অ্যান্টিবায়োটিকের অনিয়ন্ত্রিত প্রয়োগ রোধ

চিকিৎসকের দায়িত্বশীল ভূমিকা ও জনসচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন

দেশে নানাভাবে অ্যান্টিবায়োটিকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার হচ্ছে। এর মধ্যে একটি হলো সম্পূর্ণ কোর্স শেষ না করা। সেবনের পর একটু ভালো বোধ করলেই অনেক রোগী অ্যান্টিবায়োটিক মাঝপথে বন্ধ করে দেয়, নির্দিষ্ট কোর্স শেষ করে না। গতকাল বণিক বার্তায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, যথানিয়মে অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স শেষ করে না দেশের ৪১ শতাংশ রোগী। এটি উদ্বেগজনক তথ্য বৈকি। কোর্স শেষ না করলে সুনির্দিষ্ট অ্যান্টিবায়োটিক রোগীর দেহে বিশেষ ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণু প্রতিরোধী হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে ওই জীবাণুর বিরুদ্ধে আর অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করে না। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় যাকে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়েল রেজিস্ট্যান্স বলা হয়। বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশে এটি ক্রমেই এক বড় জনস্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে উঠছে। এটি মোকাবেলায় সর্বতোভাবে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ জরুরি।

অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা নিশ্চিতে কত মাত্রা কতদিন সেবন করবে, তা খুব গুরুত্বপূর্ণ। নইলে তা মারণ ওষুধে পরিণত হতে পারে। দুঃখজনকভাবে দেশে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে নিয়ম-নীতির বালাই নেই। যথেচ্ছভাবে তা ব্যবহার হচ্ছে। নিয়ম হলো, পরীক্ষা-নিরীক্ষায় জীবাণু সংক্রমণের প্রমাণ মিললে চিকিৎসকের সুনির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য সুনির্দিষ্ট মাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া। অথচ অনেক চিকিৎসকের মধ্যেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া উপসর্গ দেখে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগের প্রবণতা বিদ্যমান। আবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেও অনেক সময় ব্যবস্থাপত্রে নির্দিষ্ট ডোজের কথা উল্লেখ থাকে না। দেশের এক-তৃতীয়াংশ চিকিৎসা পেশাজীবী রোগীদের উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের পরামর্শ দেন বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। এটি হতাশাজনক। এক্ষেত্রে রোগীদেরও একটা ভূমিকা আছে। দ্রুত আরোগ্য লাভের জন্য অনেক রোগীও অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণে আগ্রহ দেখায়। এমনকি অ্যান্টিবায়োটিক না লিখলে কিছু রোগী চিকিৎসক সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করে। এটিও অ্যান্টিবায়োটিক লেখায় চিকিৎসককে প্ররোচিত করছে। রোগীদের মধ্যে আরেকটি প্রবণতা হলো, অসুস্থ হলে চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে স্থানীয় ওষুধের দোকানদারের দ্বারস্থ হওয়া। ব্যবস্থাপত্র ছাড়া বিক্রির নিয়ম না থাকলেও অনিয়মতান্ত্রিকভাবে ফার্মেসিগুলো মুনাফার জন্য রোগীদের সাধারণ অসুখেও অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করে। মাত্রা সম্পর্কে তাদের যেমন ধারণা থাকে না, তেমনি কতদিন সেবন করতে হবে তার জ্ঞানও নেই। এতে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবেই রোগী শারীরিক ক্ষতির শিকার হচ্ছে, অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হয়ে পড়ছে। সরকারি হাসপাতালে অপ্রতুল সরবরাহও অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা হারানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। সাধারণত দরিদ্র রোগীরাই সেখানে যায়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চিকিৎসক হয়তো সাতদিনের কোর্স ব্যবস্থাপত্রে লেখেন। কিন্তু হাসপাতালের ফার্মেসি থেকে তিনদিনের ওষুধ দেয়া হয়। একে তো আর্থিক সংকট, তদুপরি চিকিৎসক পুরো কোর্স শেষ করার ব্যাপারে ভালোভাবে বুঝিয়ে না বলায় অনেক রোগীই সম্পূর্ণ কোর্স শেষ করছে না। বলা চলে, বহুমাত্রিক অপপ্রয়োগ বা অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে অ্যান্টিবায়োটিক ক্রমেই জীবাণু প্রতিরোধী হয়ে উঠছে। 

সন্দেহ নেই, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়েল ওষুধ মানুষের অতিপ্রয়োজনীয় বন্ধু। ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ফাঙ্গাসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর এক কার্যকর হাতিয়ার হলো এসব ওষুধ। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, ষাট, সত্তর, আশির দশকে যেভাবে অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার হয়েছে, এখন আর হচ্ছে না। যেসব অ্যান্টিবায়োটিক বাজারে আছে, সেগুলো ৩০ বছর আগে এসেছে। বেড়ে চলা নতুন রোগবালাইয়ের বাস্তবতায় নতুন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক দরকার হলেও এক্ষেত্রে খুব একটা অগ্রগতি দৃশ্যমান নয়। কিন্তু অপপ্রয়োগে যেভাবে বিদ্যমান অ্যান্টিবায়োটিকগুলো রোগপ্রতিরোধী হয়ে উঠছে, তা বেশ শঙ্কার। এমনটি হলে ভবিষ্যতে চিকিৎসা ক্ষেত্রে বড় জটিলতা সৃষ্টি করবে বৈকি। প্রেক্ষাপটে অ্যান্টিবায়োটিকের সচেতন দায়িত্বশীল প্রয়োগ দরকার।

পরিতাপের বিষয় হলো, দেশে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের কার্যকর যুগোপযোগী কোনো নীতিমালা নেই। দ্রুত এটি করা দরকার। চিকিৎসকদের হরেদরে অ্যান্টিবায়োটিক প্রদানের প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ফার্মেসিতে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি বন্ধ করা চাই। এক্ষেত্রে ওষুধ প্রশাসনের নজরদারি বাড়াতে হবে। একইভাবে দরিদ্র রোগীরা যাতে সম্পূর্ণ কোর্স শেষ করতে পারে, সেজন্য সরকারি হাসপাতালে যাকে দেয়া হবে, তাকে পুরো কোর্সের ওষুধ দেয়া উচিত মনে করছেন পেশাজীবীরা। আর দিতে না পারলে কিনে যাতে পুরো কোর্স শেষ করে, সেজন্য রোগীদের বোঝাতে চিকিৎসকদের আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। সাধারণ মানুষ যেন অ্যান্টিবায়োটিক চিনতে পারে তার জন্য লেবেলে ওষুধ কোম্পানিগুলোকে লাল রঙ ব্যবহার এবং ব্যবস্থাপত্রেও লাল রং ব্যবহারের পরামর্শ কারো কারো। জনসচেতনতা বাড়াতে এটা আমলে নেয়া যেতে পারে। কেবল মানবদেহ নয়, গবাদি পশু, পোলট্রি, মত্স্যপালন কৃষিতেও অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। কেননা এর মাধ্যমে খাদ্যশৃঙ্খলে ঢুকে পড়ে মানবদেহের পাশাপাশি পরিবেশের ক্ষতি করবে বৈকি। সার্বিক দিক বিবেচনায় নিয়ে অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে প্রত্যাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন