বেচ্ছায়, স্বজ্ঞানে এবং কারো মাধ্যমে প্ররোচিত না হয়ে তদন্ত কমিটির কাছে স্বীকার করেছেন এবং দুদকে দায়ের করা অভিযোগটি প্রত্যাহার করতে চান বলে কমিটিকে জানান। এর পরিপ্রেক্ষিতে কমিটি ডেল্টা লাইফের প্রশাসকের কাছে অভিযোগটি প্রত্যাহারের জন্য সুপারিশ করে। কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ডেল্টা লাইফের প্রশাসক সুলতান-উল-আবেদিন মোল্লা কোম্পানিটির পক্ষে অভিযোগ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেন। বিষয়ে প্রশাসকের লিখিত চিঠির ভিত্তিতে পল্লব ভৌমিক দুদকের কাছে অভিযোগ প্রত্যাহারের আবেদন করেন।

আইডিআরএ চেয়ারম্যান . এম মোশাররফ হোসেনের ঘুষ দাবির বিষয়টি সামনে আসে বছরের ফেব্রুয়ারি। এদিন ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির পক্ষ থেকে তার বিরুদ্ধে ৫০ লাখ টাকা উেকাচ দাবি-সংক্রান্ত কথোপকথনের রেকর্ডসহ সংবাদ সম্মেলন করে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ। ডেল্টা লাইফের অ্যাকচুয়ারিয়াল বেসিস অনুমোদন না করা, সিইওর নিয়োগ নবায়ন অনুমোদন নামঞ্জুরসহ বিভিন্ন অনিষ্পন্ন ইস্যুর সমাধানের জন্য কোম্পানিটির যুগ্ম নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট (জেইভিপি) আব্দুল আউয়াল আইডিআরএ চেয়ারম্যানের সঙ্গে আলোচনা করতে গেলে তিনি তার কাছে প্রাথমিকভাবে কোটি, পরবর্তী সময়ে কোটি এবং সর্বশেষ ৫০ লাখ টাকা উত্কোচ দাবি করেন। উেকাচ দাবিসংক্রান্ত কথোপকথনের রেকর্ডসহ গত বছরের ডিসেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাছে লিখিত অভিযোগ করে ডেল্টা লাইফ কর্তৃপক্ষ। দুদকের কাছে জমা দেয়া ডেল্টা লাইফের কর্মকর্তা আব্দুল আউয়ালের সঙ্গে আইডিআরএ চেয়ারম্যানের ১৯ মিনিট ৪০ সেকেন্ড মিনিট সেকেন্ডের দুটি অডিও ক্লিপের বক্তব্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ডেল্টা লাইফের বিভিন্ন ধরনের অনিয়মের বিষয়গুলোর সমাধানের জন্য তারা আলোচনা করছেন। আলোচনার একপর্যায়ে দাবীকৃত অর্থের বিষয়টি নিয়ে ডেল্টা লাইফের উদ্যোক্তা মনজুরুর রহমানের সঙ্গে আব্দুল আউয়ালকে কথা বলে তাকে জানানোর জন্য বলতে শোনা গেছে মোশাররফ হোসেনকে। অবশ্য কথোপকথনে দাবি করা অর্থ আইডিআরএর কাছে ডেল্টা লাইফের বিরুদ্ধে যারা অভিযোগ করেছেন তাদের দেয়ার জন্য নিতে চাইছেন বলে জানান . মোশাররফ। সময় নামোল্লেখ না করে একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির রেফারেন্স দিয়ে তাকে বারবার স্যার সম্বোধন করে অর্থ তার জন্য নেয়া হচ্ছে বলে আব্দুল আউয়ালকে বলেন তিনি।

অন্যদিকে ঘুষ দেয়ার প্রস্তাবসহ মিথ্যা অপবাদ দেয়া কূটকৌশলের মাধ্যমে মানহানি করার প্রচেষ্টার কারণে ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সাবেক চেয়ারম্যান মনজুরুর রহমান তার মেয়ে কোম্পানিটির সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আদিবা রহমানসহ কোম্পানিটির আরো চার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ২৫ কোটি টাকার মানহানির মামলা করেছেন আইডিআরএ চেয়ারম্যান . এম মোশাররফ হোসেন। অন্যদিকে তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত ঘুষের অভিযোগ তদন্তে সম্প্রতি তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।

কমিটির প্রধান করা হয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব এবিএম রুহুল আজাদকে। আর সদস্য হিসেবে রয়েছেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্ম সচিব মৃত্যুঞ্জয় সাহা এবং বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) মহাব্যবস্থাপক মো. জাকির হোসেন চৌধুরী। কমিটিকে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

ডেল্টা লাইফের সঙ্গে আইডিআরএর দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয় যখন সংস্থাটি কোম্পানির বিভিন্ন বিষয় খতিয়ে দেখার জন্য দুটি নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেয়ার পর থেকেই। ২০১৯ সালে আইডিআরএ হাওলাদার ইউনূস অ্যান্ড কোম্পানি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসকে বিশেষ নিরীক্ষা এবং ফেমস অ্যান্ড আর চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসের মাধ্যমে অনুসন্ধানী নিরীক্ষা করায়। দুই প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষায় ৪৭টি আপত্তি উঠে আসে। তাছাড়া গুরুতর ১০টি বিষয় চিহ্নিত করে বিষয়ে অধিকতর তদন্তের সুপারিশ করেন নিরীক্ষক। নিরীক্ষা আপত্তির বিষয়ে ডেল্টা লাইফের কাছে ব্যাখ্যা তলব করে আইডিআরএ এবং কোম্পানিটির পক্ষ থেকে পাঠানো জবাব সংস্থাটির কাছে সন্তোষজনক মনে হয়নি। এর পরিপ্রেক্ষিতেই কোম্পানিটিতে প্রশাসক নিয়োগের পথ প্রশস্ত হয়। অবশ্য আইডিআরএর পাশাপাশি অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে সম্প্রতি ডেল্টা লাইফে বিশেষ নিরীক্ষা করার জন্য ম্যাবস অ্যান্ড জে পার্টনার্স চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসকে নিয়োগ দিয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এর পাশাপাশি ডেল্টা লাইফে আইডিআরএ কর্তৃক নিয়োগকৃত প্রশাসকের পক্ষ থেকে কোম্পানিটির আর্থিক নিরীক্ষা করার উদ্যোগ নেয়া হবে।

বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি পলিসিহোল্ডারদের স্বার্থরক্ষায় ডেল্টা লাইফের পর্ষদকে বরখাস্ত করে প্রশাসক নিয়োগ দেয় আইডিআরএ। সংস্থাটির সাবেক সদস্য সুলতান-উল-আবেদিন মোল্লাকে কোম্পানিটির প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়। প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর তিনি দুদকের কাছে কোম্পানির দায়ের করা অভিযোগ প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেন। প্রশাসকের লিখিত নির্দেশনার ভিত্তিতে ডেল্টা লাইফের যে কর্মকর্তা এর আগে দুদকের কাছে আইডিআরএ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ঘুষ দাবির অভিযোগ করেছিলেন তাকে দিয়েই আবার অভিযোগটি প্রত্যাহার করা হয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন