লিজিংয়ের অর্থ আত্মসাৎ করে জমি কেনার আসক্তি ছিল পলাতক পিকে হালদারের

জেসমিন মলি

আর্থিক খাতের আলোচিত চরিত্র প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পিকে হালদার। এক সময় আর্থিক খাতের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব পালন করেছেন। সে সময় দুর্নীতি ক্ষমতার অপব্যবহার করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন তিনি। নামে-বেনামে প্রচুর অর্থ ঋণ নিয়েছেন ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে। অর্থ ব্যবহার করে একের পর এক জমি কিনেছেন তিনি। কখনো নিজের নামে, কখনো বন্ধুর নামে। আবার এসব জমি দেখিয়েই আবারো ঋণ নিয়েছেন ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান তদন্তেও বিষয়টির প্রমাণ মিলেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পিকে হালদার জমি কিনেছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। এর মধ্যে কোনোটিতে তার নিজের নাম রয়েছে। আবার কোনোটিতে মালিক হিসেবে নাম রয়েছে তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারদের। একের পর এক জমি কিনেছেন বন্ধুদের নামেও। এক্ষেত্রে বেনামে জমি কেনার তথ্যই পাওয়া যাচ্ছে বেশি।

অর্থ আত্মসাৎ পাচারের অভিযোগ এনে দুদক পিকে হালদারের নামে একাধিক মামলা করেছে। প্রসঙ্গে তদন্ত অনুসন্ধানও চলছে। বিষয়ে দুদক সচিব মু. আনোয়ারুল হাওলাদার বণিক বার্তাকে বলেন, প্রশান্ত কুমার হালদারের বিরুদ্ধে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগের অনুসন্ধান তদন্ত চলছে। তদন্তে নেমে পিকে হালদারের নামে-বেনামে প্রচুর সম্পদের সন্ধান মিলেছে। নিয়ে পাওয়া বিভিন্ন তথ্য যাচাই-বাছাই চলছে। দুদকের আইন বিধি অনুযায়ী পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।

সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের ভুলতায় গাউছিয়া মার্কেটে পিকে হালদারের একটি গোপন গুদামের খোঁজ পায় দুদক। সে গুদামে সন্ধান মেলে কয়েকশ দলিলের। দেশের বিভিন্ন স্থানে পিকে হালদারের দখলে থাকা জমির মালিকানা সংবলিত এসব দলিল যাচাই-বাছাই করেছেন দুদকের তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। দুদকের অনুসন্ধানে পাওয়া এসব দলিলে উল্লিখিত জমির পরিমাণ দামের তালিকা বণিক বার্তার হাতে এসেছে। পিকে হালদারের নামে-বেনামে থাকা জমির তালিকার উল্লেখযোগ্য একটি অংশ এখানে তুলে ধরা হলো

ঢাকা: দুদকের তদন্তে ঢাকার উত্তরা আবাসিক এলাকার ১৩ নম্বর সেক্টরের কাঠা জমির দলিলের সন্ধান মিলেছে। দলিলে জমির দাম দেখানো হয়েছে সাড়ে কোটি টাকার কিছু বেশি। জমির মালিক হিসেবে নাম রয়েছে পূর্ণিমা রাণী হালদারের। পূর্ণিমা রাণী হালদার পিকে হালদারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোম্পানি উইনটেল ইন্টারন্যাশনালের কর্ণধার হিসেবে পরিচিত।

ঢাকার তুরাগে দিয়াবাড়ি মৌজায় পিকে হালদারের কেনা আরেকটি জমির দলিলের সন্ধান মিলেছে। দলিলে মালিক হিসেবে নাম রয়েছে তার নিজেরই। জমির ক্রয়মূল্য দেখানো হয়েছে আড়াই কোটি টাকা। দলিলে ২৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ জমিটির রেজিস্ট্রেশনের তারিখ দেয়া হয়েছে ২০১৯ সালের ১৮ এপ্রিল।

তুরাগের একই মৌজায় কাঠা বাড়িঘরসহ জমির দলিলের খোঁজ মিলেছে। এটিও তার নিজের নামেই। এটি কিনতে তিনি খরচ করেছেন ৭৬ লাখ টাকা। পল্লবী সাব রেজিস্ট্রার অফিসে দলিলটি রেজিস্ট্রি হয়। রেজিস্ট্রিকৃত জমিটির দলিল নং ২৬৩৭।

ঢাকার ধানমন্ডির নম্বর রোডে একটি ফ্ল্যাটের দলিল পাওয়া গিয়েছে পিকে হালদারের নামে। ফ্ল্যাটটি রেজিস্ট্রেশন করা হয় ২০১৫ সালে। ফ্ল্যাটটির দলিলে দাম দেখানো হয়েছে ৩৫ লাখ টাকা।

নারায়ণগঞ্জ: জেলার রূপগঞ্জের গোলাকান্দাইল ইউনিয়নের আধুরিয়া মৌজার সাড়ে ৭৭ শতাংশ জমির দলিল পেয়েছে দুদক। জমির মালিক হিসেবে নাম রয়েছে পিকের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোম্পানি অরিয়ল ইন্টারন্যাশনালের পরিচালক অনঙ্গ মোহন রায়ের। রূপগঞ্জের পূর্ব সাব রেজিস্ট্রার অফিসে রেজিস্ট্রিকৃত জমিটির দলিল নং ৬৭০৯। দলিলে জমি রেজিস্ট্রেশনের তারিখ রয়েছে ২০১১ সালের ১২ জুলাই। দলিলে জমিটির মূল্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ৬০ লাখ টাকা।

এছাড়া কোটি ৬৮ লাখ ২৫ হাজার টাকা দলিল মূল্যে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের আধুরিয়া মৌজার ২০০ দশমিক ৫৩ শতাংশ জমি কিনেছেন পিকে হালদার। দলিলে জমিটির মালিক হিসেবে রয়েছে পিকের স্বার্থসংশ্লিষ্ট স্বপন কুমার মিস্ত্রীর নাম। একই মৌজায় প্রায় সোয়া কোটি টাকায় জমি নিজ নামে কিনেছেন পিকে হালদার। জমির পরিমাণ ১৬২ দশমিক ৪০ শতাংশ। এছাড়াও ওই মৌজায় ১৬০ শতাংশ, ১৮১ ১৮৫ শতাংশ জমির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে, যার প্রতিটিই পিকে হালদারের নিজের নামে কেনা। এগুলোর প্রতিটিরই মূল্য কোটি টাকার বেশি।

২৫ লাখ টাকা দলিল মূল্যে রূপগঞ্জের গোলাকান্দাইল ইউনিয়নের পানাব মৌজায় সাড়ে ৩০ শতাংশ জমি কেনার তথ্য মিলেছে। দলিলে জমিটির মালিক হিসেবে নাম রয়েছে অনঙ্গ মোহন রায়ের। একই মৌজায় কেনা সাড়ে ৮৮ শতাংশ জমির মালিকানায় রয়েছেন পিকের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান জোফায়ার ইন্টারন্যাশনালের সুব্রত দাস।

নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের দুপতারা ইউনিয়নের বাজবি মৌজায় আরেকটি জমির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। এর দলিল মূল্য ৩৬ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। ৫১ শতাংশ আয়তনের জমিটি পিকে নিজের নামে কেনেন ২০১৬ সালে।

ময়মনসিংহ: জেলার ভালুকায় হাতীবেড়া মৌজায় ১০৩ শতাংশ জমি পিকে হালদার তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে কেনেন ২০১৩ সালে। দলিলে জমিটির ক্রয়মূল্য দেখানো হয় ১২ লাখ ৫২ হাজার টাকা। ভালুকার উথুরা মৌজায় ৩৮ শতাংশ জমির দলিলে রেজিস্ট্রেশন মূল্য দেখানো হয়েছে ১২ লাখ ৫৭ হাজার টাকা। জমিটি পিকে হালদার তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে কেনেন। উথুরা মৌজায় আরো ৩৩ শতাংশ জমি কেনার তথ্যও দুদক পেয়েছে। সে জমিটি কেনা হয় ১০ লাখ ৫৬ হাজার টাকা দিয়ে। ময়মনসিংহ জেলায় পিকে হালদারের কেনা জমির কমপক্ষে আটটি দলিল উদ্ধার করা হয়েছে। সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে দুদকের তদন্ত সূত্র জানিয়েছে।

নরসিংদী: জেলার মহিষাশুড়া ইউনিয়নের চৌদ্দ পাইক্যা মৌজার ৪৮৯ শতাংশ জমির দলিল পেয়েছে দুদক। পিকের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান উডব্রিজ লিমিটেডের পক্ষে প্রতিষ্ঠানটির ইমতিয়াজ আহমেদ সিরাজীর নামে কেনা হয়েছে জমিটি। এটি নরসিংদী সাব রেজিস্ট্রার অফিসের রেজিস্ট্রি করা, যার দলিল নং ৩৪২৬। জমিটির দলিলে রেজিস্ট্রেশনের তারিখ দেখানো হয়েছে ২০০৮ সালের ২০ মার্চ। দলিলে জমির ক্রয়মূল্য দেখানো হয়েছে ৮১ লাখ ২০ হাজার টাকা। একই মৌজায় ৩৪ শতাংশ আয়তনের আরেকটি জমিও কিনেছেন পিকে হালদার, যার দাম দেখানো হয়েছে লাখ ৬৪ হাজার টাকা। একই মৌজায় আরো ২৭ শতাংশ জমি কিনেছেন পিকে হালদার। এর মালিক হিসেবে নাম রয়েছে তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট মোহাম্মদ জাহেদুল আবেদীনের।

কক্সবাজার: জেলার ঝিলংজা মৌজায় দুই একর জমির দীর্ঘমেয়াদে বন্দোবস্ত নিয়েছেন পিকে হালদার। সে জমির ওপর র্যাডিসন হোটেল নির্মাণের কাজ চলছে। ক্লিউস্টোন ফুডস অ্যান্ড অ্যাকোমোডেশন নামের প্রতিষ্ঠানের অধীনে হোটেলটির যাবতীয় মালিকানা রয়েছে পিকে হালদার তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নামে।

এর বাইরেও পিকে হালদার তার সহযোগীদের নামে থাকা আরো হাজার ৬০০ কোটি টাকার সম্পত্তি এবং ব্যাংক আমানতের তথ্য পেয়েছে দুদক। প্রসঙ্গত, গত ২৪ ২৫ জানুয়ারি পাঁচটি ভুয়া কাগুজে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের ৩৫০ কোটি ৯৯ লাখ টাকার ঋণ নিয়ে আত্মসাতের অভিযোগে পিকে হালদারসহ ৩৩ জনকে আসামি করে পাঁচটি মামলা করে দুদক। সবগুলোতেই আসামি হিসেবে নাম রয়েছে পিকে হালদারের। আসামিদের মধ্যে পিকে হালদারের সহযোগী পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের চেয়ারম্যান উজ্জ্বল কুমার নন্দী ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের সাবেক এমডি রাশেদুল হককে ২৪ জানুয়ারি জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আটক করে দুদক। উজ্জ্বল কুমার নন্দী রাশেদুল হক আদালতে ১৬৪ ধারায় দায় স্বীকার করেছেন। অর্থ আত্মসাতে নিজেদের পাশাপাশি আরো কয়েকজনের সম্পৃক্ততার কথাও তারা আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে স্বীকার করেছেন।

গত বছরের জানুয়ারি প্রশান্ত কুমার হালদারের বিরুদ্ধে ২৭৪ কোটি ৯১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৫৫ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করে দুদক। মামলার এজাহারে হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা পাচারেরও অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে। পিকে হালদারকে গ্রেফতারে এরই মধ্যে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিস জারি করা হয়েছে। এছাড়া তার মা লীলাবতী হালদারসহ ২৫ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন হাইকোর্ট।

পিকে হালদারের বিরুদ্ধে অন্তত চারটি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। চারটি প্রতিষ্ঠান হলো ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (আইএলএফএসএল), পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড এবং বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন