ঐতিহাসিক ৭ মার্চ

নতুন প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকুক

মার্চ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় একটি দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার চূড়ান্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন। রেসকোর্স ময়দানে দেয়া সংক্ষিপ্ত ভাষণে তিনি তেজোদীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন—‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভাষণ প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল। ঐতিহাসিক ভাষণ এখন বিশ্ব গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের অংশ। ভাষণে দুটো বিষয় প্রণিধানযোগ্য ছিলস্বাধীনতা মুক্তি। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি; পেয়েছি পরাধীনতামুক্ত সার্বভৌম এক রাষ্ট্র। কিন্তু দুঃখজনকভাবে স্বাধীনতার ৫০ বছরেও সর্বজনীনভাবে অর্থনৈতিক সামাজিক মুক্তি আসেনি। মানুষে মানুষে সম্পদে, সুযোগ-সুবিধায় বড় ফারাক রয়ে গেছে। এটি বঙ্গবন্ধুর বৈষম্যহীন সোনার বাংলা গড়ার পরিপন্থী। সেদিক থেকে মার্চের ভাষণ আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। 

সন্দেই নেই, কয় বছরে অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি বিস্ময়জাগানিয়া। আর্থসামাজিক সূচকগুলোয় দক্ষিণ এশিয়ার বেশির ভাগ দেশকে ছাড়িয়েছে আমাদের দেশ। কভিড মহামারীতে কিছুটা হোঁচট খেলেও জিডিপির হার ঊর্ধ্বমুখী। পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে নিজস্ব অর্থায়নে। এটি আর্থিক সক্ষমতার পরিচায়ক। আরো কিছু বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের পাশাপাশি ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজ চলছে। বিষয়গুলো নানামুখী অর্জন অগ্রগতিকে দৃশ্যমান করে। প্রবৃদ্ধির সঙ্গে মাথাপিছু আয় বাড়ছে। এরই মধ্যে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে চূড়ান্ত সুপারিশ পেয়েছে বাংলাদেশ। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার পথে অগ্রসর হচ্ছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, যাতায়াত পরিবহন খাতে উন্নয়নের পাশাপাশি জ্বালানি বিদ্যুৎ খাতের অগ্রগতি হয়েছে। দেশের প্রায় সব জায়গা ইন্টারনেটের আওতায় এসেছে। তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার মানুষের কাজকর্মে যোগ করেছে নতুন গতি। উন্নতির পেছনে কাজ করেছে সাধারণ মানুষের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা আর সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ।

অন্যদিকে কিছু ক্ষেত্রে শঙ্কার জায়গা চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। দেশের মোট আয়ের বড় অংশ ১০ শতাংশ ধনীর দখলে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান্তরালে বাড়ছে মানুষে মানুষে সম্পদ আয়বৈষম্য, যা উন্নয়ন সুফলের সুষম বণ্টন প্রশ্নবিদ্ধ করে। আজও মুষ্টিমেয় লোকের হাতে পুঞ্জীভূত সম্পদ-আয়ের বিপুলাংশ। অব্যাহত প্রচেষ্টায় দারিদ্র্য কমলেও এখন এর গতি অনেকটাই শ্লথ। সরকারি হিসাবে চার কোটি মানুষ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে। পুষ্টির অভাবে ভুগছে অনেক মা শিশু। কভিডের কারণে দারিদ্র্য পুষ্টিহীনতা আরো বেড়েছে বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে আসছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কভিড-১৯ মহামারী চ্যালেঞ্জ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। রফতানিতে বৈচিত্র্যের অভাব রয়ে গেছে। গুটিকয়েক চলকের ওপর নির্ভর করে অর্থনীতি এগোচ্ছে। ভৌত অবকাঠামোয় দৃশ্যমান উন্নতি ঘটলেও আইনকানুন-পদ্ধতি-প্রক্রিয়ার মতো অভৌত অবকাঠামোয় অসংগতি-দুর্বলতা বিদ্যমান। বিশ্বব্যাংকের ডুয়িং বিজনেস সূচকে আমরা এখনো পিছিয়ে। বিনিয়োগ-ব্যবসা করতে গেলে হয়রানির শেষ নেই। সরকারি অফিসের সেবার মানও সন্তোষজনক নয়। আছে দক্ষ মানবসম্পদের অভাব। কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে এগোতে হলে এসব ক্ষেত্রে উন্নতি করতে হবে। গুণগত শিক্ষা স্বাস্থ্যসেবা, রফতানি বহুমুখীকরণ, কর্মপরিবেশের উন্নয়ন, প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে হবে। জনমানসিকতায়ও আনতে হবে পরিবর্তন।

অস্বীকারের উপায় নেই, মার্চের ভাষণ বাঙালি জাতিকে সার্বিক অর্থে মুক্তির দিশা দিয়েছিল। ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমরা এখনো অর্থনৈতিক সামাজিক মুক্তির সংগ্রাম করছি। দারিদ্র্য, বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়ছি। এটিকে আরো বেগবান করতে হবে। নিছকই পালনের নয়, ঐতিহাসিক ক্ষণের চেতনাকেও সমুুন্নত করতে হবে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরটি একদিকে যেমন উৎসবের, একই সঙ্গে চ্যালেঞ্জেরও। মহামারী-পরবর্তী অভিঘাত থেকে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়ায় আছে। রফতানি আয়সহ বহিঃস্থ খাতের দিক থেকে চাপ এখনো কমেনি। এটি মাথায় রেখে ব্যাংকিংসহ বেশকিছু খাতে বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন। নতুবা ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বাংলাদেশের বিশ্ব প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। মার্চের ধারাবাহিকতায় যে লক্ষ্য উদ্দেশ্য সামনে রেখে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল, তা এখনো পুরোপুরি অর্জিত হয়নি। সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। মুক্তিযুদ্ধের মর্মমূলে ছিল ন্যায়পরায়ণতা, নাগরিকদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, অধিকারের সমতা, পরমতসহিষ্ণুতা; যা পাকিস্তান রাষ্ট্রে সম্ভব ছিল না। ঐতিহাসিক দিনটির ৫০তম বার্ষিকীতে উল্লিখিত ক্ষেত্রগুলোয় উন্নতি ঘটিয়ে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ, বৈষম্যহীন ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠাই হোক রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার। এই ঐতিহাসিক ক্ষণটি দেশপ্রেম সংগ্রামী চেতনা উজ্জীবনে নতুন প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকুক।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন