স্বাধীনতার ৫০

উপেক্ষিত ভাষানীতি ও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা

মাছুম বিল্লাহ

আমরা এবার (২০২১) ভাষা আন্দোলনের ৬৯ বছর আর স্বাধীনতার ৫০ বছর পালন করছি। এই দীর্ঘ পথপরিক্রমায়ও আমরা তৈরি করতে পারিনি একটি ভাষানীতি, অথচ ভাষার জন্য আন্দোলনের মতো ঘটনা এবং আত্মাহুতি দেয়া পৃথিবীর ইতিহাসে দ্বিতীয়টি আর সেভাবে নেই। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা আছে কিন্তু উচ্চ আদালত, ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে ইংরেজি ব্যবহূত হচ্ছে। ভাষানীতি না থাকার ফলে হারিয়ে যেতে বসেছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নিজস্ব ভাষা। ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, রাশিয়া, চীন, জাপান, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া দক্ষিণ আমেরিকার রাষ্ট্রগুলোয় নিজস্ব ভাষানীতি রয়েছে। এমন নীতি নেপালেও রয়েছে। তাদের উচ্চ আদালতের রায় নেপালের মাতৃভাষায় দেয়া হয়। আমরা সেটি এখনো পারিনি। জানা যায়, শতাধিক বিচারপতির মধ্যে পর্যন্ত নাকি মাত্র ১২ জন বাংলায় রায় দিয়েছেন, আর নিয়মিত দেন একজন বিচারপতি। একজন নিয়মিত দিচ্ছেন, ১২ জন কখনো কখনো দিয়েছেন, তাহলে বাকিরা কেন দিচ্ছেন না? এখানে তো সরকারের হস্তক্ষেপ নেই বা কোনো ধরনের চাপ নেই। জাতীয় মামলার রায় এখানকার বিচারপতিরা চাইলেই তো বাংলায় দিতে পারেন।

দক্ষিণ আফ্রিকার ভাষানীতি হচ্ছে, নিজস্ব ভাষা ইংরেজি দুটোই তাদের অফিশিয়াল ভাষা। এটি অত্যন্ত স্মার্ট সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। ভাষানীতিসরকার আইনানুগভাবে সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে দেশের মধ্যে একটি ভাষা কিংবা একাধিক ভাষাগুলোর মধ্যে কোনটির অবস্থান কী রকম হবে, কোন ভাষা কোথায় ব্যবহূত হবে, কীভাবে ব্যবহূত হবে, কোন ভাষা কীভাবে কত সময়ের মধ্যে শেখানো হবেবিষয়গুলো নির্ধারণ করে দেয়। আমাদের ভাষানীতি না থাকার ফলে যেটি হয়েছে বিশ্বায়নের প্রভাবে এবং সত্যিকার অর্থে বাস্তবিক কারণেই সমাজের একটি শ্রেণী, যদিও তাদের সংখ্যা খুবই কম, শিশুদের ইংরেজি মিডিয়ামে পড়াচ্ছেন। এটি নিয়ে অনেকেই অনেক উদ্বেগ প্রকাশ করেন। উদ্বেগ প্রকাশ করার মতো কোনো ঘটনা এখানে দেখি না, কারণ ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয় দেশে কয়টি আছে? ঢাকা সিটিতে কয়েকটি আর বিভাগীয় শহরগুলোয় দু-একটি আছে। এগুলো বাংলাদেশী মালিকানাধীন। এগুলো যদি না থাকত বিদেশীরা এসে কিংবা ব্রিটিশ কাউন্সিল নিজেই এই শ্রেণীর চাহিদা মেটানোর জন্য ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয় খুলে দিত। ইংরেজি মাধ্যমে বিষয়গুলো ইংরেজিতে পড়ানো হয় কিন্তু বাংলাও পড়ানো হয়। লেভেল, লেভেলে বাংলায় পরীক্ষা হয়। বাঙালিরাই সেই খাতা মূল্যায়ন করেন।

ইংরেজি ভাষা শিখলে যে বাংলা শিখব না বা বাংলাকে অবজ্ঞা করব, তা তো নয়। আমাদের দেশের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদদের মধ্যে যারা অধিকাংশ লেখা বাংলাতেই লেখেন, তাদের মধ্যে অনেকেই ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা করেছেন। যেমন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, মনজুরুল ইসলাম, প্রয়াত জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী প্রমুখ। একটি আন্তর্জাতিক ভাষা জানা মানে বিশ্বসাহিত্যের রস সহজেই আস্বাদন করা যায়, দেশীয় সাহিত্যে প্রবেশ করানো যায়। এখানে দেখা যাচ্ছে যে যারা ইংরেজি ভালো জানেন, তারা ভালো বাংলাও জানেন। শুধু কি তাই? আমরা তো জানি, ভাষাগত দুর্বলতার কারণে আমাদের দেশের শিক্ষক থেকে শুরু করে ডাক্তার, টেকনিশিয়ান, শ্রমিক সবাই আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর পেশাজীবী, যারা মধ্যপ্রাচ্যসহ উন্নত বিশ্বে আছেন বা কাজ করছেন, তাদের চেয়ে অনেক কম বেতন পান। শুধু ইংরেজি কেন? মধ্যপ্রাচ্যে যারা চাকরি করেন, তাদের যদি আরবি ভাষা জানা থাকত, তাদের বেতন নিশ্চয়ই বেশি হতো। একথা কি আমরা অস্বীকার করতে পারব যে আমাদের দেশের প্রায় কোটি মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আছে বলেই দেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরছে, যা দিয়ে আমরা অনেকেই অনেক বড় বড় কথা বলি। এখন চীনে আমাদের অনেকেই ব্যবসা করতে গেছেন এবং যাচ্ছেন। চীনের সঙ্গে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য চলছে। বহু শিক্ষার্থী সেশনজট এড়াতে চীনে পড়াশোনা করতে যায়। চীনে গিয়ে দেখলাম তারা চীনা ভাষা শিখছেন। ভাষাটি যদি তারা দেশে বসে শিখতেন তাহলে সেখানে যাওয়াটা এবং তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য আরো ভালো চলত। একটি বিদেশী ভাষা জানা মানে নিজ ভাষাকে অবজ্ঞা করা নয়। একটি ভাষা জানা মানে সুযোগ সম্ভাবনার বহু দ্বার উন্মুক্ত করা। জাপানি সাহিত্যে হারুকি মুরাকামির নতুন নতুন উপন্যাস সম্পর্কে আমরা কীভাবে জানব? জাপানি ভাষা শিখে? ইংরেজি জানলে সেই উপন্যাস আমরা পড়তে পারি, নিজের দেশের পাঠকদের জন্য অনুবাদ করতে পারি। পত্রিকার পাতায় প্রায়ই দেখি যে ইংরেজি মাধ্যম পড়ুয়ারা বাংলা ভাষাকে ডোবাচ্ছে-জাতীয় কথা সরাসরি কিংবা পরোক্ষভাবে বলছেন, তাদের খেয়াল রাখতে হবে ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ের সংখ্যা রেজিস্ট্রার্ড ১৫৯টি, এর বাইরে হয়তো আরো -খানেক হবে। তবে সবগুলোয় কিন্তু লেভেল এবং লেভেল নেই। এর মধ্যে হাতেগোনা দু-চারটি ছাড়া শিক্ষার্থীরা স্বাচ্ছন্দ্যে ইংরেজি বলতে পারে না।

স্বাধীনতার পর এখন পর্যন্ত কোনো ভাষা জরিপ হয়নি। জানা যায় ১৯৬২ সালে বাংলা একাডেমি থেকে আঞ্চলিক ভাষার জরিপ কার্যক্রমের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। ভাষাবিদ . মুহম্মদ শহীদুল্লাহর উদ্যোগে কার্যক্রম শুরুর পর জরিপের প্রশ্নমালাও তৈরি করা হয়। পরে শিক্ষাবিদ গবেষক অধ্যাপক . মোহাম্মদ আবদুর কাইউম তিনটি উপজেলায় প্রশ্নমালার ভিত্তিতে জরিপও করেন। তবে ওই কার্যক্রম পরে সফলতার মুখ দেখেনি। আমাদের মনে রাখতে হবে ভাষা পরিস্থিতি সতত পরিবর্তনশীল। কোনো নির্দিষ্ট দেশের ভাষা পরিস্থিতি কখনো স্থির থাকে না। কিন্তু ভাষা পরিস্থিতিতে যে পরিবর্তন ঘটে, তা সে দেশের সমাজ সংস্কৃতির অনুকূলেও ঘটতে পারে, আবার প্রতিকূলেও ঘটতে পারে। অনুকূলে ঘটলে তা গ্রহণযোগ্য হয়। ভাষা সংস্কৃতি নিয়ে এখন বাংলা একাডেমির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটও কাজ করছে। বাংলা ভাষা সর্বস্তরে প্রচলনের জন্য স্বাধীনতার পর থেকে এক ডজনেরও বেশি আদেশ, পরিপত্র বা বিধি জারি করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও রাষ্ট্রভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়নি। দুটি প্রতিষ্ঠান বাংলা ভাষা প্রচলনে কতটুকু জোরালো ভূমিকা পালন করছে তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। বাংলাকে সর্বস্তরে প্রচলনের ব্যাপারে কিংবা বাংলাকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কতটা নিয়ে যেতে পেরেছে, সে প্রশ্ন এখন আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

যেকোনো ভাষায় নতুন নতুন শব্দ সংযোজন ঋণাত্মক নয়, ধনাত্মক; যদি তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত না হয়। তবে ভাষাকে শব্দভাণ্ডারে সমৃদ্ধ করে। বাংলা ভাষায় বহু ভাষার শব্দ মিশে গেছে। খাঁটি বাংলা শব্দের সংখ্যা একেবারেই হাতেগোনা। বাংলা ভাষার মূল শব্দসম্ভার এসেছে মূলত সংস্কৃত (তৎসম, অর্ধতৎসম, তদ্ভব) আর বিদেশী ভাষা থেকে। নানা ভাষা থেকে শব্দ নিয়ে, প্রকাশভঙ্গি নিয়ে একটা ভাষা সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। সময় যায়, একটা ভাষা তার ব্যবহূত কিছু শব্দ বাতিল করে, গ্রহণ করে নতুন শব্দ। শব্দ গ্রহণ-বর্জন সবসময় যে বিকল্প শব্দ থাকা বা না-থাকার কারণে হয়, তা নয়; হয় ব্যবহারের প্রয়োজনে। ভাষার শব্দ শুধু মনের ভাব প্রকাশ করলেই হয় না, সেটা ব্যবহারে আরাম হয় কিনা, সেটিও খুব গুরুত্বপূর্ণ। আবার যেসব শব্দ বাংলায় জায়গা করে নিয়েছে, সেগুলোকে বাংলায় লিখতে বা বলতে গেলে কতটা স্বাচ্ছন্দ্য আমরা বোধ করব, সেটিও একটি প্রশ্ন। যেমন স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি শব্দগুলোর ভালো বিকল্প বাংলা শব্দ আছে, যথাক্রমে বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু আমরা কয়জন শব্দগুলোর বাংলা বলি? একজন মূর্খ লোককেও যদি বলা হয় মহাবিদ্যালয়, তিনিও হয়তো ভাববেন এটি একটি বিদেশী শব্দ। কারণ তিনি কলেজই জানেন। সর্বস্তরে বাংলা চালু করতে এগুলো কোনো সমস্যা নয়। আমি তো অবাক হয়ে যাই, অনেক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাদের বাংলা পাঠ্যবই ভালোভাবে পড়তে পারে না। তারা ইংরেজি পড়ছে বলে কি তা হয়েছে? তারা ইংরেজিও পড়তে পারে না। বিষয়গুলো গভীরভাবে দেখতে হবে, ব্যবস্থা নিতে হবে বিদ্যালয় পর্যায় থেকেই। একটি ভাষা কমিশন গঠন করে আমাদের ভাষানীতি প্রণয়ন করতে হবে, যাতে বিষয় নিশ্চিত হয় যে আমরা সবাই সঠিকভাবে বাংলা পড়তে, লিখতে বলতে পারি এবং বিদেশী ভাষা কোনটি বা কয়টি কীভাবে, কত সময়ের মধ্যে এবং কোন বয়সে শিখব।

 

মাছুম বিল্লাহ: শিক্ষা গবেষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন