ঐতিহাসিক ভাষণ

শুধু স্বাধীনতা অর্জনই নয় দেশ গড়ার নির্দেশনাও ছিল

ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন

১৯৭১ সালে মার্চ শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের দৃষ্টি ছিল বঙ্গবন্ধুর ওপর। সারা বিশ্ব সেদিন আবাক বিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করল একটি ভাষণ একটি জাতিকে কতটুকু আন্দোলিত করতে পারে। মানুষের মধ্যে কেমন তীব্র প্রণোদনা সৃষ্টি করতে পারে। সংগ্রামরত মানুষকে সেদিন এই ভাষণ স্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছিল। বাঙালির স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যটি ভাষণের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

একটি ভাষণ একটি জাতির ইতিহাসে বড় রকমের বাঁক পরিবর্তনের সূচক হতে পারে এমন দৃষ্টান্ত বিরল। অনেকে বঙ্গবন্ধুর মার্চের ভাষণকে আব্রাহাম লিঙ্কনের গেটিসবার্গ অ্যাড্রেসের সঙ্গে তুলনা করে। কিন্তু অন্তত দুটি কারণে এই তুলনা অযৌক্তিক অপ্রাসঙ্গিক। এক. আব্রাহাম লিঙ্কনের ভাষণটি ছিল লিখিত আর বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ছিল অলিখিত, স্বতঃস্ফূর্ত। দুই. তাত্ক্ষণিক সুদূরপ্রসারী প্রভাবের বিচারে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ছিল অনন্য।

স্মৃতির পথ ধরে পেছনে গিয়ে আজও যেন অবলোকন করি মার্চ রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধুর বিলম্বিত উপস্থিতির জন্য উত্কণ্ঠিত বিশাল জনসমুদ্র। উত্কণ্ঠা অনেক কিছু নিয়েই ছিল। অনেক প্রশ্ন ছিল সেদিন রেসকোর্সে সমবেত মানুষের মনে। বঙ্গবন্ধু আসতে পারবেন তো? বঙ্গবন্ধুর জীবন সংশয় হবে না তো? বঙ্গবন্ধু কী বলবেন? তিনি কি সরাসরি স্বাধীনতার ডাক দেবেন? এমনি অসংখ্য প্রশ্নে আন্দোলিত ছিল মানুষের মন। তবে এটি সবাই বুঝতে পেরেছিল যে বাঙালি আর পেছনে ফিরে তাকাবে না, প্রস্তুত ছিল লড়াই করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য, স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে আনার জন্য। জনতার কাতার থেকে উঠে আসা জননায়ক বঙ্গবন্ধু জনতার মানসিকতা সম্পর্কে সম্যক অবহিত ছিলেন এবং তারই প্রতিফলন ছিল মার্চের ভাষণে।

বঙ্গবন্ধু যখন অবশেষে এলেন, সরাসরি মঞ্চে উঠে অধীর আগ্রহে/উত্কণ্ঠায় অপেক্ষমাণ জনতার মুখোমুখি হলেন, তখন লক্ষ কণ্ঠের গগণবিদারী স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠল রেসকোর্সের ময়দান। স্লোগানের ভাষাই বলে দিয়েছিল সেদিন বাঙালি কিসের জন্য প্রস্তুত ছিল: জয় বাংলা, জয় বাংলা/ আপস না সংগ্রাম-সংগ্রাম, সংগ্রাম/ তোমার দেশ, আমার দেশ-বাংলাদেশ, বাংলাদেশ/ বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর। জনতার আর জননায়কের মানসিকতার মেলবন্ধনের এক অপূর্ব প্রতিফলন হিসেবে উচ্চারিত হলো মার্চের ভাষণ।

সে এক অবিস্মরণীয় ভাষণ। লক্ষণীয় ছিল ভাষণ আর ভাষক উভয়েই। ভাষণে যা বলা হয়েছিল তার মধ্য দিয়ে সুগভীর এবং ব্যাপক বার্তা পৌঁছে দেয়া হয়েছিল সংশ্লিষ্ট সব মহলের কাছে। অলিখিত ১৯ মিনিটের ভাষণের প্রতিটি শব্দ বাক্য উচ্চারিত হয়েছিল যেন সুনিপুণ এক কথার কারিগরের মুখ থেকে। বার্তা ছিল নির্যাতিত সংগ্রামী বাঙালির জন্য, বার্তা ছিল পাকিস্তানি শাসক চক্রের জন্য, বার্তা ছিল বিশ্ববাসীর জন্য। অন্যদিকে ভাষকের অপূর্ব অভিব্যক্তি, অঙ্গসঞ্চালন বা যাকে বলে বডি ল্যাঙ্গুয়েজ তার মধ্য দিয়ে ভাষণটি বঙ্গবন্ধুকে পরিণত করেছিল রাষ্ট্রনায়কোচিত ভূমিকার এক অনতিক্রম্য দৃষ্টান্তে। অতীত প্রেক্ষাপটের সঠিক বিশ্লেষণ, বিরাজমান পরিস্থিতির যথার্থ মূল্যায়ন এবং প্রাসঙ্গিক ভবিষ্যৎ দৃষ্টিএসবই ছিল ভাষণটির বৈশিষ্ট্য। সংক্ষিপ্ত সময়ে এক উত্তাল প্রেক্ষাপটে প্রচণ্ড মানসিক ধৈর্য না থাকলে এমন একটি ভাষণের উচ্চারণ সম্ভব নয়।

ভাষণটির প্রতিটি শব্দ/বাক্য নিয়ে গবেষণা হতে পারে, উচ্চারণ করা যেতে পারে বিশ্লেষণাত্মক মন্তব্য। অবশ্য তার জন্য প্রয়োজন বিস্তৃত পরিসর, যা এই লেখায় সম্ভব নয়। বিশেষ টি অংশের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে মাত্র।

ভাষণের একটি অত্যন্ত তাত্পর্যপূর্ণ বাক্য: আমার ওপর বিশ্বাস আছে? জনতা তখন বাঁশের লাঠিসমেত হাত শূন্যে তুলে কণ্ঠের আওয়াজ দিয়ে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছিল। সেই মুহূর্তে তাঁর মতো নেতার জন্য এমন প্রশ্ন উচ্চারণের প্রয়োজন ছিল কি? যুক্তিগ্রাহ্য বিশ্লেষণে এমন কোনো প্রয়োজন নির্দেশ করা সম্ভব নয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু যখন এক চরম ক্রান্তিলগ্নে জনতার কাছে প্রশ্নটি রেখেছিলেন তখন তাঁর দুটো নিহিতার্থ তাত্পর্য নির্দেশ করা যায়। এক. তিনি যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন তা দেয়ার অধিকার আছে কিনা তা উপস্থিত সবাইকে জানিয়ে দেয়া। দুই. সারা বিশ্বের কাছে বার্তাটি পৌঁছে দেয়া যে তিনিই বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। প্রশ্নের ইতিবাচক উত্তর পেয়েই বঙ্গবন্ধু চরম সিদ্ধান্ত দিলেন: রক্ত দিয়েই রক্তের ঋণ শোধ করতে হবে। অর্থাৎ বাঙালির আগামী কী হতে যাচ্ছে তা সেই মুহূর্তেই নির্ধারিত হয়ে গেল। তবে বিচক্ষণতা দূরদৃষ্টি নিয়ে চূড়ান্ত কর্মসূচির পটভূমি হিসেবে নির্দেশ দিলেন সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের। অভিজ্ঞ বিচক্ষণ সেনানায়ক শুরুতে কখনই তার চরম কৌশল অস্ত্র প্রয়োগ করেন না।

বাঙালির আসন্ন সংগ্রামের রূপরেখা কৌশলও তুলে ধরা হয়েছিল ভাষণে। সত্যি কথা বলতে কী বাঙালি তখনো একমাত্র ইস্পাতদৃঢ় রাজনৈতিক প্রণোদনা ব্যতীত আর কিছু নিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত ছিল না। তাই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ ছিল ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করার। যুদ্ধের কৌশল হিসেবে তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন শত্রুকে ভাতে পানিতে মারার। অর্থাৎ তিনি ডাক দিয়েছিলেন জনযুদ্ধের, গেরিলা যুদ্ধেরকনভেনশনাল যুদ্ধের নয়। কারণ তা ছিল অবাস্তব। আমাদের নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের কৌশলও ছিল তা-ই। যেকোনো জনযুদ্ধের সামরিক সংগঠন নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সংগঠন নেতৃত্ব। সেজন্য ভাষণে নির্দেশ ছিল সারা বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হওয়ার। তবে ভাষণে অংশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উচ্চারণটি ছিল: আমি যদি হুকুম দেবার না- পারি, তোমরা সব বন্ধ করে দেবে। অবিস্মরণীয় এক দিব্যদৃষ্টিতে যেন নেতা অবলোকন করেছিলেন চরম মুহূর্তে তার অনুপস্থিতি এবং সেই মুহূর্তে বাঙালির কী করণীয় তার নির্দেশ তিনি আগেই দিয়ে গেলেন। পরবর্তীকালে বাস্তব পরিস্থিতি হয়েছিলও তাই।

স্বাধীনতার লক্ষ্য নির্ধারক বেশকিছু বক্তব্য আছে ভাষণে। যেমন সাত কোটি মানুষকে আর দাবায়ে রাখতে পারবা না। এবং এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম বা দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশা আল্লাহ। এমনি সব উচ্চারণের বেশকিছু দিক বিবেচ্য। তাত্ক্ষণিক স্বাধীনতা ঘোষণা বা ইউনিল্যাটারাল ডিক্লারেশন অব ইনডিপেন্ডেন্সের জন্য বঙ্গবন্ধুর ওপর বেশ চাপ ছিল। অন্যদিকে তা করলে তাত্ক্ষণিক কী ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া হতে পারত তা- বঙ্গবন্ধু জানতেন। এমনি একটি কঠিন পরিস্থিতিতে তিনি যা বললেন তা সরাসরি তাত্ক্ষণিক স্বাধীনতা ঘোষণা না করলেও স্বাধীনতা ঘোষণার স্পষ্ট ইঙ্গিত তিনি দিলেন। সার্বিক পরিস্থিতি সম্যক অবহিত কোনো বাঙালি বা বিদেশীর কাছে ভাষণের নিহিতার্থ দুর্বোধ্য থাকেনি সেদিন। আরো একটি লক্ষণীয় দিক হলো, প্রমিত বাংলা উচ্চারণের পাশাপাশি আঞ্চলিক কথ্য ভাষার ব্যবহার। দুটো ব্যাখ্যা হতে পারে। এক. আবেগতাড়িত চরম মুহূর্তে সহজ স্বতঃস্ফূর্ত নিজস্ব আঞ্চলিক ভাষার উচ্চারণ। দুই. ভাষণের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো সাধারণ জনগণের কাছে সহজে বোধগম্য করার জন্য তাদের ভাষা ব্যবহার।

ভাষণ শেষে মার্চের ভাষণ হয়ে উঠেছিল সংগ্রামী বাঙালির শাণিত চেতনার এক সুতীক্ষ হাতিয়ার। এই হাতিয়ার সেদিন সারা দেশের মানুষকে প্রণোদিত করেছিল স্বাধীনতা মুক্তির লক্ষ্যে। চূড়ান্ত বিশ্লেষণে মার্চের ভাষণে দুটো তাত্পর্য নির্দেশ করা যায়। প্রথমত, নিকট আগামীর লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারিত হয়েছিল রাজনৈতিক স্বাধীনতা। দ্বিতীয়ত, সুদূর আগামীর লক্ষ্য ছিল মুক্তি। মুক্তি স্বাধীনতার চেয়েও ব্যাপক বহুমাত্রিক। সে কারণেই মুক্তি উচ্চারিত হয়েছে প্রথম, স্বাধীনতা তারপর। অর্থাৎ শুধু স্বাধীনতা অর্জনই নয়, বরং সে দেশ গড়ারও দিকনির্দেশনা ছিল ঐতিহাসিক মার্চের ভাষণে।

 

. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন: ইতিহাসবিদ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের সাবেক অধ্যাপক বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের বঙ্গবন্ধু চেয়ার

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন